শিকড়ের টানেই ভরল গ্রন্থাগার
মেয়েকে সঁপে দেওয়ার মুহূর্তে চোখের জল মুছলেন ব্লেয়ার উইলিয়ামস। দেখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাদের সান্ত্বনা, ‘কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়ে আমাদের কাছে দিব্যি থাকবে।’
মঙ্গলবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে এই দৃশ্য দেখা গেল। সিপাহি বিদ্রোহ তথা দেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সমবয়সী গ্রন্থাগারের এ দিন দারুণ প্রাপ্তিযোগ ঘটেছে। অধুনা আমেরিকাবাসী প্রবীণ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান উইলিয়ামস সাহেব তাঁর সংগ্রহের দুষ্প্রাপ্য বইয়ের পুঁজি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারেই উজাড় করে দিলেন।
সপ্তাহব্যাপী আন্তর্জাতিক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুনর্মিলন উৎসব উপলক্ষে শহরে চলছে নানা অনুষ্ঠান। শিকড়ের টানে ঘরে ফিরেছেন ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকার কয়েকশো ইঙ্গ- ভারতীয় নরনারী। উৎসবের স্লোগান বলছে, জন্মভূমিতে ফেরার ডাক। উইলিয়ামসের সংগ্রহের নতুন-পুরনো বই বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে ঠাঁই পাওয়ার মধ্যেও অনেকেই এই ফিরে আসার সুরই খুঁজে পাচ্ছেন। তাঁদের বিশ্বাস, একাধারে ভারতীয় ও ইউরোপীয় পরম্পরার ধারক, দুনিয়াময় ছড়িয়ে থাকা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সমাজ বা মননকে বুঝতে এই সব বই সাহায্য করবে।
‘বন্দে মাতরম’-এর স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়েরও ঢের আগে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের প্রবক্তা হেনরি ভিভিয়ান লুই ডিরোজিও যে আদতে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, তা অনেকেরই খেয়াল থাকে না। ইন্দো-পর্তুগিজ বাবা ও ব্রিটিশ মায়ের সন্তান ডিরোজিও কলকাতায় জন্মেছিলেন। উইলিয়ামসের শ’দেড়েক বইয়ের ভাঁড়ার নিয়ে গ্রন্থাগারটিতে এ বার সেজে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আনকোরা একটি শাখা, যা ডিরোজিও-র নামেই নামাঙ্কিত হল ‘ডিরোজিও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রিসার্চ কালেকশন’। উইলিয়ামস ছাড়াও শহরে আসা ‘ক্যালকাটান’রা অনেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই সংগ্রহটিকে সমৃদ্ধতর করতে এগিয়ে আসছেন। এলিয়ট রোডের মেয়ে, মেলবোর্নবাসী ডরোথি ম্যানুয়েল এ দিনই ‘স্ক্যাটার্ড সিড্স’ নামে একটি প্রবন্ধসংগ্রহ গুটিগুটি জমা দিয়ে গেলেন।
কলকাতায় ফেরা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের নিজের
সংগ্রহ দেখাচ্ছেন উইলিয়ামস। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
রেলের ইঞ্জিনিয়ার, সত্তরোর্ধ্ব উইলিয়ামসের জন্ম চেন্নাইয়ে। সত্তরের দশকে টানা পাঁচ বছর কলকাতায় উঁচু পদে চাকরিও করেন। এখন নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য ও ম্যানেজমেন্ট-বিষয়ক শিক্ষক। কলকাতা বা ভারতকে ভুলতে পারেন না বৃদ্ধ। বলছিলেন, “এ কাল সে কালের এ সব বইয়ে ভারতীয়ত্বের এক ছকভাঙা সংজ্ঞাও উঠে আসবে।”
হলদেটে মলাটের বই বা সুবিন্যস্ত ফোটোকপিতে বন্দি নানা বিষয়। ডিরোজিও বা রাজপুত মায়ের ছেলে, ইঙ্গ-মরাঠা যুদ্ধের সময়কার নায়ক জেমস স্কিনার ওরফে ‘সিকন্দর সাহিব’কে নিয়ে বই আছে। রয়েছে ১৯ শতকের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের নানা বিষয়ে লেখালেখি, বিশ শতকের গোড়ায় ইংরেজি কাগজের নামী কলমচিদের প্রতিবেদন থেকে দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের নিয়ে বিভিন্ন গবেষণাপত্র। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের নিয়ে আদতে ঢাকাই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অ্যাড্রিয়ান গিলবার্টের গবেষণার দলিল সোৎসাহে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাসকে দেখালেন উইলিয়ামস। সুরঞ্জনবাবু তাঁকে বললেন, “আপনার ব্যক্তিগত ক্ষতিটা কিন্তু সমষ্টির লাভ।” তাঁর বিশ্বাস, “এ সব বই অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের নিয়ে যাবতীয় একপেশে ধারণা ভাঙতে সাহায্য করবে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, শাড়িতে সাবলীল ডরোথি চু-ও সে কথাই বললেন। এখন মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক ডরোথি বাংলা শব্দ নির্ভুল উচ্চারণ করেন। উইলিয়ামস ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে তাঁর বড় ভূমিকা।
ঘরছাড়া বা দেশছাড়া মানুষকে বুঝতে বইগুলি সাহায্য করবে। খুলে দেবে নতুন গবেষণার দরজা। উচ্ছ্বাসে ভাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের সারস্বত-সমাজ। “সে তো বটেই! কিন্তু মেয়েকে ছেড়ে আসতে বাপের কষ্ট যাওয়ার নয়!” পড়ন্ত বিকেলে উইলিয়ামস ম্লান হাসলেন।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.