ফুল হাতে আব্দুর রেজ্জাক মোল্লাকে দেখতে হাসপাতালে গেলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। প্রাক্তন মন্ত্রীকে মারধর সমর্থন করেন না বলে জানালেন বর্তমান শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুও। জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সামলানোর চেষ্টায় এই সৌজন্যের আড়ালে রেজ্জাক কাণ্ড নিয়ে কিন্তু আগের অবস্থানেই অনড় রয়েছে তৃণমূল। অভিযুক্ত আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে দলীয় বা প্রশাসনিক স্তরে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। খোদ রাজ্যপাল “রাজনীতিক-সহ কারও উপরেই আক্রমণ সমর্থন করা যায় না” বলে মন্তব্য করার পরেও। উল্টে এ দিনও রেজ্জাককে জোচ্চোর আখ্যা দিয়েছেন আরাবুল। পাশাপাশি, রেজ্জাক ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে প্ররোচনা দেওয়া ও উত্তেজনা ছড়ানোর পাল্টা অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স থানায়। |
রবিবার ঘটনার পরেই আরাবুলকে গ্রেফতার করার জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। সেই সময়সীমা ফুরোচ্ছে আজ, মঙ্গলবার দুপুরে। তার আগের দিনেও আরাবুলের আচরণে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন দেখা যায়নি। এ দিনই ঘটকপুকুরে পুলিশি নিরাপত্তা নিয়ে সভা করে তিনি ফের দাবি করেছেন, “রেজ্জাক সাহেব নিজের জামা ছিঁড়ে, গাড়ির কাচ ভেঙে নাটক করছেন!” বর্ষীয়ান সিপিএম বিধায়ককে ‘জোচ্চোর’ বলতেও ছাড়েননি আরাবুল। রেজ্জাককে মারধর করা হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, “উনি ক্যানিংয়ের ভূমিপুত্র হয়েও সেখানে ঢুকতে পারছেন না। ভাঙড়ে বন্দুক-বোমা নিয়ে মিছিল করেন। প্রশাসন নিষেধ করা সত্ত্বেও উনি কাল কাঁটাতলায় ঢোকেন।” প্রাক্তন বিধায়কের আরও দাবি, “আরাবুল অ্যান্ড কোম্পানি ভাঙড়ে কোনও সন্ত্রাস করেনি!”
তৃণমূল নেতৃত্বের পক্ষ থেকেও আরাবুলকে এ দিন সতর্ক করা হয়েছে বলে কোনও খবর নেই। রাজনীতির কারবারিদের একাংশের ব্যাখ্যা, পঞ্চায়েত ভোটের আগে আরাবুলদের বিরাগভাজন হতে চাইছেন না তৃণমূল নেতৃত্ব।
আরাবুলের দাপট অব্যাহত দেখার পরে সূর্যবাবু এ দিন বলেন, “আমাদের দাবি পূরণ হবে, এমন লক্ষণ এখনও পর্যন্ত নেই। বরং যা দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে না সরকার কোনও ব্যবস্থা নেবে। আক্রান্তের বিরুদ্ধে মামলা করা এই সরকারের সংস্কৃতি! আমরা কাল (মঙ্গলবার) অবস্থানে বসব। যদি না তার মধ্যে অবস্থার পরিবর্তন হয়।” বামফ্রন্ট সূত্রে খবর, ৪৮ ঘণ্টা সময়সীমার মেয়াদ ফুরনোর পরেই আলিপুরে অবস্থানে বসবেন বাম বিধায়ক ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা বামফ্রন্টের প্রতিনিধিরা। তাঁদের সমর্থনে গোপালনগর মোড়ে জমায়েত করবে কলকাতা জেলা বামফ্রন্টও।
তবে রেজ্জাকের উপরে আক্রমণের ঘটনা যে সাধারণ মানুষ ভাল ভাবে নেননি সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। ভাঙড়ের স্থানীয় রাজনীতির অঙ্কে আরাবুলের ডানা ছাঁটা না-গেলেও রাজ্যের বাকি অংশের মানুষকে বার্তা দিতে দলনেত্রীর নির্দেশেই পার্থবাবু এ দিন হাসপাতাল-মুখো হয়েছিলেন বলে তৃণমূলের অন্দরের খবর। |
হাসপাতালের লিফ্টের সামনে প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখোমুখি হয়ে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে পার্থবাবু বলেন, “ক্যাপ্টেন, কেমন আছেন?” দু’জনে একই সঙ্গে লিফ্টে ওঠেন। হাসপাতালের ৯ তলায়, রেজ্জাকের ঘরে পৌঁছে পার্থবাবু প্রথমেই তাঁর কাছে জানতে চান, কেন তিনি পার্টি অফিসে গিয়েছিলেন? তার পর ঘটনার কথা জানতে চান। অসুস্থ রেজ্জাক বেশি কথা বলতে চাননি। পার্থবাবু ঘটনার কথা শোনেন সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রতন বাগচীর কাছ থেকে। সাত মিনিট পরে সেখান থেকে পার্থবাবু উঠে যাওয়ার সময়ে রেজ্জাক কোনও রকমে বলেন, “আরাবুলদের সামলান! সংযত হতে বলুন!” এর পরে চিকিৎসক ও আধিকারিকদের সঙ্গেও ৪৫ মিনিট বৈঠক করেন পার্থবাবু।
পরে হাসপাতাল থেকে বেরনোর সময়ে সাংবাদিকেরা পার্থবাবুকে প্রশ্ন করেন, আরাবুল ও মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম রেজ্জাকের আহত হওয়াকে ‘নাটক’ বলেছেন। তা হলে আপনি এলেন কেন? পার্থবাবু বলেন, “আসতেই পারি।” আরাবুলের দাবি প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে পার্থবাবুর বক্তব্য, “আমি কলকাতার বাইরে ছিলাম। এ সব ঘটনার কিছু জানি না। আরাবুলকে জিজ্ঞাসা করব।”
পার্থবাবুর আগে এ দিন সকালে হাসপাতালে গিয়েছিলেন ‘বিদ্রোহী’ তৃণমূল সাংসদ কবীর সুমনও। রেজ্জাকের ঘরে ঢুকেই কমরেডকে ‘লাল সেলাম’ জানিয়ে শুরু করে বেশ খানিক ক্ষণ কথা বলেন। পরে বলেন, “এই ঘটনায় আমার লজ্জা করছে।” দলীয় সাংসদকে অবশ্য এক হাত নিয়েছেন আরাবুল। তাঁর কটাক্ষ, “উনি এখন সুজন চক্রবর্তী এবং রেজ্জাক মোল্লার বন্ধু হয়েছেন! আমাকে ক্ষমা চাইতে বলছেন। কিন্ত আমি কোনও দোষ করিনি। কেন ক্ষমা চাইব?”
রেজ্জাককে মারধরের ঘটনা তাঁরা কোনও ভাবেই সমর্থন করছেন না বলে জানিয়েছেন শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুও। বহরমপুরে এ দিন তিনি বলেন, “শারীরিক ভাবে কেউ কাউকে আঘাত করছে, তা কোনও ভাবেই সমর্থন করা যায় না, তা সে যেই করুক না কেন।” তবে রবিবারের ঘটনায় তৃণমূলের ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট হওয়ার কোনও কারণই তিনি দেখছেন না। উল্টে তাঁর বক্তব্য, “রেজ্জাক ৭০ বছরের বৃদ্ধ। তিনি কেন যাবেন অন্য দলের মিটিংয়ের মধ্যে?”
কোমর-পিঠের যন্ত্রণায় এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত কাতরাতে দেখা গিয়েছে রেজ্জাককে। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা অবশ্য তাঁকে বাড়ি চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তা শোনেননি তিনি। হাসপাতালের আধিকারিক সুজয় দেব বলেন, “উনি মেডিক্যালি ফিট। আমরা বলেছি, বাড়ি চলে যেতে চাইলে যেতে পারেন। কিন্তু ওঁর বার্ধক্যজনিত সমস্যা রয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কয়েক দিন থাকতে চাইছেন।”
সিপিএমের অবশ্য অভিযোগ, রেজ্জাককে ছেড়ে দেওয়ার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের উপরে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রাক্তন মন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত বলেন, “এ এক হিংস্র বর্বরতা। বিধানসভায় বামপন্থীদের মারধরের পরে সরকারি চিকিৎসা যাতে না করা হয়, সেই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখন বেসরকারি হাসপাতালেও সেই চেষ্টা চলছে।” এই অভিযোগ নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনও মন্তব্য করেননি। পার্থবাবু অবশ্য বলেন, “আমি মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখেছি। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথাও বলেছি। চিকিৎসকেরা ওঁকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। উনি অসুস্থতা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য হাসপাতালে থেকে যেতে চেয়েছেন। ওঁর পরিবারও তাই চায়।”
রাজ্য বামফ্রন্টের বৈঠকে এ দিন রেজ্জাকের উপরে আক্রমণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। শরিক নেতারা বলেন, পঞ্চায়েত ভোট যত এগিয়ে আসবে এই ধরনের ঘটনা বাড়বে। বৈঠকের পরে ফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, “রেজ্জাকের উপরে এমন আক্রমণের পরেও প্রশাসন নির্বাক! বামপন্থী সংগঠনের নেতরা জনগণের কাছে এ ঘটনা তুলে ধরার জন্য কর্মসূচি নিন।” কিন্তু সেই কর্মসূচি যাতে শান্তিপূর্ণ হয়, সে দিকে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দিয়ে বিমানবাবু বলেন, “সরকারের মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদরা যতই প্ররোচনা দিন, বাম কর্মীরা কিন্তু কোনও ভাবেই ফাঁদে পা দেবেন না।” সন্ধ্যায় বামফ্রন্টের নেতাদের নিয়ে হাসপাতালে রেজ্জাককে দেখতে গিয়েছিলেন বিমানবাবু। রেজ্জাককে দেখতে গিয়েছিলেন বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম, কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া, বিজেপি-র তথাগত রায়, পিডিএসের সমীর পূততুণ্ডু, নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায়, ইউডিএফ নেতা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীও।
|