ময়দানি শীত
ন ভাল নেই মনসুর মিঞার।
মন্দা চলছে ময়দানে ছ্যাকড়া গাড়ির বাজার। বছরে শীতের হাওয়াতেই যা ব্যবসার বড়দিনটা আসে। গত কয়েক বছর ধরেই এ কলকাতায় সেই শীত আসি আসি করেও আসে না। পৌষমাস অর্ধেক কাবার হতে চলল, শীতের জাঁকের দেখা মিলেছে এই মোটে দিনচারেক। আর সেই চঞ্চলা শীতের দিকে তাকিয়েই প্রার্থনা করেন বোড়ালের বেলুনওয়ালা ক্ষুদিরাম পাইন, এসো মা লক্ষ্মী বোসো মা লক্ষ্মী...।
বাঙালির শীতের লক্ষ্মী ক্রমে চঞ্চলা হয়ে শহরজুড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছেন, হয়ে উঠছেন ‘বার’মুখী। শীতের পিপাসা এখন আকণ্ঠ মেটানো চলে বড়দিন বা নিউ ইয়ার ইভে। তবু মধ্যবিত্তের ঘরের লক্ষ্মীর মতো ময়দানি শীত আজও জমজমাট। হেমন্তকে আর ছোঁয়াই যায় না এ শহরে। তাই হুল্লোড়ের শরত্‌-শেষে ফের সেই গা-জ্বালানো গরম। তার পরে হঠাত্‌, শ্রীপান্থর কল্পনামতো, ‘কঙ্কাবতী’র সেই আকাশ-চুনকাম-করা কোনও ভুতিনী মাসি শূন্য থেকে ভাঁড় উজাড় করে হিম ঢেলে দেয় ময়দানের ঘাসে ঘাসে। আর তখনই, কুয়াশার চাদরটি সরিয়ে ময়দানে জেগে ওঠে অন্য এক কলকাতা।
ওই তো, পশ্চিমের রাস্তাটা ধরে হাঁটতে বেরিয়েছেন হুতোমের সেই অমর বাবুটি, মাথা থেকে পা অব্দি মন্‌কি ক্যাপ, কমফরটার, অলেস্টার ঢাকা-চেহারা দেখলে মনে হয় বাবু যেন মেরু অভিযানে চলেচেন। ও দিকে পাশ দিয়ে ঘন্টি বাজিয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে চলে গেল ভোরবেলাকার ট্রাম। হাত-উনুন নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেছেন আম শহরের পথিকদের গলা-ভেজানো চা-ওয়ালারা। একটু পরেই আলো ফুটবে জোরদার। শুরু হবে কুস্তির প্যাঁচ। ও দিকে, আর একটু আলো ফুটলে, ক্রিকেট। কখনও বা ফুটবল। শীতের কলকাতার ময়দানে এ ভাবেই নানা খেলায় গড়িয়ে চলে হেলাফেলা সারাবেলা। আর রোদ্দুরে পিঠ রেখে কিংবা ছায়া দেওয়া বৃদ্ধ বনস্পতির তলায় বসে সে খেলা দেখার মেজাজ-মৌতাতও জানে এই এক ময়দানই। যেখানে বাধ্য ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছোটরা। লাগামটা না হয় ধরা থাকলই সহিসের হাতে, মনে যে ছুটছে আনন্দের পাগলা ঘোড়া!
তবে কি না, গঙ্গা দিয়ে জল গড়িয়েছে অনেক। ময়দানের মুকুট থেকে খসে গিয়েছে অনেক আনন্দের পালক। এ ময়দানেই একদিন সার্কাস বসত। তা দেখতে এসেছিলেন এমনকী শ্রীরামকৃষ্ণও। শ্রীম লিখছেন, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ আজ গড়ের মাঠে উইলসনের সার্কাস দেখিতে যাইতেছেন। মাঠে পৌঁছিয়া টিকিট কেনা হল আট আনার অর্থাত্‌ শেষ শ্রেণীর টিকিট। ভক্তরা ঠাকুরকে লইয়া উচ্চস্থানে উঠিয়া বেঞ্চির উপরে বসিলেন। ঠাকুর আনন্দে বলিতেছেন, বাঃ এখান থেকে বেশ দেখা যায়। রঙ্গস্থলে নানারূপ খেলা অনেকক্ষণ ধরিয়া হইল। গোলাকার রাস্তায় ঘোড়া দৌড়িতেছে। ঘোড়ার পৃষ্ঠে এক পায়ে বিবি দাঁড়াইয়া। আবার মাঝে মাঝে বড় বড় লোহার রিং। রিং-এর কাছে আসিয়া ঘোড়া যখন রিং-এর নীচে দৌড়িতেছে, বিবি ঘোড়ার পৃষ্ঠ হইতে লাফ দিয়া রিং-এর মধ্য দিয়া পুনরায় ঘোড়ার পৃষ্ঠে আবার এক পায়ে দাঁড়াইয়া। ঘোড়া পুনঃ পুনঃ বন বন করিয়া ঐ গোলাকৃতি পথে দৌড়াইতে লাগিল...।’
সে সার্কাস আর নেই। দূষণের ময়দানবের হাত থেকে বাঁচতে দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে ময়দান বিদায় দিতে পেরেছে বইমেলা-সহ নানা মেলাকেও। তবু কলকাতার ফুসফুসে আবর্জনা, প্লাস্টিক আর রাজনীতির সংক্রমণ এড়ানো যায়নি। না যাক, শীতের শহরের যখন মাঝে মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে তখন তার হারিয়ে যাওয়ার সেরা ঠিকানা বোধহয় এই ময়দানই। খেয়ালখুশির হাত-পা মেলা সুখের এবং শখের শহরটাকে এমন করে মাঠে নামাবে আর কে!
উইকি-ইতিহাস বলছে, পলাশীর যুদ্ধ শেষ হলে গোবিন্দপুর গাঁয়ের ঠিক মাঝখানে নতুন ফোর্ট উইলিয়ম গড়া শুরু করল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। গ্রামবাসীরা উচ্ছেদ হলেন, পুনর্বাসন পেলেন তালতলা, কুমোরটুলি আর শোভাবাজারে। বছর পনেরো পরে নতুন গড় যখন তৈরি হয়ে উঠল তখন চৌরঙ্গী আর গঙ্গার মাঝে ময়দানজুড়ে নাকি ছিল ঘন জঙ্গল। এবং সে জঙ্গলে বাঘও নাকি বেরোত।
আজও বেরোয়। নরম দুপুর পেরিয়ে বিকেল যখন চুপি চুপি ছড়িয়ে যায় তখন। ভালবাসার বাঘ। আঁখির আঠায় জড়িয়েছে বাঘ, নড়ে বসছে না...।
কিন্তু না, সন্ধে নামবে এ বার, নড়তেই হবে। রাতে নিরাপদ নয় বিখ্যাত রাজধানী, কলকাতার এ হৃদয়পুরও।

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.