প্রবন্ধ ১...
কেন্দ্র এবং রাজ্য, উঁচু এবং নিচু, রাজা এবং প্রজা

কেন্দ্রীয় সরকার চতুর্দশ অর্থ কমিশন গঠন করেছে। অর্থ কমিশন নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর কেন্দ্র এবং রাজ্যের আর্থিক সম্পর্কের কাঠামো সংশোধন করে আসছে। প্রথমেই বলা দরকার, ‘কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক’ কথাটার মধ্যেই রাজ্যকে কিছুটা হেয় করে দেখার একটা মানসিকতা আছে কেন্দ্র যেন সূর্যের মতো, আর রাজ্যগুলো তার গ্রহ। সংবিধানে কোথাও ‘কেন্দ্র’ কথাটা নেই, অথচ দেশের সামগ্রিক (ইউনিয়ন) সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকার বলে ডাকার রীতি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লক্ষণীয়, সরকারিয়া কমিশনের উত্তরসূরি হিসাবে যে কমিশনটিকে ইউনিয়ন ও রাজ্যগুলির সম্পর্কের কাঠামো পর্যালোচনার জন্য গঠন করা হয়েছিল, ২০১০ সালে যেটি রিপোর্ট দাখিল করে, তার নাম দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বিষয়ক কমিশন। আসলে ভারতের শাসনতন্ত্র অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত, রাজ্যের ক্ষমতা এখানে অনেক কম, চিনের তুলনাতেও। এটা কিছুটা ইতিহাসের উত্তরাধিকার, কিন্তু স্বাধীনতার পরে কেন্দ্রের এই আধিপত্য নানা ভাবে আরও জোরদার হয়। সম্পদ বণ্টনের পদ্ধতিও এ ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করে।
রাষ্ট্রীয় পরিসরের বিকেন্দ্রীকরণকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়: রাজনৈতিক, শাসনকাঠামোগত, রাজস্ব নীতি সম্পর্কিত এবং অর্থনৈতিক। বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে নানা ধরনের যুক্তি পেশ করা হয়। একটা হল কার্যকারিতার যুক্তি; বলা হয়, সরকারি পণ্য ও পরিষেবা সরবরাহের ব্যবস্থাটির বিকেন্দ্রীকরণ করলে কাজ ভাল হয়, কিংবা বিভিন্ন ধরনের শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রেও বিকেন্দ্রীকরণ খুব উপযোগী, কারণ তাতে সম্পদের ব্যবহার অনেক কার্যকর হয়ে থাকে। আর এক ধরনের যুক্তি হল, বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষ অনেক বেশি যোগ দেওয়ার সুযোগ পায়। তবে বিকেন্দ্রীকরণ কেবল কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যেই তো প্রযোজ্য নয়, রাজ্যের ভিতরেও বিকেন্দ্রীকরণ দরকার, সেখানেই শাসনব্যবস্থার তৃতীয় স্তরের গুরুত্ব।
প্রথম অর্থ কমিশনের প্রথম বৈঠক। মাঝখানে কমিশনের কর্ণধার কে সি নিয়োগী,
তাঁর ডান দিকে ভি পি মেনন এবং এম ভি রঙ্গচারী, বাঁ দিকে কৌশলেন্দ্র রাও
এবং বি কে মদন। নয়াদিল্লি, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৫১
কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বিষয়ক রিপোর্টটির দ্বিতীয় খণ্ডে সংবিধানসম্মত রাষ্ট্রচালনা এবং কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পরিচালনার প্রশ্নগুলিও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রশ্নগুলো সংক্ষেপে বলে নিই।
, অনেক সময়েই সপ্তম তফসিলে যুগ্ম তালিকার অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলিতে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়ার আগে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের সঙ্গে পরামর্শ করেনি।
, আন্তঃরাজ্য পরিষদ ঠিক ভাবে কাজ করে না।
, রাজস্ব ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে কেন্দ্র, রাজ্য ও যুগ্ম তালিকার বাইরে থাকা ‘অবশিষ্ট’ বিষয়গুলিকে কেন্দ্রের এক্তিয়ারে না রাখে রাজ্যের হাতে তুলে দেওয়া উচিত।
, রাজ্য বিধানসভায় অনুমোদিত কোনও বিল রাজ্যপালের কাছে পাঠানো হলে এবং তিনি সেটি রাষ্ট্রপতির কাছে বিবেচনার জন্য পাঠানো হলে তিনি সেটা কত দিন ধরে রাখতে পারবেন, সংবিধানে তার কোনও সময়সীমা বেঁধে দেয়নি।
, রাজ্যপালের নিয়োগ ও অপসারণের পদ্ধতিকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করা জরুরি।
, ৩৫৬ ধারা জারি-সহ রাজ্যপালের যথেচ্ছ আচরণের ক্ষমতা খর্ব করা দরকার। সাত, যোজনা কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলি পুরোপুরি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে, সেখানে রাজ্যের কোনও প্রতিনিধিত্বই নেই। আট, রাজ্যসভার কাজ রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করা, অথচ রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বাসিন্দা হওয়ার যে শর্ত ছিল, সেটি ২০০৩ থেকে রদ হয়ে যায়। এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শের পরিপন্থী। নয়, সর্বভারতীয় সার্ভিসগুলির ক্ষেত্রে রাজ্যের গুরুত্ব বাড়ানো জরুরি।
সংবিধানের সপ্তম তফসিল অনুসারে কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে রাজস্ব ও ব্যয়ের যে বিভাজন সূত্র নির্ধারিত, সেখানেও ভারসাম্যের অভাব আছে। গড়পড়তা হিসাবে, রাজ্যগুলি মোট রাজস্বের ৩৪ শতাংশ আদায় করে এবং খরচ করে মোট ব্যয়ের ৫৮ শতাংশ। এই ৫৮ শতাংশের হিসাবটিও একটু বিভ্রান্তিকর। রাজ্যগুলির মোট ব্যয়ের প্রায় ১৫ শতাংশ যায় কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিত বিভিন্ন প্রকল্পে। এগুলির ব্যয়বরাদ্দের একটা অংশ রাজ্যকে জোগাতে হয়। সুতরাং, রাজ্য যেটা স্বাধীন ভাবে খরচ করতে পারে, তার পরিমাণ ৫৮ শতাংশের চেয়ে কম। তার উপর, কেন্দ্রনির্দেশিত প্রকল্পে রাজ্যের ব্যয়ভাগ ক্রমশ বাড়ছে, সুতরাং স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুপাত কমছে। এর পাশাপাশি, রাজ্যগুলির নিজস্ব রাজস্ব থেকে চলতি খরচ সংস্থানের সামর্থ্য সীমিত এবং সেটা ক্রমশই আরও সঙ্কুচিত হচ্ছে। রাজ্যগুলির মূলধনী আয় বাড়ানোর সুযোগও অত্যন্ত কম।
রাজ্যগুলির মধ্যে রাজস্বের ভাগ বণ্টন করে দেওয়ার ক্ষেত্রে কী ভাবে সমতা রক্ষা করা যাবে, সমস্ত অর্থ কমিশন তা নিয়ে ভেবেছে। সমতার দুটি দিক আছে:
উল্লম্ব (ভার্টিকাল), অর্থাৎ কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে সমতা;
অনুভূমিক (হরাইজন্টাল), অর্থাৎ বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে সমতা। কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে আর্থিক সম্পদের বণ্টন হয় তিন ভাবে: অর্থ কমিশন মারফত, যোজনা কমিশনের মাধ্যমে এবং কেন্দ্রীয় প্রকল্প ও কেন্দ্রীয় সাহায্যপ্রাপ্ত প্রকল্প বাবদ। এর মধ্যে একমাত্র অর্থ কমিশনই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। যোজনা বরাদ্দের কোনও সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই।
অথচ চতুর্থ অর্থ কমিশনের পর থেকে, অর্থাৎ ১৯৬৯ থেকে নবম কমিশন পর্যন্ত যোজনা ব্যয় এবং মূলধনী ব্যয়ের জন্য অনুদান নির্ধারণের কাজটা অর্থ কমিশনের হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। দশম অর্থ কমিশনের সময় থেকে বিচার্য বিষয়ের তালিকা থেকে মূলধনী ব্যয় ও যোজনা ব্যয়কে স্পষ্ট ভাবে বাদ দেওয়া হয় না বটে, কিন্তু অর্থ কমিশনগুলি সেগুলি কার্যত বিবেচনা করেনি, যোজনা-বহির্ভূত চলতি খরচের বিষয়েই চিন্তাভাবনা সীমিত রেখেছে। এই রীতির পরিবর্তন জরুরি। যোজনা এবং যোজনা-বহির্ভূত ব্যয়ের পার্থক্যটি অবিলম্বে মুছে দেওয়া দরকার, যোজনা কমিশনের মাধ্যমে সম্পদ বণ্টনের মাত্রা অনেক কমানো দরকার, অর্থ কমিশনের সাংবিধানিক গুরুত্ব নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা দরকার।

দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.