নব্বইয়ের দশকে আর্থিক সংস্কারের অনেক নীতিই মোটামুটি নিঃশব্দে পাশ করিয়ে নেওয়া গিয়েছিল।
আজকের
ভারতে তেমনটা হয়তো আর করা যাবে না। গণতন্ত্রের পক্ষে সেটা সুলক্ষণ। কিন্তু রাজনৈতিক
পক্ষ-বিপক্ষের
শোরগোলে বোধ হয় জরুরি কিছু বিষয় আড়ালে থেকে যাচ্ছে। কোলাহল আর বিতর্ক কিন্তু এক নয়। অচিন চক্রবর্তী |
একটা বছর চলে গিয়ে আর একটা বছর আসার ব্যাপারটা তো এক অর্থে একটা রিলে রেস। তাই নতুন বছরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পৌঁছে এ প্রশ্ন অসঙ্গত নয় যে, ২০১২ তার উত্তরাধিকারীকে কী দিয়ে গেল? আর তা ভাবতে গিয়েই একটা কথা মনে হয়। সেই ১৯৯১ থেকে শুরু করে ছোট-বড়-মাঝারি মাপের সংস্কার ভারতে কম হয়নি, কিন্তু এক ধাক্কায় একগুচ্ছ সংস্কার নীতি বেজায় শোরগোল তুলে বছরের অনেকটা সময় গরম রাখা এমনটা বোধ হয় গত একুশ বছরে ঘটেনি। তাই ২০১২’কে মনে রাখা যায় ‘সংস্কার ঘিরে শোরগোলের বছর’ হিসেবে। অতএব প্রশ্নটা দাঁড়াচ্ছে, অর্থনীতির দিশা নিয়ে নতুন চিন্তার খোরাক কি পেলাম আমরা?
আর্থনীতিক সংস্কারের সাম্প্রতিক পর্যায়ে নীতি-ভাবনার যে নির্যাসটি উঠে এসেছে, তা দেখে মনে হয়, উদ্দেশ্য-বিধেয় যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে। এ বিষয়ে খানিক আলোকপাত করার জন্য অমর্ত্য সেনের কিছুটা সাহায্য নিতে হবে। আর্থিক সংস্কার নিয়ে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তা মোটামুটি এ রকম: কেন্দ্র ঘোষণা করল ক খ গ নীতি। বিরোধীরা বললেন, ক খ গ নীতি নিলে সাধারণ মানুষের সব্বোনাশ হবে, অতএব ক খ গ হতে দেওয়া যাবে না। এই সোজাসরল সাদাকালো ছবিতে চাপা পড়ে যায় ধূসর পাণ্ডুলিপি। ঘ নীতিটি এখনই নিয়ে ফেলা জরুরি ছিল হয়তো, সে দিকে মনোযোগ ফেরার আর ফুরসত হয় না কোনও পক্ষেরই। যেমন, পেনশন কাণ্ডে বিদেশি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা ২৬% থাকবে, না ৪৯%, এই তর্কে কখনও কেউ বলেন না, ভারতবর্ষের প্রায় ৯০% মানুষ পেনশন কাকে বলে জানেন না, গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য বৃদ্ধ বয়সেও খেটে যেতে হয়। সর্বজনীন পেনশনের পক্ষে সওয়াল করতে কোনও দলকেই তেমন দেখা যায় না।
আর্থিক সংস্কারের একুশ বছরের অভিজ্ঞতায় একটা ধারাবাহিকতা দেখি। তা হল, সংস্কারকে ‘নীতি’ হিসেবে দেখা, ‘ন্যায়’-এর প্রশ্নটি আড়ালে রেখে। অমর্ত্য সেন ‘দি আইডিয়া অব জাস্টিস’ গ্রন্থে ‘ন্যায়’ ও ‘নীতি’র পার্থক্য নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। রাজধর্ম কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়ে পুরনো ভারতীয় লেখাপত্রে এমন দু’টি পৃথক ধারণার দেখা পাওয়া যায়। সেখানে ‘নীতি’ মানে প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা এবং মানুষের আচরণ বিষয়ে নির্দিষ্ট নিয়মকানুন। যেমন, মনুসংহিতা কিংবা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র। অথচ শুধুমাত্র নীতি-অনুসারী আচরণ থেকে যে পরিণাম উঠে আসবে, তা যে ন্যায়সঙ্গত হবেই তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। |
‘খুচরো ব্যবসায় বিদেশি সংস্থা নয়।’ কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির
প্রতিবাদে বামপন্থীরা। চেন্নাই, ডিসেম্বর ২০১২। ছবি: পি টি আই |
ন্যায়ের অবশ্য নানা নিরিখ থাকতে পারে। যেমন, সুযোগ ও সম্পদের সুষম বণ্টন। কিংবা সর্বজনীন বুনিয়াদি শিক্ষা বা সুস্বাস্থ্য। যে কোনও ব্যবস্থারই বাস্তব পরিণাম মূল্যায়ন করতে হবে ন্যায়ের নিরিখে, যেহেতু নীতি-অনুসারী হলেই ন্যায় বাস্তবায়িত হল, এ কথা বলা যায় না। অনুসৃত নীতিটি পরিণামের মূল্যায়নে তথ্য হিসেবে আসতেই পারে, কিন্তু তাকেই একমাত্র গ্রহণযোগ্য তথ্য বলে ধরে নিলে ভুল হয়ে যাবে। পরিণামের মূল্যায়ন করতে হবে বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।
আপাত ভাবে এগুলি ফাঁকা কথা বা তাত্ত্বিক কচকচি বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সংস্কার নীতি নিয়ে ঘুরে ফিরে সরকারি বয়ানে যা দেখি, তার সঙ্গে একে সহজেই মেলানো যায়। যেমন, মনে হয় না কি, সেনসেক্সকে ঠেলে তোলাই যেন যে কোনও সংস্কার নীতির মূল্যায়নের একমাত্র মাপকাঠি?
মাস কয়েক আগে অমর্ত্য সেনের একটি কথা নিয়ে বেশ শোরগোল হয়েছিল। দিল্লিতে তিনি বলেছিলেন, ‘কেবলমাত্র আর্থনীতিক বৃদ্ধিকে উন্নয়নের লক্ষ্য করা নির্বুদ্ধিতা’। এখানে ‘নির্বুদ্ধিতা’ শব্দটি এতটাই জোরালো যে মিডিয়া নীরব থাকতে পারেনি। প্রচারিত হল, ‘অমর্ত্য সেন আর্থনীতিক বৃদ্ধিকে উন্নয়নের লক্ষ্য করাকে নির্বুদ্ধিতা বলেছেন’। ‘কেবলমাত্র’ শব্দটি বাদ পড়ে গেল। যেমন বাদ পড়েই থাকে। ডাক্তারবাবু হয়তো বললেন, ‘কেবলমাত্র ভরপেট ভিটামিন খেয়ে গেলেই স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় না।’ পর দিন সংবাদপত্রে দেখা গেল, ‘ডাক্তার অমুক বলেছেন, ভিটামিন স্বাস্থ্যের উন্নতি করে না’। ‘কেবলমাত্র’ কথাটি বাদ দিলে কী হতে পারে, আশা করি বোঝা গেল।
আসলে, গোলমালের মূলে আছে বহুত্ববাদী চিন্তায় আমাদের অনভ্যাস। এক ধরনের ব্র্যান্ডেড বাম ঘরানায়ও দেখি, যে কোনও সংস্কারকেই চোখ-কান বুজে ‘নিয়ো-লিবারাল’ বলে দেওয়া হয়। এলোপাথাড়ি ও বৈষম্যমূলক সরকারি খবরদারি শিথিল করা হলেও ‘নিয়ো-লিবারাল’ সংস্কার বলা হয়, বাজারকে মুক্ত করার নামে বিশেষ শিল্পগোষ্ঠীর সুবিধা করে দেয় যে নীতি, তাকেও ওঁরা ‘নিয়ো-লিবারাল’ তকমা দিয়ে দেন। ধরেই নেন, ১৯৯১-পরবর্তী যাবতীয় সংস্কার যেন মুক্ত বাজারের দর্শনকেই অনুসরণ করে চলেছে। যে কোনও নীতিকে খোলা চোখে বহুমাত্রিক মাপকাঠিতে মূল্যায়নে কোনও পক্ষেরই খুব উৎসাহ দেখি না।
ন্যায়ের ধারণাটি অস্পষ্ট রেখে বিশেষ নীতি নিয়ে একগুঁয়েমি কেমন চেহারা নিতে পারে, তার কিছুটা আভাস পেলাম সুদের হার নিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার গভর্নরের সঙ্গে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর ঠান্ডা লড়াইয়ে। অর্থমন্ত্রীর একবগ্গা দাবি, সুদের হার কমাতেই হবে। কেন? না, সুদের হার চড়া বলে বিনিয়োগ বাড়ছে না, আর বিনিয়োগ বাড়ছে না বলে বৃদ্ধির হার কমছে। এ যুক্তিতে কলেজপাঠ্য টেক্সট বইয়ের সমর্থন হয়তো মিলবে। কিন্তু ওইটুকুই। সুদের হার কমা-বাড়ার সঙ্গে ঋণ নেওয়ার বাড়া-কমার খানিক সম্পর্ক পাওয়া যায়, যদি আনুষঙ্গিক যাবতীয় বিষয় অপরিবর্তিত থাকে। কোনও বাস্তব অর্থনীতিতে কোনও বিশেষ সময়ে বিনিয়োগ বাড়াতে গেলে ঠিক কী কী করণীয়, শুধু এই সম্পর্কের ধারণা থেকে তার কিছুই জানা যায় না। সুদের হার কমলেও বিনিয়োগ না বাড়তে পারে ছত্রিশটা কারণে। তবে সুদ কমলে তার প্রতিক্রিয়ায় শেয়ারের দাম বেড়ে যেতে পারে, এই ফাঁকে যাঁরা মুখিয়ে ছিলেন শেয়ারের দাম বাড়লেই হাতের শেয়ারটা বেচে লাভ ওঠাব ভেবে, তাঁরা বিপুল লাভ পকেটে পুরে ফেলবেন। গোটা প্রক্রিয়াটির সঙ্গে প্রকৃত বিনিয়োগ ও প্রকৃত উৎপাদনের সম্পর্কটি খুব সোজাসাপ্টা নয়। অন্য দিকে, মূল্যস্ফীতি এখন যে অবস্থায় রয়েছে, সুদের হার কমালে তা আবার ঊর্ধ্বগতি অর্জন করতে পারে। আর মূল্যস্ফীতি যে প্রকৃত আয়ের পুনর্বণ্টন ঘটায়, এটা মাথায় রাখলে ন্যায়-ভিত্তিক মূল্যায়নের দিকে এগোনো কঠিন নয়। অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতি আসলে মুনাফাস্ফীতি। আয়বণ্টন ক্রমশ মুনাফার দিকে ঝোঁকে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে ‘সাধারণ’ মানুষের ভারী কষ্ট হয়, রাজনীতিবিদ থেকে টিভি চ্যানেল সবাই এমন মত প্রকাশ করে থাকেন। অ-সাধারণ মানুষদের কী হয় তা বলা হয় না। যেন তাঁরা যথা পূর্বম্ তথা পরম্ থাকেন। তা তো নয়। তামাম জনগণকে যদি দু’ভাগে ভাগ করে ফেলি: সাধারণ (যাঁদের আয়ের উৎস তাঁদের শ্রম) আর অ-সাধারণ (যাঁদের আয়ের প্রধান উৎস মুনাফা), তা হলে দেখব, মূল্যস্ফীতি আসলে আয়ের ভাগাভাগিটা বদলে দেয়। সাধারণের ক্ষতি অ-সাধারণের লাভ হয়ে যায়। তবে এই পুনর্বণ্টনের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ নির্ভর করছে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমের বাজারদর কতটা বাড়ছে তার ওপর।
তা হলেই দেখুন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঋণ নীতি, সুদের হার, অতিরিক্ত লিকুইডিটি, বিনিয়োগ, বৃদ্ধির হার এই সব শব্দাবলি থেকে মূল্যায়নের হাত ধরে কোথায় গিয়ে পড়লাম। গভর্নর আর অর্থমন্ত্রীর মতপার্থক্য আর তাই মুম্বই ও নর্থ ব্লকে সীমাবদ্ধ থাকে না, সর্বজনীন সামাজিক গুরুত্ব পেয়ে যায়।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ লক্ষ্য হিসেবে রাখতে গেলে মনে হয়, সুদের হার কমানোর সময় হয়তো আসেনি। গভর্নরের এই যুক্তির কতটা বাস্তব ভিত্তি রয়েছে, সে তর্কে না ঢুকেও একটা প্রশ্ন তোলা যায়। কী ভাবে জানা গেল, সুদের হার কমানোই অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলার প্রধানতম উপায়? সুদের হারের সঙ্গে প্রকৃত বিনিয়োগ এবং উৎপাদনের সম্পর্ক যে তেমন জোরালো নয় তা আগেই বলেছি। ডিসেম্বরেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি সম্পর্কে বিশদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। সেখানে কোথাও দেখলাম না, ব্যাঙ্কগুলি থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কমেছে। অতীতের তুলনায় বরং বেড়েছেই বলা যায়। ২০০৪ থেকে ’১২ পর্যন্ত দেখছি প্রায় সমহারেই বেড়েছে ব্যাঙ্কঋণের পরিমাণ। আরও আশ্চর্যের বিষয়, ঋণ এবং জমার অনুপাতও (‘ক্রেডিট ডিপোজিট রেশিয়ো’ বা সি ডি আর) বেড়েছে। ২০০৪-এ যা ছিল ৫৯%, ২০১২-এ দাঁড়িয়েছে ৭৮%। এ সব থেকে কি সত্যিই বলা যাচ্ছে, সুদের হার বেশি বলে ঋণ নেওয়া কমেছে? সি ডি আর যেখানে আট বছরের মধ্যে উত্তরোত্তর বেড়েছে, সেখানে সুদের হার নিয়ে অর্থমন্ত্রীর জেদাজেদি ধন্দে ফেলে দেয়।
নব্বইয়ের দশকে সংস্কার নীতি নিয়ে তেমন তোলপাড় হয়েছে বলা যায় না। মনোযোগের সিংহভাগটাই টেনে নিয়েছিল বাবরি মসজিদ আর মণ্ডল কমিশন। বাবরি-পরবর্তী পর্বে সাম্প্রদায়িকতা ও তার বিরোধিতা যে রাজনৈতিক মাত্রা পায়, সেখানে আর্থনীতিক সংস্কার যেন গৌণ স্থানে সরে এসেছিল। ফলে সংস্কারের অনেক নীতিই শোরগোল ছাড়াই পাশ করিয়ে নেওয়া গিয়েছিল। বিশ্লেষকরা যাকে বলেছেন ‘চুপিসাড়ে সংস্কার’। ২০১২-তে এসে দেখছি, তেমন চুপিসাড়ে হয়তো সংস্কার আর করা যাচ্ছে না। কিন্তু রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের শোরগোলে বোধ হয় জরুরি কিছু বিষয় আড়ালে থেকে যাচ্ছে। পরিপূর্ণ সামাজিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার অনুশীলনই বিষয়গুলিকে আলোচনার পরিসরে অন্য মাত্রা দিতে পারে।
|
ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা’য় (আই ডি এস কে) অর্থনীতির শিক্ষক |