মোহনবাগানের নির্বাসন
বদলে গেল জরিমানায়

ত্রিশ বছরের বন্ধুত্ব মুছে দিল সব নিয়ম-কানুন!
মোহনবাগানের ১২৪ বছরের ইতিহাসে নজিরবিহীন নির্বাসন উঠে গেল মঙ্গলবার। ভারতীয় ফুটবল ইতিহাসে নতুন নজির তৈরি করে।
ডার্বি ম্যাচে দল তুলে নেওয়ার জন্য আড়াই বছরের শাস্তি তো উঠলই। বাগান কর্তারা একান্তে বারবার দাবি করা সত্ত্বেও নির্বাসন পুরোপুরি উঠে যাওয়ার যে সম্ভাবনাকে সোমবার রাত পর্যন্ত অবাস্তব বলে মনে হচ্ছিল, পনেরো ঘণ্টা পরে তা-ও অবিশ্বাস্য ভাবে বাস্তব। ওডাফা-টোলগেরা ফিরে এলেন আই লিগে। দু’দিনের ‘অপারেশন ফেডারেশন’ শেষ করে যখন সাংসদ পুত্রের দিল্লির মীনা বাগের বাড়ি থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন স্বপনসাধন (টুটু) বসু, তখন দিল্লির রাজপথে সন্ধ্যার আলো জ্বলে উঠেছে। দু’আঙুলে ‘ভি’ দেখিয়ে টুটু বলে গেলেন, “ইস্টবেঙ্গল যা চাইবে তা হবে না। ম্যায় হুঁ না।”
টুটু-অঞ্জন মিত্ররা উল্লাস করতে করতে কলকাতায় ফিরে গেলেও ফেডারেশনের সিদ্ধান্ত ঘিরে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। ইস্টবেঙ্গল সচিব কল্যাণ মজুমদার বলে দিয়েছেন, “আমরা জানতে চাই আসল ঘটনাটা কী। মনে হচ্ছে টেবিলের তলা দিয়ে অন্য কোনও খেলা হয়েছে।” শুধু ইস্টবেঙ্গল নয়, অন্য অনেক ক্লাবও ক্ষুব্ধ। যেমন সিকিম ইউনাইটেডের কর্তা ভাইচুং ভুটিয়া বলে দিলেন, “আমরা মোহনবাগানের ফাঁসি চাইনি। কিন্তু পুরো শাস্তি উঠে যাক সেটাও চাইনি।” গোয়া ও মুম্বইয়ের অনেক ক্লাবও তাদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছে প্রকাশ্যে। নির্বাসন-কলঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়েও তাই সবুজ-মেরুন জার্সিতে কালির ছিটে লাগল বলে মনে করছে ভারতীয় ফুটবল মহল।
দু’কোটি টাকার বিশাল জরিমানা। ফেডারেশনের কোনও সভায় এ বছর ক্লাবের কোনও কর্তা উপস্থিত থাকতে পারবেন না। দশ ম্যাচ খেলে পাওয়া ১২ পয়েন্ট মুছে যাবে। শূন্য থেকে শুরু করে ১৬ ম্যাচে অবনমন বাঁচানোর কঠিন চ্যালেঞ্জ সামনে। কলঙ্কের নির্বাসন উঠে যাওয়ার পরে এ সব ‘ঠুনকো শাস্তি’কে গুরুত্বই দিতে চাইছেন না গ্যাং অব ফোর সভাপতি টুটু বসু, সচিব অঞ্জন মিত্র, সহ-সচিব সৃঞ্জয় বসু এবং অর্থসচিব দেবাশিস দত্ত। বিশাল মিষ্টির হাঁড়ি থেকে কর্মচারীদের রসগোল্লা বিলোনোর নির্দেশ দিয়ে মোহনবাগান সভাপতি বললেন, “দল তুলে নিয়ে আমরা যে ভুল করিনি সেটা প্রমাণিত। হয়তো পদ্ধতিগত ভুল ছিল। ক্লাব নির্বাসনে যাবে,আমরা মেনে নেব?”
ঐতিহ্যের শিকড় উপড়ে ফেলে চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও চিমা ওকোরিকে খেলিয়েছিলেন প্রথম বিদেশি ফুটবলার হিসাবে। স্যামি ওমোলো থেকে আই এম বিজয়ন, কৃশানু-বিকাশ থেকে ভাইচুং ভুটিয়া ফুটবলার ছিনিয়ে আনায় বহু বার ইস্টবেঙ্গলকে টেক্কা দিয়েছেন। আট বছর আগে কঠিনতম নির্বাচন জিতেছেন ক্লাবে। কিন্তু টুটু নিজেই মানছেন, তাঁর বাইশ বছরের ক্লাব প্রশাসনে এ রকম চ্যালেঞ্জের মুখে কখনও পড়েননি। বলেই ফেললেন, “মাঠের বাইরে এটাই আমার সেরা জয়। নির্বাসন হলে যাঁরা আমাকে ভোট দিয়েছেন তাদের কী বলতাম? ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছিলেন যাঁরা, এ বার তাঁরা খোলসে ঢুকে পড়ুন।”
কিন্তু কোন রসায়নে এই অসাধ্য সাধন করলেন বাগানের চারমূর্তি (টুটু এই নামেই পরিচয় দিলেন)? ওলট-পালট করে দিলেন ফেডারেশন থেকে আই লিগের সব ক্লাব, কিছু প্রাক্তন ফুটবলার থেকে ইদানীং মাথাচাড়া দেওয়া বিরোধীদের সব অঙ্ক? চুম্বকে উঠে আসছে দু’টি শব্দ বন্ধুত্ব এবং নাম-মাহাত্ম্য!
প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা কর্মসমিতির সভার পর ভারী শিল্প মন্ত্রকের অফিসে চমকপ্রদ সাংবাদিক সম্মেলনটা যখন করছেন ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট প্রফুল্ল পটেল, তখন তাঁর মুখ থেকে বারবার বেরিয়ে এসেছে, “মোহনবাগানের ঐতিহ্য, ইতিহাস আর জনসমর্থনের কথা ভেবেই নির্বাসন তুলে নিচ্ছি। অন্য কোনও ক্লাব ভবিষ্যতে এ রকম করলে আর সিদ্ধান্ত বদলাবে না।”
কিন্তু তিনি যেটা বলেননি তা হল, “আমার অসময়ে বন্ধু তুমি দেখেছিলে, এ বার আমার পালা।”
টুটুর সঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রফুল্লের বন্ধুত্ব প্রায় বত্রিশ বছরের। টুটু মোহন-কর্তা হওয়ার পর সেই ব্যবসায়িক বন্ধুত্ব মজবুত হয় ফুটবলে। প্রফুল্ল ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট থাকার সময় প্রতি রোভার্স কাপেই দল পাঠিয়েছেন টুটুরা। তা সে টিমের অবস্থা যত খারাপই হোক না কেন। পরে সাংসদ হওয়ার পর টুটু এবং তাঁর পুত্র সৃঞ্জয়ের সঙ্গে প্রফুল্লর সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। সেটাই কাজে লাগিয়ে এত বড় সাফল্য পেল বাগান। ক্লাবে বহু দিন বড় ট্রফি না থাকুক, মাঠের বাইরে যে টুটু-চমক অব্যাহত, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল আগের রাতেই।
এ দিন সকালে প্রফুল্লের ফ্ল্যাটে শাস্তির নিদান ঠিক হয়ে যায়। কর্মসমিতির সভায় যা হয়, তা স্রেফ নাটক। প্রফুল্ল চাইছিলেন মুখরক্ষার কিছু অস্ত্র। সেটা অনুমোদন করেন টুটু-অঞ্জনরা। বড় অঙ্কের জরিমানা, কর্তাদের ফেডারেশনের সভায় (যে সভা তো হয়ই না) যোগ না দেওয়ার শাস্তি এবং শূন্য পয়েন্ট থেকে শুরু করা সবই মেনে নেন টুটু। ফেডারেশন অফিস থেকে বেরিয়ে উৎফুল্ল মোহন-সভাপতি বলেন, “আমি আর অঞ্জন ছিলাম স্ট্রাইকার। সৃঞ্জয় আর দেবাশিস খেলল উইংয়ে। কে আটকাবে আমাদের!” কথাটা তিনি যে ভুল বলেননি তা গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় মোহনবাগানের নিখুঁত অপারেশনে তা পরিষ্কার।
লাভ লোকসান
• উঠে গেল আড়াই বছরের সাসপেনশন।
• জরিমানা দিতে হবে দু’কোটি টাকা।
• আই লিগে শূন্য পয়েন্ট নিয়ে শুরু করতে হবে।
• এক বছর এআইএফএফ বৈঠকে থাকতে পারবেন না মোহন-কর্তারা।
• আর কখনও খেলা চলাকালীন দল তুলে নেব না, এই মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি।

সব বিরোধ শিকেয় তুলে ফেডারেশন ভাইস প্রেসিডেন্ট সুব্রত দত্তর সঙ্গে মধুর সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছিলেন সচিব অঞ্জন মিত্র। মোহনবাগানের পক্ষে আই লিগের ১১টা (ইস্টবেঙ্গল ও অ্যারোজ বাদে) ক্লাবের সমর্থন যোগাড় করেছেন দেবাশিস। আর বাবা টুটুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সৃঞ্জয় প্রতি মুহূর্তে যোগাযোগ রেখেছেন প্রফুল্লর সঙ্গে। ডেম্পো প্রধান শ্রীনিবাস ডেম্পো থেকে শুরু করে কর্মসমিতির উপস্থিত ১৫ সদস্যকেও ‘ম্যানেজ’ করে নেন ওঁরা। শুধু তা-ই নয়, কর্মসমিতির সভায় কোন কাগজপত্র নিয়ে যাওয়া হবে, আগের রাতে তিনটে পর্যন্ত জেগে মোহন-কর্তাদের তা বলে দিয়ে যান ফেডারেশনের এক কর্তা। অবশ্যই প্রফুল্লর নির্দেশে। সকাল পৌনে বারোটায় সভা শুরুর মিনিট দশেকের মধ্যে মোহনবাগানের ‘চারমূর্তি’র ডাক পড়ে সভায়। মঞ্চ তৈরি ছিলই। ১৯৮০-র ১৬ অগস্ট-সহ নানা ঘটনা তুলে ধরেন মোহন-কর্তারা। পঁয়তাল্লিশ মিনিট কথা বলে বেরিয়ে যাওয়ার আগে টুটু বলে যান, “আমরা দল তুলে নেওয়ার জন্য ক্ষমা চাইছি। তবে শাস্তিটা খুব বেশি হয়ে গিয়েছে। আশা করব সুবিচার পাব।”
কিন্তু গোটা ব্যাপারটা আরও নাটকীয় করে তোলার জন্য দুঁদে রাজনীতিবিদ প্রফুল্ল সভা চালিয়ে যেতে থাকেন। বাইরে সংবাদমাধ্যমের উপচে পড়া ভিড় দেখে চেন্নাই যাওয়ার বিমানের টিকিট বাতিল করে দেন ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট। যেমন ক্লাবের নির্বাসন তোলাকে প্রাধান্য দিয়ে হলদিয়ায় বেঙ্গল লিডসে যাননি শিল্পপতি টুটু।
টুটু-প্রফুল্লর বন্ধুত্বের রসায়নে বাগানের বাঁচার সনদ টাইপ হয়ে যখন এল, তখন সাংবাদিক সম্মেলনে পিন পড়লে শব্দ হয়। সকাল থেকে ফুটবল হাউসে অপেক্ষায় থাকা সাংবাদিকদের মোবাইলে কয়েকশো ফোন এসেছে কলকাতা থেকে। প্রাক্তন ফুটবলার থেকে কর্তা, সমর্থক সকলের। প্রফুল্লকে প্রশ্ন করা হয়, তা হলে এক সদস্যের অশোক গঙ্গোপাধ্যায় কমিটির রিপোর্টের কোনও মূল্য থাকল না? ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট বলেন, “উনি শেষ পাতায় কিন্তু লিখেছেন, ঐতিহ্যসম্পন্ন এত বড় ক্লাবকে এ রকম কঠিন শাস্তি দেওয়ার আগে একটু বিবেচনা করবেন।” কিন্তু আপনার এই সিদ্ধান্তে তো আই লিগের অন্য ক্লাবেরা ক্ষুব্ধ হবে? প্রশ্ন শুনে কিছুটা চটে যান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। বলে দেন, “আমরা কী সিদ্ধান্ত নেব এ-বি-সি-ডি কেউ ঠিক করবে না।”
ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট নিদান দিয়ে চলে যাওয়ার পর মোহন-কর্তারা কোমর বেঁধে নামছেন ক্লাবে নিজেদের মুঠি শক্ত করতে। আজ বুধবার কর্মসমিতির সভা ডেকে দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু যাঁকে কোণঠাসা করতে এই সভা ডাকা, সেই বিক্ষুব্ধ সদস্য, কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ এ দিনই পদত্যাগ করেছেন কর্মসমিতি থেকে। তাঁর বক্তব্য, “কর্তাদের ফেডারেশন শাস্তি দিয়েছে। কলঙ্কিত কর্তাদের সঙ্গে থাকব না।”
নির্বাসন থেকে মুক্তি মিললেও বাগানের সামনে কিন্তু অবনমন বাঁচানোর কঠিন চ্যালেঞ্জ। কর্তাদের বা করিম বেঞ্চারিফার দলের যেটা সুবিধে, তা হল, এ বছর কেউ আর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চাপ দেবে না। সবাই চাইবে অবনমন বাঁচুক। ওডাফার শাস্তিও জরিমানা দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা শুরু করে দিয়েছেন কর্তারা। দু’কোটির জরিমানা কমাতে আবেদন করছেন তাঁরা। সেখানেও প্রফুল্লর প্রসন্নতা পাবেন হয়তো।
করিম ব্রিগেড অবনমন বাঁচাতে পারবে কি না সেটা সময় বলবে। কিন্তু বিতর্কের আঁচ যে এখনই নিভছে না, তা হলফ করে বলা যায়।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.