চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
অন্ধকার পেরিয়েই আভাসিত জীবনের নতুন উত্তরণ
নেক শিল্পীই তাঁর সারা জীবনের সাধনায় রূপের বা ফর্মের এক বিশেষ আদল গড়ে তোলেন। এর ভিতর তাঁর নিজস্ব জীবনবোধের সারাৎসার যেমন সংহত থাকে, তেমনই থাকে তাঁর আইডেন্টিটি বা রূপবোধের আত্মপরিচয়। সেই ‘রূপ’ তাঁর যাপিত জীবন ও সময়ের নির্যাস থেকে গড়ে ওঠে। আমাদের আধুনিক চিত্রকলায় ১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের মধ্যে রবীন মণ্ডলের ছবিতে সেই ‘আইডেন্টিটি’ অত্যন্ত স্পষ্ট এবং বলিষ্ঠ। তাঁর সময়ের নিহিত তমসাকে শিল্পী পরিস্ফুট করেছেন আদিমতার সংক্ষুব্ধ অভিব্যক্তি দিয়ে। ক্রমান্বয়ে সেই অন্ধকারকে মন্থন করেই তিনি বের করে এনেছেন এক আলো। আঁধারজারিত সেই আলোতেই আভাসিত হয় জীবনের এক উত্তরণ।
বিড়লা অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি ৯৪টি ছবি নিয়ে অনুষ্ঠিত হল তাঁর পূর্বাপর প্রদর্শনী। রবীন মণ্ডলের প্রথম একক প্রদর্শনী হয়েছিল কলকাতাতেই ১৯৬২ সালে। সেই প্রদর্শনীর সুবর্ণজয়ন্তীর সঙ্গে মিলে গেল এ বারের পূর্বাপর। পূর্বাপর বলা হলেও এখানে তাঁর সব পর্বের কাজ নেই। কিন্তু তাঁর মূল প্রবণতা ও দর্শন খুব ভাল ভাবেই অনুধাবন করা যায় এই প্রদর্শনী থেকে।
ইউরোপের শিল্পকলায় আধুনিকতা থেকে আধুনিকতাবাদে উত্তরণের পথে আদিমতা একটি বিশেষ শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এক্সপ্রেশনিজম ও কিউবিজম বিকাশের ক্ষেত্রে এ কথা বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য। আদিমতার এই অন্তর্লীন ও অন্তর্মুখী শক্তিকে আমাদের দেশে ছবিতে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চল্লিশের শিল্পকলায় লৌকিকও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা হিসেবে কাজ করেছে। যামিনী রায় ছিলেন এর প্রধান এক পূর্বসূরি। রবীন মণ্ডলের একান্ত নিজস্ব রূপের অভিজ্ঞানের মধ্যেও খুব প্রচ্ছন্ন ভাবে অনুভব করা যায় রবীন্দ্রনাথ ও যামিনী রায়ের উত্তরাধিকার।

শিল্পী: রবীন মণ্ডল
১৯৫০ ও ১৯৬০-এর অনেক শিল্পীই সামাজিক সংকট ও আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব থেকে তাঁদের ছবিতে তীব্র প্রতিবাদী অভিব্যক্তি গড়ে তুলেছেন। রবীন মণ্ডলের রূপকল্পও জেগে উঠেছে ব্যক্তিগত বিষাদ ও সামাজিক অবক্ষয়ের দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে। প্রবহমান বাস্তবের ধারাভাষ্য রচনা করেননি তিনি। গড়ে তুলেছেন এক দৃশ্য-প্রতীক। মানব বা মানবী অবয়বকে দুর্মর ভাবে ভেঙে সৃষ্টি করেছেন সেই রূপকল্প বা ‘মেটাফর’, যার ভিতর সংহত হয়েছিল সময় ও বাস্তবতার পুঞ্জীভূত অন্ধকার।
যেমন তাঁর ‘রাজা’ সংহত ক্ষমতার এক বিষাদক্লিষ্ট প্রতীক। সেই ক্ষমতার দম্ভ থেকে তাকে বারবারই সিংহাসনচ্যুত হতে হয়। ১৯৭৬-এর ‘কিং ডিথ্রোনড’ ছবিটিতে সেই করুণ ট্র্যাজেডি পরিস্ফুট হয়েছে। অভিষেকের পরেও স্বস্তিতে থাকেন না সেই রাজা। ১৯৭৫-৭৬-এর ‘কিং আফটার করোনেশন’ ছবিতে দেখি রাজার মাথার উপর নেমে আসছে যেন কাঁটার মুকুট। দণ্ডায়মান সেই যন্ত্রণাকাতর রাজারূপী মানবের পদতলে শিল্পী স্থাপন করেছেন একটি মহিষের ছিন্নমুণ্ড। এই মুণ্ডটির গঠনে কিউবিজমের ব্যবহার লক্ষণীয়। অশুভের প্রতীক সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভয়ার্ত মানুষ। হিংসা ও ক্ষুধায় বিধ্বস্ত এই বিশ্বের পুঞ্জীভূত তমসাকে এ রকমই প্রতীকে রূপায়িত করেছেন শিল্পী। ‘orgy’ শিরোনামে পাঁচটি ছবি আছে এই প্রদর্শনীতে। একটি ১৯৮৭-র। বাকিগুলি ২০১১-১২-র। সমগ্র মানবিক পরিস্থিতির তীব্র সংকট ও আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব প্রতীকায়িত হয়েছে এই ক্যানভাসগুলিতে। ১৯৮৭-র ছবিটিই দেখি। বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে নগ্ন মানব-মানবী পরস্পরকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। এরই মধ্যে এক মানবীর হাতে রয়েছে একটি ফুল। অমানিশার মধ্যেও উজ্জীবনের সংকেত রাখেন শিল্পী।
এই মানবপ্রতিমাই আবার দেবত্বে বা দেবীত্বে রূপান্তরিত হয়। ২০০৬-এর ‘ডিটি’ ছবিটিতে আদিমতার অনুষঙ্গের প্রতিমাকল্পই অনেকটা সুষমায় সরলীকৃত হয়েছে। দ্বিমাত্রিক উপবৃত্ত থেকে গড়ে উঠেছে মুখ। আর শরীর চতুর্ভুজাকৃতি। আদিমতা লৌকিক সারল্যের দিকে গেছে। অন্ধকার জারিত করা আলোর ইঙ্গিত ধরা থাকে তাঁর ‘স্টিল লাইফ’ ছবিগুলিতেও। সাদা-কালোর ড্রয়িং-এ সুনিপুণ বুনোটের সাহায্যে গড়ে তোলা মানবীপ্রতিমাতেও উদ্ভাসিত হয় অন্ধকারের আলো। তমসামথিত এই আলোই মানবতার প্রতি শিল্পীর শ্রেষ্ঠ উপহার।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.