এ যেন কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কুমির। জঙ্গি সংগঠন ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম)-এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ভিন রাজ্যের এক বাসিন্দার ফোনে আড়ি পাততে গিয়ে মোবাইল ফোন সেট সরবরাহকারী একটি জালিয়াত সংস্থার হদিস পেলেন কলকাতার গোয়েন্দারা। আইন অনুযায়ী একটি আইএমইআই নম্বরে একটির বেশি মোবাইল সেট থাকার কথা নয়। কিন্তু এই সংস্থাটি কোনও মোবাইল সেটের নিজস্ব পরিচয়সূচক (আইএমইআই) নম্বর জাল করে একই নম্বরের অসংখ্য ফোন বাজারে ছেড়েছে। গোয়েন্দাদের কথায়, এই ধরনের জালিয়াতি দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বড় হুমকি।
শুক্রবার রাতে কলকাতা পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের অভিযোগের ভিত্তিতে কলকাতা পুলিশের সাইবার ক্রাইম থানা একটি মামলা রুজু (এফআইআর নম্বর ৬৯) করেছে। ভারতীয় দণ্ডবিধি ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলাটি রুজু করা হয়েছে। আইএমইআই নম্বর জালিয়াতির ক্ষেত্রে এই রাজ্যে পুলিশের রুজু করা মামলা এ-ই প্রথম।
কেন্দ্রীয় সরকারের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক বার বার বলে আসছে, ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি নম্বর জাল করে ওই একই আইএমইআই নম্বরের অসংখ্য ফোন সেট দেশের বাজারে ছাড়ছে কয়েকটি অসাধু সংস্থা। বিএসএনএল সূত্রের খবর, বিষয়টি জানিয়ে টেলি যোগাযোগ মন্ত্রককে চিঠি দিয়েছে এসটিএফ। সেই সঙ্গে বিএসএনএল এবং কয়েকটি বেসরকারি সার্ভিস প্রোভাইডারের সঙ্গে লালবাজারে বৈঠকও করেছেন গোয়েন্দারা।
কলকাতার টেলিকম এনফোর্সমেন্ট রিসোর্স অ্যান্ড মনিটরিং-এর ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল অতনু ঘোষ বলেন, “এসটিএফের চিঠি পেয়েছি। ব্র্যান্ডেড নয়, এমন মোবাইল ফোনের সেটেই সাধারণত আইএমইআই নম্বরের ক্লোনিং হচ্ছে। তবে পুলিশকে এই ধরনের কিছু সেট আগে বাজেয়াপ্ত করে আমাদের দিতে হবে। কিছু দিন আগে আমরা কলকাতায় মাত্র এক দিনের নমুনা সমীক্ষা করে এই ধরনের প্রায় ৮০০ মোবাইল সেটের সন্ধান পেয়েছিলাম।” বর্তমানে কলকাতা ও তার আশপাশে প্রায় চার কোটি মোবাইল সেট চালু রয়েছে। তার মধ্যে কোনগুলি জাল আইএমইআই নম্বর নিয়ে চলছে, সেটা দেখতে জানুয়ারি থেকে টেলিকম দফতর নিয়মিত অনুসন্ধান চালাবে বলে অতনুবাবু জানিয়েছেন।
আঙুলের ছাপের মতোই পৃথিবীর প্রতিটি মোবাইল সেটের ১৪ বা ১৫ সংখ্যার নিজস্ব আইএমইআই নম্বর থাকার কথা। গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশনস (জিএসএম) অ্যাসোসিয়েশন-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি বিভিন্ন মোবাইল প্রস্তুতকারক সংস্থাকে আইএমইআই নম্বর দেয়। সে জন্য মোবাইল ফোন প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিকে ব্যয়ভারও বহন করতে হয়। কিন্তু পুলিশের বক্তব্য, কয়েকটি জালিয়াত সংস্থা সমস্ত রকম ধরাছোঁয়া বা নজরদারির বাইরে থাকতে ও খরচ বাঁচাতে আইএমইআই নম্বরের ‘ক্লোন’ করে হাজার হাজার সস্তার মোবাইল ফোন সেট বাজারে ছাড়ছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী মিলিন্দ দেওরা সংসদে জানিয়েছেন, একটি আইএমইআই নম্বর দিয়ে ১০০-র বেশি মোবাইল ফোন সেট চলছে, এমন নথিভুক্ত ঘটনার সংখ্যা ২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ৭৪৯টি। আর শুধু চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত এ ধরনের ৫৬৯টি ঘটনার কথা মন্ত্রক জেনেছে।
গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রের খবর, মাস দুয়েক আগে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এসটিএফ কর্নাটকের এমন এক জনের খোঁজ পায়, যার সঙ্গে এই রাজ্যেরও কয়েক জন সন্দেহভাজনের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। আরও তথ্য পেতে তাঁর মোবাইল সেটের আইএমইআই নম্বর জোগাড় করে এসটিএফ, যাতে ওই মোবাইলে যে-সব সিম ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলি জানা যায় এবং আড়ি পাতা ও কল ডিটেল রেকর্ড জোগাড় করা যায়। কিন্তু গোয়েন্দারা দেখেন, ওই একটি মাত্র আইএমইআই নম্বরে একই সঙ্গে অন্তত ৮২টি সংযোগ বা ৮২টি সিমের হদিস পাওয়া যাচ্ছে, যা কার্যত অসম্ভব। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে গোয়েন্দারা বুঝে যান, ওই আইএমইআই নম্বরে অন্তত ৮২টি ফোন বাজারে চালু আছে। শুধু তা-ই নয়, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা দেশের প্রায় সর্বত্রই ওই মোবাইল সেটগুলির অবস্থান।
গোয়েন্দা বিভাগের এক অফিসারের বক্তব্য, “এই কাজ শুধু জালিয়াতি নয়, দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বিপজ্জনক। এ রকম চললে কে জঙ্গি আর কে নিরীহ মানুষ, সেটা মোবাইল ফোনে নজরদারি চালিয়ে ধরা মুশকিল হবে। আর সুযোগ নেবে জঙ্গি সংগঠনগুলি।”গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, চিনে তৈরি আইএমইআই নম্বর-বিহীন মোবাইল সেট এ দেশে এনে চেন্নাইয়ের একটি সংস্থা তাতে প্রকৃত কোনও আইএমইআই নম্বরের ক্লোন ভরে বিক্রি করছে। তবে এই অভিযোগে কোনও সংস্থার নাম উল্লেখ করা হয়নি।
|
আইএমইআই বৃত্তান্ত |
• ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি নম্বর
• *#06# টাইপ করলে সেটের আইএমইআই নম্বর মিলবে
• প্রতিটি সেটের আলাদা নম্বর
• ডুয়াল সিমের দু’টি নম্বর |
|