সম্পাদকীয় ১...
ভ্রান্ত নজির
ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনী কি দেশের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ও তাহার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অধীন? সেনাধ্যক্ষ জেনারেল বিক্রম সিংহের সাংবাদিক সম্মেলন শুনিলে মনে হইতে পারে, ভারতীয় সেনাবাহিনী সম্ভবত স্বাধীনভাবেই প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত লইবার অধিকারী। সীমান্তরেখায় পাকিস্তানি সেনার আক্রমণে দুই ভারতীয় জওয়ানের মর্মান্তিক মৃত্যু বা হত্যার প্রতিক্রিয়ায় জেনারেলের বক্তব্য: এমন অবাঞ্ছিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ভারতের প্রত্যাঘাত আমন্ত্রণ করিবে। এ ধরনের কঠোর, হুমকি-মিশ্রিত ঘোষণা আপাতশ্রবণে স্বাভাবিক মনে হইতে পারে, কিন্তু সরকারের কোনও মন্ত্রী কিংবা আধিকারিক এ ধরনের অবস্থান ঘোষণা করেন নাই। প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রতিরক্ষামন্ত্রী যদি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি অনুরূপ কড়া মনোভাব লইতেন, বলার কিছু ছিল না। কিন্তু সেনাধ্যক্ষের মুখে এমন প্রকাশ্য বিবৃতি উদ্বেগ জাগাইয়া তোলে, বিশেষত বিদেশমন্ত্রী তথা কেন্দ্রীয় সরকার যখন এই বিষয়ে সুচিন্তিত সংযমের পরিচয় দিয়া আসিতেছেন। উত্তেজনা বৃদ্ধিকারী কোনও মন্তব্য সেনাধ্যক্ষ না করিলেই ভাল করিতেন।
সত্য, যে ভাবে দুই ভারতীয় জওয়ানের দেহ উদ্ধার হইয়াছে, তাহাতে জওয়ানদের মধ্যে, বস্তুত সমগ্র দেশবাসীর মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। পাকিস্তানি শিবিরের আচরণে যে মৃতের প্রতি ন্যূনতম সৌজন্যটুকুও প্রদর্শিত হয় নাই, উপরন্তু নিহতদের শবের প্রতি চরম অমর্যাদা দেখানো হইয়াছে, ইহা ভারতবাসীকে মর্মাহত করিয়াছে। বিরোধী দলের নেতারা অবশ্য এই স্বাভাবিক বেদনাবোধকে উস্কানির কাজে ব্যবহার করিয়া পাকিস্তান-বিরোধী রণদুন্দুভি বাজাইতে শুরু করেন। লোকসভার বিরোধী নেত্রী সুষমা স্বরাজ তো দুইটি ‘কাটা-মুণ্ড’র বদলায় পাক সেনাদের দশটি কাটা-মুণ্ড ফেরত দিবার কথাও বলেন। বিজেপি ও শিব সেনার হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সহিত উগ্র জাতীয়তাবাদী রণোন্মাদনা একাকার হইয়া যায়। শিব সেনার ঘাঁটি মুম্বইয়ে পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের মাঠে নামার বিষয়টিও অনিশ্চিত হইয়া পড়ে। এ ধরনের আবহে যুক্তি ও বুদ্ধির পরিবর্তে আবেগ ও অন্ধ প্রক্ষোভের ক্রিয়া প্রবল হয়। শুভবুদ্ধি ও স্থিতপ্রজ্ঞার ভূমিকা কিন্তু এই সব ক্ষেত্রেই জরুরি হইয়া উঠে। তদনুযায়ীই ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ নিয়ন্ত্রণরেখায় গুলিবিনিময় ও সংঘর্ষের ঘটনাটিকে প্রাপ্যের অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে সম্মত হন নাই। কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী মণীশ তিওয়ারিও যুযুধান মনোভাব ত্যাগ করিয়া ঠান্ডা মাথায় বিষয়টি বিবেচনার কথা বলেন। এই প্রেক্ষিতেই সেনাধ্যক্ষ বিক্রম সিংহের সাংবাদিক বৈঠক কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হইয়া পড়ে।
হইতে পারে, সেনাধ্যক্ষ তাঁহার বাহিনীর দুই জওয়ানের মর্মান্তিক পরিণতিতে ব্যক্তিগত ভাবে যৎপরোনাস্তি বেদনাহত হন। বাহিনীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কাও কি তাঁহাকে তাড়িত করিয়াছে? কিন্তু তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন, তাহাতে ব্রতচারীর কাঠিন্য প্রয়োজন, আবেগে প্লাবিত হওয়া নয়। নিজের মনোবেদনা ও ক্ষোভের কথা তিনি তাঁহার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ প্রতিরক্ষামন্ত্রী, এমনকী প্রধানমন্ত্রীকেও জানাইতে পারিতেন। হয়তো সেটাই তাঁহার পক্ষে সমীচীন হইত। তাহার বদলে তিনি সাংবাদিক সম্মেলন ডাকিয়া ফেলিলেন। ভারত একটি পরিষদীয় গণতন্ত্র, যেখানে সেনাপ্রধানরা কথায়-কথায় প্রকাশ্যে আপন মতামত বিবৃত করেন না। এই গণতন্ত্রে নির্বাচিত অসামরিক কর্তৃপক্ষের অধীনতা শিরোধার্য করার মধ্যেই সেনাবাহিনীর আজ্ঞাবহতার সংস্কৃতি নিহিত। সেনা-ছাউনি হইতে দেশ শাসিত হইলে তাহার পরিণাম কী হয়, প্রতিবেশী পাকিস্তান তাহার জ্বলন্ত উদাহরণ। ভারতীয় শাসনব্যবস্থা ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের যে পরিষদীয় গণতন্ত্র অনুশীলন করে, ব্রিটিশ রাজের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সেই বন্দোবস্তে সেনাবাহিনী দেশরক্ষা, জাতীয় নিরাপত্তা ও সীমান্তপ্রহরার মতো কাজেই লিপ্ত থাকে, প্রতিবেশীদের সম্পর্কে নীতি-নির্ধারণ বা অবস্থান গ্রহণের দায় হইতে বাহিনী মুক্ত। সেনাধ্যক্ষ একটা ভ্রান্ত নজির গড়িয়া ফেলিয়াছেন। এই ভ্রান্তি কিন্তু সংশোধনের অতীত নয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.