|
|
|
|
জমে থাকা ক্ষোভ আছড়ে পড়ল সরকারের দরজায় |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
তাহরির স্কোয়ার! রোজকার চেনা বিজয় চকে দাঁড়ালে এ দিন ওই নামটাই মনে পড়তে বাধ্য।
রাইসিনা হিলসের চেহারাটা প্রায় দুর্গের মতো। রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়ার রাস্তায় নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লকের মুখেই সার দেওয়া লোহার ব্যারিকেড। পিছনে জলকামান, ভ্যান, বাসের সারি ভেদ করে ছুঁচ গলারও উপায় নেই। সেই সঙ্গে পুলিশ আর পুলিশ। আর পুলিশের সংখ্যা ছাপিয়ে গোটা বিজয় চক জুড়ে হাজার হাজার মানুষ। অধিকাংশই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুলের ছাত্রছাত্রী। তাদের হাতেই কার্যত ঘেরাও হয়ে রয়েছে ভারতের ক্ষমতার মসনদ।
এটা শুধু একটা ঘৃণ্য ধর্ষণের প্রতিবাদ নয়। শুধু পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে মুখ খোলা নয়। ন্যায়বিচারের দাবিতে পথে নামা নয়। বরং বৃহত্তর নাগরিক সমাজের বহু দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এক মত আমজনতা থেকে সমাজতত্ত্ববিদ।
রবিবারের ঘটনার পর গত ছয় দিনে প্রতিবাদের উত্তাপ বেড়েছে ধাপে ধাপে। সোমবারই প্রথম রাস্তায় নেমেছিলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। ক্রমে তা আরও তীব্রতা সঞ্চয় করেছে। গত কালই রাইসিনার দরজায় পৌঁছে গিয়েছিল প্রতিবাদ। আজ রাইসিনা থেকে বিজয় চক হয়ে ইন্ডিয়া গেট পর্যন্ত গোটা রাজপথ কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে থেকেছে। |
প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর আইনের দাবি তুলে
পুলিশের লাঠির মুখে। নয়াদিল্লির বিজয় চকে। শনিবার। ছবি: পিটিআই |
বছর কয়েক আগে জেসিকা মামলা নতুন করে চালু করার দাবিতে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দেখেছিল দিল্লি। কিন্তু সেটা মূলত নীরব মোমবাতি মিছিলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আজকের বিজয় চক বরং অনেককেই গত বছরের যন্তর মন্তর বা রামলীলা ময়দানে অণ্ণা হজারের দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনকে মনে করিয়ে দিয়েছে। সেখানেও সামগ্রিক ভাবেই সরকারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জমতে থাকা ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। কিন্তু সেখানেও একটা নেতৃত্ব ছিল, অরাজনৈতিক হলেও ছিল। অণ্ণার আন্দোলনের জন্য অরবিন্দ কেজরিওয়াল-কিরণ বেদীদের দীর্ঘ দিনের প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু এ বারের আন্দোলন সম্পূর্ণতই স্বতঃস্ফূর্ত অনেকটা রিজওয়ানুরের মৃত্যুর পর কলকাতা বা নন্দীগ্রামের ঘটনার প্রতিবাদে নাগরিক সমাজের মিছিলের মতো। সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দীর কথায়, রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরের আন্দোলনই ইদানীং সবচেয়ে বেশি জোরদার হতে দেখা যাচ্ছে। কারণ, সরকার বা বিরোধী দল কারও প্রতিই মানুষের কোনও আস্থা নেই।
রাস্তায় নামা ছাত্ররা বলছেন, পথেঘাটে মহিলাদের হেনস্থা নিয়ে ক্ষোভ ছিলই। তার সঙ্গে এখন অন্যান্য বিষয়েও জমে থাকা হতাশা উগরে দিচ্ছেন মানুষ। টিভিতে পুলিশকে লাঠি চালাতে দেখে আরও অনেকে ছুটে আসছেন। সরকার আজ যে ভাবে আন্দোলন দমন করতে চেয়েছে, তাতে মানুষের ক্ষোভ আরও বেড়েছে। আশিসবাবুর কথায়, “বেশ কয়েক বছর ধরেই দিল্লিতে হিংসাত্মক ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। মানুষ কোনও প্রতিকার পায়নি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সার্বিক দুর্নীতি নিয়ে ক্ষোভ।” প্রথমে শুধু পুলিশি ব্যর্থতার বিরুদ্ধে স্লোগান উঠেছিল। তার সঙ্গে এখন আইনশৃঙ্খলার অব্যবস্থা, দুর্নীতি, বিচারে ঢিলেমি, সরকারি পরিষেবার অভাব সব কিছুর বিরুদ্ধে ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে বিজয় চকে।
একটা ঘটনা যে এত বড় স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠতে পারল, তার জন্য ঘটনাটার নিজস্ব ভূমিকাটাকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন সমাজতত্ত্ববিদ দীপঙ্কর গুপ্ত। তিনি মনে রাখতে বলছেন, “ওই ছাত্রীটি কোনও ধনী পরিবারের সন্তান নয়। বাবা-মা জমি বিক্রির টাকায় তার বিয়ে না দিয়ে তাকে পড়াশোনা করতে দিয়েছেন। মেয়েটির উপরে আক্রমণ যেখানে হয়েছে, সেটা শহরের কোনও নির্জন, প্রত্যন্ত এলাকা নয়। সবেমাত্র রাত ন’টা বেজেছিল। এবং সম্ভবত কেউই এখনও পর্যন্ত কোনও ভাবেই বলে উঠতে পারেননি যে, মেয়েটির কোনও বেশবাস-আচরণ তথাকথিত ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে বেমানান ছিল।” কলকাতার পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডে যে ভাবে নজর ঘুরে গিয়েছিল ধর্ষিতার ‘চরিত্র’ বিশ্লেষণে, এখানে সেটা করা যায়নি। নইলে দিল্লির আদালতে জমা হয়ে থাকা হাজার খানেক ধর্ষণ মামলার ভিড়ে হারিয়ে যেতে পারত এই ঘটনাটাও।
|
প্রতিবাদের রাজধানী। বিস্তারিত... |
• ভারতে এক জন মহিলার চেয়ে কসাবের নিরাপত্তা বেশি!
• দিল্লিতে শুধু তিন
মহিলা নিরাপদ সনিয়া, সুষমা আর শীলা।
• মিস্টার পিএম, কিছু বলুন। মানুষ অপেক্ষা করছে।
• যে সংসদে ধর্ষকরা জায়গা পায়, তার কাছে কী আশা করব?
• এ দেশে আইনি প্রক্রিয়াটাই অত্যন্ত মন্থর!
• আমরা পুলিশের কাছে যেতেও নিরাপদ বোধ করি না। |
|
এমন নৃশংসতার কথা কল্পনাও করতে পারি না। যত বারই ওই ঘটনার কথা ভাবছি, তত বারই রাগে শরীর জ্বলছে।
সোহা আলি খান |
|
মানবতার প্রতি এত বড় অপমান, এটা সত্যিই কয়ামতের দিন। এখনই ব্যবস্থা নেওয়া না হলে সেটা জাতির লজ্জা।
এ আর রহমান |
|
আজকের আধুনিক শহরে এমন ঘটনা, ভাবা যায় না। মেয়ে হিসেবে ওর যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছি।
মেরি কম |
|
আজ রাইসিনা হিলসের মুখেই ব্যারিকেড তৈরি করেছিল পুলিশ। তবু শনিবার সাতসকাল থেকেই ভিড় জমতে শুরু করে। ইন্ডিয়া গেটে প্রথমে জমায়েত হয়। সেই ভিড়টাই সোজা রাজপথ ধরে চলে আসে বিজয় চকে। সারাদিন কোথাও হাতে পোস্টার নিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে, গান গেয়ে, স্লোগান দিয়ে অবস্থান-বিক্ষোভ চলেছে। মনমোহন থেকে শীলা দীক্ষিত, প্রণব মুখোপাধ্যায় থেকে রাহুল গাঁধী কেউই রক্ষা পাননি তার আঁচ থেকে। রাষ্ট্রপতিকে লেখা খোলা চিঠিতে জানতে চাওয়া হয়, “আপনি কি জানেন যে, এ দেশে প্রতি ২২ মিনিটে একটা ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে? আমরা সবাই বিজয় চকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি।” স্লোগান উঠেছে, ‘সারা দিল্লি ইধার হ্যায়, শীলা দীক্ষিত কাঁহা হ্যায়?’ প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রী পদে রাহুল গাঁধীর যোগ্যতা নিয়ে। মনমোহনের জন্য অপেক্ষা করেছে কটাক্ষ, “মিস্টার পিএম, কিছু বলুন!” ক্ষোভ ঠিকরে পড়েছে গোটা সংসদের উপরেই! মহিলাদের উপরে নিযার্তনের অভিযোগ মাথায় নিয়েও যে সংসদের সদস্য হওয়া যায়, সেই সংসদ কী সুরক্ষা দেবে? প্রশ্ন তুলেছেন প্রতিবাদীরা। দিল্লিরই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সমীক্ষা বলছে, গত পাঁচ বছরে এই ধরনের অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও শতাধিক প্রার্থী ভোটে লড়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৩০ জনের বিরুদ্ধে সরাসরি ধর্ষণের অভিযোগই রয়েছে।
এই সমস্ত ক্ষোভ বুকে নিয়েই বিক্ষোভকারীরা দিনভর কখনও ছুটে গিয়েছেন বিজয় চকের এক প্রান্তে সংসদ ভবনের দিকে। কখনও ব্যারিকেড ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছেন। কারণ জেসিকা-প্রিয়দর্শিনী মাট্টু-নীতীশ কাটারা-আরুষি-নিঠারি একের পর এক নৃশংস ঘটনার বিচার পেতে কত সময় গড়িয়েছে, গড়াচ্ছে, সেটা তাঁদের চোখে দেখা। চোখে দেখা, কী ভাবে আম-আদমিকে উপেক্ষা করে পুলিশের একটা বড় অংশকে কাজে লাগানো হয় ভিআইপি-দের নিরাপত্তায়। খোদ দিল্লির পুলিশ কমিশনার নীরজ শর্মাও বিষয়টা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাই এ দিন বারবার আওয়াজ উঠেছে ‘এখনই বিচার চাই’, ‘হয় দোষীদের ফাঁসিতে ঝোলাও, নয় আমাদের’। এগিয়ে এসেছে র্যাফ ও পুলিশ বাহিনী। সারা দিনে অন্তত সাতবার লাঠি চালানো হয়েছে। জবাবে পাথর, জুতো, জলের বোতল ছুটে গিয়েছে পুলিশকে লক্ষ করে। দিল্লির দশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় জলকামানের প্রবল গতির ঠান্ডা জলও সেই আগুন নেভাতে পারেনি।
এখানেই প্রমাদ গুনছেন রাজনীতির কারবারিরা। তাঁদের মনে হচ্ছে, আজ এটা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আন্দোলন। আগামিকাল বিজেপি-ও এই আন্দোলনের মুখে পড়তে পারে। বিরোধী দলের আন্দোলন সামাল দেওয়া সহজ। কারণ সেখানে একটি নির্দিষ্ট দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলা যায়। এখানে সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের শান্ত করার চেষ্টা করলেও তাঁরা ইন্ডিয়া গেটে ফিরে গিয়ে ঘোষণা করে দেন, শনিবার সারা রাত তাঁরা বিজয় চকে বসে থাকবেন। রবিবার আরও ভিড় বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জেএনইউ-এর ছাত্রছাত্রীরাই রবিবার সকাল ১১টায় নতুন করে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। পুলিশ কাল ইন্ডিয়া গেটের আশপাশের চারটি মেট্রো স্টেশনে ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখছে।
|
মৃত্যুদণ্ড নিয়ে
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
যৌন নির্যাতনের বিরলতম ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড নিয়ে কেন্দ্র ভাবনাচিন্তা করছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে। এই বিষয়ে ফৌজদারি দণ্ডবিধি সংশোধন করা নিয়ে শীঘ্রই উদ্যোগী হবে কেন্দ্র।
|
হবে কমিশন
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
রাজধানীতে গণধর্ষণের ঘটনার তদন্ত করতে ১৯৫২ সালের তদন্ত কমিশন আইন অনুযায়ী কমিশন গড়বে কেন্দ্রীয় সরকার। শনিবার এ কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে।
|
দেখা করলেন সনিয়া |
শনিবার মধ্য রাতের পরে নিজের বাসভবনের বাইরে এসে সনিয়া গাঁধী দেখা করলেন বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে। মাটিতেই বসে পড়ে প্রায় ২০ মিনিট কথা বললেন। আশ্বাস দিলেন, নির্যাতিতা তরুণী ন্যায়বিচার পাবে। রবিবার সকালে অন্য বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে দেখা করবেন বলেও জানিয়েছেন সনিয়া। |
|
|
|
|
|
|
|