রাজ্য সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে ধান কেনার কথা বললেও ‘শস্যগোলা’ বর্ধমানে চালকলমুখো হচ্ছেন না চাষিরা। বরং হাতে-হাতে দ্রুত ভাঙানোর মতো চেক পেয়ে অনেক চাষিই অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিগমের (ইসিএসসিসিসি) শিবিরে ভিড় করছেন।
দিন কয়েক আগে গলসির দু’টি ব্লকে ঘুরে চোখে পড়েছে এমনই চিত্র। জেলা খাদ্য নিয়ামক শঙ্করনারায়ণ বাঁকুড়া মেনেও নিয়েছেন, “চালকলে সত্যিই ভিড় নেই।” তাঁর ব্যাখ্যা, “গত বার কিছু চালকল চাষিদের পাওনা চেক নিয়ে নানা ধরনের গোলমাল করেছিল। তাতে চাষিদের বিশ্বাস কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে। তাই তাঁরা সরাসরি নিগমের শিবিরে ভিড় করছেন। চেকও পেয়ে যাচ্ছেন।” |
ধান দেব মেপে |
বর্ধমান মহকুমা |
পাঁচটি সরকারি এজেন্সিকে মাঠে নামিয়ে ধান কিনছে রাজ্য সরকার। কিন্তু চাষিরা কি আদৌ
সরকারি শিবিরে ন্যয্য মূল্যে বিক্রি করতে পারছেন ধান?
না কি খোলাবাজারে অভাবী বিক্রিই ভবিতব্য? |
 হায়দার আলি
বড় চাষি
গ্রাম মাছখান্ডা,
থানা রায়না
‘উৎপন্ন ধান ১৬ কুইন্টাল। আমন ধান কেনার কথা
এখনও শুনিনি। বেলসরের এক সমবায় গতবার
কিছু
ধান
কিনেছিল।
কিন্তু তা সামান্যই। এ বছর
স্থানীয়
ধান ব্যবসায়ীরাই ধান কিনছে।’ |

শেখ হানিফ
প্রান্তিক চাষি,
গ্রাম ফকিরপুর, থানা রায়না
‘উৎপন্ন ধান ৬ কুইন্টাল। ৬০০-৬৬০ টাকা বস্তা
প্রতি
ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। গতবারের মতো
এবারও
অভাবী
বিক্রি হচ্ছে। কোনও চালকল বা
সমবায়
ধান কেনার
দায়িত্ব নিয়েছে বলে জানিনা।’ |
|

গৌতম তা
সমবায় কর্তা,
ঝিঙ্গুটি পল্লি বন্ধু কৃষি উন্নয়ন সমিতি
‘সদস্য সংখ্যা ৪০০-র বেশি। ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা
এখনও
স্থির হয়নি। ব্যাঙ্ক ঋণ বা মিলের সহযোগিতার
আশ্বাসও এখনও
মেলেনি। এলাকাতে
কোনও শিবিরও হয়নি এ বছর।’ |

মিহির হাজরা
চালকলের মালিক,
ভাণ্ডারডিহি থানা বর্ধমান
‘১ লক্ষ ২০ হাজার কুইন্টাল ধান মজুত করার
ক্ষমতা।
ইতিমধ্যে কেনা হয়েছে ২৮৭০ কুইন্টাল।
আরও ৫০০০
কুইন্টাল কেনার প্রস্তুতি চলছে।
সঙ্গে সঙ্গেই
চাষিদের চেক দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’ |
|
‘১৪-২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে গলসি ১ ও ২ ব্লক, আউশগ্রামের দুটি ব্লক, রায়না,
মেমারি ২ ব্লক ও ভাতারে ধান কেনা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আউশগ্রাম,
ভাতার ও মেমারি ১ব্লকে ধান কেনা শুরু হচ্ছে।’
শুভ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়
খাদ্য নিয়ামক,
বর্ধমান মহকুমা
|
|
গলসির পারাজ রেলস্টেশনের দিকে চলে যাওয়া রাস্তায় একটি চালকলে ইসিএসসিসি শিবির করেছে। সেখানে দিনে গড়ে ২৫-৩০ জন চাষি আসছেন। সামনেই টেবিল নিয়ে বসে ইসিএসসিসি-এর কমার্শিয়াল ইনস্পেক্টর শেখ আমিনুল। টেবিলে রাখা একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চেকবই। ইনস্পেক্টর বলেন, ‘‘প্রতি দিনই ব্লকের নানা গ্রাম থেকে ধানচাষিরা আসছেন। এক-এক জন ৮০ কুইন্ট্যাল পর্যন্ত ধান বিক্রি করছেন। চেক নিয়ে যাচ্ছেন।”
কিন্তু সরকারি নিয়মে যে মাথা পিছু ২০ কুইন্ট্যালের বেশি ধান খরিদ করার কথা নেই? কী করে ৮০ কুইন্ট্যাল নিচ্ছেন? আমিনুলের ব্যাখ্যা, “আসলে ওই ধানটা একটি পরিবারের গোটা জমির। যাঁর নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, পরিবারের এমনই এক জন অন্যদের প্রতিনিধি হয়ে আসছেন। তাঁকেই গোটা ধানের দামের চেক দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।” শিবিরে এসে স্থানীয় কোলকোল গ্রামের চাষি সালাম চৌধুরী বলেন, “আগের বার অন্য একটি চালকলে ধান বিক্রি করেছিলাম। কিন্তু তাদের দেওয়া চেক ভাঙাতে গিয়ে ব্যাঙ্কে ঘুরে-ঘুরে জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে যাবার জোগাড়! এ বার তাই গ্রামের লোকেদের মুখে এই শিবিরের কথা শুনে এবং নিগমের দেওয়া চেক দ্রুত ভাঙানো যাচ্ছে জেনে এখানেই ৪০ বস্তা ধান বিক্রি করেছি।” |
 |
খোলা বাজারে
(দাম কুইন্টাল প্রতি)
লাল স্বর্ণ -১১৭০ টাকা
আইআর৩৬ -১২৮৪ টাকা
(সরু চাল) |
|
পারাজের চাষি সত্যেন প্রামাণিক এসেছেন নিজের ও তাঁর ভাইয়ের ধান নিয়ে। সেই ধান দ্রুত ওজন হল। চেক হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরে গেলেন তিনি। পারাজে অন্তত তিনটি ইসিএসসিসি-এর শিবিরে চাষিদের এমন ধান বিক্রিতে উৎসাহ দেখা গিয়েছে। সম্পূর্ণ উল্টো চেহারা গলসির একটি চালকলে। সেখানে সবে শিবির চালু করেছে গলসি থানা সমবায় সমিতি। প্রথম দিন এক জন চাষিও আসেননি। সমবায়ের কর্মী চন্দ্রশেখর রায় অবশ্য বলেন, “এই তো সবে শিবিব খুলেছে। চাষিরা ঠিকই আসবেন।” বর্ধমান জেলা চালকল মালিক সমিতির সম্পাদক দেবনাথ মণ্ডল অবশ্য পরিস্থিতি মেনে নিয়ে বলেন, “ইসিএসসিসি-এর শিবিরে চাষিরা হাতে-হাতে ধান বিক্রি করে চেক পাচ্ছেন। তাতেই ওখানে ভিড় হচ্ছে। তবে দিন পনেরোর মধ্যে চালকলেও চাষিরা আসবেন।”
প্রশ্ন হল, চাষিরা যখন চালকলে আস্থা রাখতে পারছেন না, জেলায় মাত্র ১০টি শিবির খুলে কতটা চাল কিনতে পারবে ইসিএসসি? জেলা খাদ্য নিয়ামকের কথায়, “আপাতত ১০টি শিবির খোলা হয়েছে। অবিলম্বে আরও ৫টি খোলা হবে। ইতিমধ্যে ১৩০টি সমবায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারাও অবিলম্বে নামছে। এ বছরে কিন্তু ইতিমধ্যেই আমরা এক লক্ষ কুইন্টালের বেশি ধান কিনে ফেলেছি। সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ মেট্রিক টন ধান কেনার কথা। তার চেয়ে বেশি কিনতে পারব বলেই আমাদের বিশ্বাস।” |