নিয়ম অনুযায়ী গ্রামসভা হয় বছরে এক বার। বছরে দু’বার হয় গ্রাম সংসদ সভা। পঞ্চায়েত এলাকার সব ক’টি গ্রাম সংসদ সভা শেষ হওয়ার পর হয় গ্রামসভা। গ্রামসভায় মোট ভোটারের অন্তত ১০ শতাংশ উপস্থিত থাকাটাই নিয়ম। যদি সভায় ওই শতাংশ প্রতিনিধি উপস্থিত না হন, তা হলে কোরাম হয় না। ফলে ফের মুলতুবি সভা ডাকতে হয়। সভা মুলতুবি করতে গেলে ৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। এই মুলতুবি সভাতেও কোরাম না হলে, ফের গ্রাম সংসদ সভা ডাকতে হয়। গ্রামসভায় প্রতিটি গ্রাম সংসদ থেকেই ভোটাররা আসেন। পঞ্চায়েতের নিয়ম অনুযায়ী গ্রাম সংসদ সভায় মূলত ছ’ মাসের আয় ও ব্যয়ের হিসাব, কোন খাতে কত টাকা এসেছে ও খরচ হয়েছে তা ভোটারদের জানাতে হয়। এ ছাড়াও, আগামী দিনে এলাকায় উন্নয়নের পরিকল্পনা নেওয়া, উপস্থিত সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযোগও শোনা হয়। |
লাল কাপড়ের ফেস্টুন থেকে মাইকের চোঙ, বাউল গান থেকে ঝুমুর-টুসুও ছিল। কিন্তু যাঁদের জন্য সভা, দেখা গেল না তাঁদেরই। সোমবার এমনই দৃশ্য দেখা গেল দামুডি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে ভালুবাসা পঞ্চায়েতের গ্রামসভায়।
বেলা ১২টা: সারি দিয়ে পাতা কয়েকটা লাল চেয়ার। সামনে ফাঁকা জমি। গেটের বাইরে উদ্বিগ্ন মুখে কয়েক জন পঞ্চায়েত কর্মী দাঁড়িয়েছিলেন। সাংবাদিককে দেখেই এগিয়ে এলেন তাঁরা। কিন্তু লোক কই? পঞ্চায়েত সচিব রাধানাথ মাহাতো বললেন, “গ্রামের মানুষ একটু দেরি করে বেরোয়। খাওয়াদাওয়া সেরে সবাই ঠিক হাজির হবেন।”
সাড়ে বারোটা: দাঁড়িয়ে কত ক্ষণ আর গল্প করা যায়। একটু বসলে হত না? সাংবাদিকের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সবাই চেয়ারে বসলেন। খানিক পরে আরও কয়েকটা লাল রঙের চেয়ার ঘাড়ে করে হাজির পঞ্চায়েত প্রধান সিপিএমের নরেন কালিন্দী। হেসে বললেন, “কাছেই তো বাড়ি। তাই নিজেই নিয়ে এলাম কয়েকটা চেয়ার। যদি কম পড়ে!” তত ক্ষণে উপপ্রধান অম্বুজ চর্মকার এক যুবককে সঙ্গে নিয়ে মাটির উপর ত্রিপল বেছাতে শুরু করেছেন। প্রধান বললেন, “সভায় ২০১১-২০১২ অর্থবর্ষের আয়ব্যায়ের হিসেব পেশ, ২০১৩-২০১৪ সালের বাজেট পেশ এবং ২০১৩-১৪ সালের বার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হবে। অক্টোবর মাসে ভালুবাসা পঞ্চায়েতের ৯টি সংসদ থেকে উঠে আসা প্রস্তাবিত প্রকল নিয়ে আলোচনা ও প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হবে। আজ অনেক কাজ।” পঞ্চায়েতের বিরোধী দলনেতা তৃণমূলের জহরলাল মাহাতো সভার হাজিরা খাতায় সই করে বেরিয়ে গেলেন। যাবার সময় ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনি দিয়ে বললেন, “সবই তো বোঝেন। এখানে বিরোধীদের থাকা না থাকা দুই-ই সমান।” প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করবেন না? “আগে তো গান-বাজনা শেষ হোক”— বলেই সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিলেন।
|
দুপুর সওয়া দুটো: গুটি গুটি কিছু লোক এসেছেন। গুনে দেখা গেল ১৭ জন। তার মধ্যে ১২জনই কচিকাঁচা। কড়া-মিঠে রোদে ওরা তখন ত্রিপলের উপর এক্কাদোক্কা খেলায় মেতে উঠেছে। খানিক পরে মাদল ঝুলিয়ে এলেন বাজনদারেরা। বেজে উঠল মাইক। সভা নিয়ে আগাম প্রচার হয়নি নাকি? পঞ্চায়েত কর্মী কার্তিক মাহাতো বললেন, “গ্রামসভার দিন ক্ষণ ৯টি সংসদেই ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। লিফলেটও ছড়িয়েছি। প্রচারে এতটুকুও ফাঁক রাখিনি।” সিপিএমের কৃষক নেতা চাপাতি সংসদের শ্রীরাম মাহাতো বলেন, “শুধু আলোচনা হলে হবে? গ্রামসভাকে জমিয়ে তুলতে টুসু ও ঝুমুর প্রতিযোগিতার আয়োজনও করা হয়েছে। একটু দেরি হলেও দেখবেন অনেকেই আসবেন।” এক যুবক সভার বাইরে থাকা লোকেদেরও সই-টিপছাপ নিচ্ছিলেন। এ ভাবে কি সভার খাতায় স্বাক্ষণ নেওয়ার নিয়ম? ওই যুবকের চকিত জবাব, “ওঁরা তো সভাতেই এসেছেন। এখন রোদ পোহানোর জন্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন।” পৌনে চারটে পর্যন্ত সভার হাজিরা খাতায় সই পড়ল ১২৯ জনের। বিকেল চারটে: সভা থেকে খানিকটা দূরে দামুড়ি গ্রামের মুসলমান পাড়ায় বাড়ির সামনে খাটিয়ায় বসেছিলেন আব্দুল মান্নান। সভায় যান নি কেন? পাল্টা প্রশ্ন তাঁর, “কী হবে গিয়ে? আমাদের কথাই তো ওরা শুনবে না। আমাদের পাড়ার রাস্তা পাকা হবে বলেছিল। হয়নি। পান গুমটি দোকানি সহদেব মাহাতো বলেন, “গ্রামসভা হবে বলে জানতাম না। কবে ঢোল পেটালো?” বিকেল পাঁচটা: তখনও চলছে বাউল গান। এর পর রয়েছে টুসু-ঝুমুর প্রতিযোগিতা। সভা তখনও প্রায় ফাঁকা। সাকুল্যে জনা ৩৫ জন। আর সভার বাইরে আরও ৩০ জন। ডাহা সংসদের সদস্য তৃণমূলের রাধিকা মাহাতো চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। প্রধান নরেনবাবুকে বললেন, “বাড়ি ফিরতে অনেকটা পথ যেতে হবে। সঙ্গে পাঁচ বছরের ছেলে রয়েছে। ঠান্ডা লাগছে।” প্রধান বললেন, “তা হলে আর ঠান্ডা লাগিও না। বাড়ি যাও।” রাত আটটা: পঞ্চায়েতের সচিব ফোন। জানালেন গ্রামসভা হয়েছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব পেশ, প্রকল্পের অনুমোদন ও ২০১৩-১৪ এর বাজেট পেশ হয়েছে।” সভাস্থলে তো ৩০০ জন লোকের বসার জায়গাই নেই। কোরাম হল কি করে? সচিবের দাবি, “কোরাম তো হয়েছে। আসলে মানুষের ধৈর্য খুব কম। তাঁরা এসেছেন, চলে গিয়েছেন। পরে আরও লোক এসেছেন। এ ভাবেই সব কাজ হয়েছে।” ঘটনার বিবরণ শুনে মানবাজারের বিডিও সায়ক দেব খানিক ক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “হুম শুনলাম।’ |