|
|
|
|
|
|
|
নদীর তৃতীয় তীর |
হোয়াও গুইমারেইস রোজা
ব্রাজিল |
বাবাকে আর পাঁচটা লোকের চেয়ে বেশি উচ্ছল বা বিষণ্ণ বলে কখনও মনে হয়নি। অন্যদের তুলনায় তিনি হয়তো একটু বেশি চুপচাপ, শান্ত ছিলেন। বাড়ি শাসন করতেন, বাবা নন, আমাদের মা। এক দিন হল কী, আমার বাবা একটা নৌকা তৈরির বায়না দিয়ে বসলেন। বিশেষ করে তাঁরই জন্য মিমোসা কাঠে তৈরি করতে হবে নৌকা। এমন শক্তপোক্ত করতে হবে যাতে সেটা কুড়ি-তিরিশ বছর সহজেই টিকে থাকতে পারে। নৌকাটার আয়তন হবে এক জনের শোয়া-বসা আর থাকার জন্য যথেষ্ট। মা ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শেষে কি তাঁর স্বামী হঠাৎ মাছধরা জেলে হয়ে যাবেন? না কি শিকারি? বাবা এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দেননি। নদীটা ছিল আমাদের বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে। এত গভীর, শান্ত আর চওড়া ছিল যে এ-পার থেকে ও-পার প্রায় দেখাই যেত না।
যে দিন নৌকাটা তৈরি হয়ে এল, বাবা আনন্দ বা দুঃখ কোনও আবেগই প্রকাশ করলেন না। শুধু তাঁর টুপিটা পরে নিলেন, আর আমাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলেন। সঙ্গে কোনও খাবার বা ঝোলাঝুলি নিলেন না। আমরা ভেবেছিলাম মা হয়তো খুব চেঁচামেচি কান্নাকাটি করবেন। কিন্তু তিনি সে রকম কিছুই করলেন না। তাঁকে খুব ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। ঠোঁট কামড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শুধু বললেন, ‘যদি চলেই যাও, তা হলে দূরেই থেকো। কখনও আর ফিরে এসো না।’ বাবা এ কথারও কোনও উত্তর দিলেন না। খুব শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন আর হাত নেড়ে তাঁর সঙ্গে যেতে বললেন। আমরা দু’জন নদীর দিকে চলতে শুরু করলাম। আমি বললাম, ‘বাবা, আমাকে তুমি তোমার সঙ্গে ওই নৌকায় নেবে?’ উনি আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন, তার পর হাত নেড়ে ফিরে যেতে বললেন।
বাবা আর ফিরে এলেন না। অথচ তিনি যে সত্যি-সত্যিই দূরে কোথাও চলে গেলেন তাও নয়। উনি শুধু উন্মুক্ত নদীর বুকে ওই নৌকায় ভেসে ভেসে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। আমাদের সব প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন বাড়িতে এসে ব্যাপারটা নিয়ে প্রচুর আলোচনা করল। সবাই ভাবল বাবার মাথা নিশ্চয়ই খারাপ হয়ে গেছে। কেউ বলল, তিনি ঈশ্বরের কাছে কোনও মানত করেছিলেন, সেটাই পালন করছেন। অথবা তাঁর হয়তো ভয়ংকর ছোঁয়াচে রোগ হয়েছে, হয়তো কুষ্ঠ, পরিবারের লোকজনদের তাঁর ছোঁয়া থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি সরে গেলেন। |
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
নদী বেয়ে যারা যাতায়াত করে এবং নদীর দুই পারে যারা থাকে, তাদের কাছ থেকে জানা গিয়েছিল, বাবা কখনও তীরে নামতেন না, দিনেও না, রাতেও না। শুধু নদীর বুকে ঘুরে বেড়াতেন, একা, এলোমেলো উদ্দেশ্যহীন, যেন একটা ভেসে আসা অর্থহীন আবর্জনা। মা এবং আত্মীয়রা সবাই একমত হলেন, যেটুকু খাবার উনি নিঃসন্দেহে নৌকার ভিতর লুকিয়ে রেখেছিলেন, শিগগির ফুরিয়ে যাবে আর তখন তাঁকে হয় নদী ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে হবে (যেটা বোধহয় একটু বেশি সম্মানজনক) অথবা অনুতপ্ত হয়ে ঘরে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু বাবার খাদ্যের একটা গোপন সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল আমি। প্রতি দিন বাড়ি থেকে খানিকটা খাবার চুরি করে নদীর ধারে একটা ঢিবির খোঁদলে রেখে আসতাম। দিনের পর দিন। পরে আমি জানতে পারি, আর খুব অবাক হই, আমার কার্যকলাপ মা সবই জানতেন। যেখান থেকে খাবার চুরি করতাম, সেখানে তিনি ইচ্ছে করেই খাবার রেখে দিতেন।
বাবা আর কোনও জীবিত ব্যক্তির সঙ্গে কোনও বাক্যালাপ করলেন না, আর আমরাও তাঁর সম্বন্ধে কোনও আলোচনা করা বন্ধ করে দিলাম। আমরা শুধু মনে মনে তাঁর কথা ভাবতাম। আমার বোনের বিয়ে হয়ে গেল। মা চাইলেন না বিয়েতে কোনও জাঁকজমক হোক। পুরো অনুষ্ঠানটাই ছিল বিষণ্ণতায় ছাওয়া। কারণ, যে কোনও সুস্বাদু খাবার মুখে দিয়ে আমরা সারা ক্ষণই তাঁর কথা মনে করছিলাম। যেমন ভাবে শীতের বা ঝড়-বৃষ্টির রাতগুলোতে উষ্ণ আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে আমরা তাঁর কথা চিন্তা করতাম ওই খোলা আকাশের নীচে, একা, আশ্রয়হীন, তিনি হয়তো তাঁর ছোট্ট নৌকাটাকে খালি হাতে কোনও মতে প্রকৃতির রোষের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
বাবার আমাদের প্রতি কোনও টান আছে বলে মনে হত না। কিন্তু তা হলে ওই ভাবে আমাদের কাছাকাছি থাকার মানে কী? তিনি কেন নৌকা নিয়ে উজানে বা মোহনার দিকে কোথাও চলে যান না, যেখানে আমাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আর কোনও সম্ভাবনা থাকবে না অথবা তাঁকেও আমাদের দেখার কোনও সম্ভাবনা থাকবে না? একমাত্র তিনিই এই ধাঁধার জবাব দিতে পারবেন।
আমার বোন আর ভগ্নীপতি এখান থেকে তাদের বাসা উঠিয়ে অনেক দূরে চলে গেল। ভাইও বাড়ি ছেড়ে শহরবাসী হল। শেষ পর্যন্ত আমার মা-ও এই বাড়ি ছেড়ে, বোনের কাছে থাকবেন বলে চলে গেলেন। আমি শুধু পিছনে পড়ে রইলাম, উচ্ছিষ্টের মতো। কোনও দিনই বিয়ের কথা ভাবতে পারিনি। তাই এই জায়গাটাতেই আমার জীবনের বোঝা আঁকড়ে পড়ে রইলাম। আমার বোঝা আমার বাবা, যিনি ওই নদীর বুকে ত্যক্ত নিঃসঙ্গ ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর আমাকে দরকার। যদিও তিনি আমাকে তাঁর এই কাজের কোনও ব্যাখ্যাই কখনও দেননি, তবু আমি জানি যে তাঁর আমাকে দরকার। আমার শুধু একটা প্রশ্ন, আমি ঠিক কী অন্যায় করেছিলাম? আমার ভয়ানক অপরাধটা কী? এই যে আমার বাবা সব সময় আমার থেকে বহু দূরে, আর তাঁর সেই অনুপস্থিতিটা সারা ক্ষণই আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে আছে। আর এই যে নদীটা বয়ে চলেছে বিরামহীন ভাবে আর বারে বারে নতুন করে ভরে নিচ্ছে নিজেকে। এই নদীটা চিরটাকাল। আমি ক্রমে জরাগ্রস্ত হয়ে পড়তে লাগলাম। নাছোড় বাতের ব্যথা আমাকে প্রায় পঙ্গু করে দিল। আর তিনি? কেন, কেন তিনি এই সব করছেন? এত বয়স হয়ে গেছে তাঁর। এক দিন দুর্বল অক্ষম হাতে তিনি হয়তো আর নৌকাটা সামলাতে পারবেন না, হয়তো সেটা ডুবে যাবে। এই ছবিটা আমার মনে পাষাণের মতো চেপে বসছিল। তিনি ওই উন্মুক্ত নদীর বুকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর আমি চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলতে বসেছি মানসিক শান্তি। জানি না আমার অপরাধটা কী, আর এই কষ্টটা যেন আমার মনের ভিতর একটা হাঁ-মুখ ক্ষত। শেষ পর্যন্ত হয়তো উত্তরটা খুঁজে পাব, যদি ব্যাপারটা একটু অন্য ভাবে দেখি। যেন খানিকটা বুঝতে পারছিলাম গোলমালটা কোথায়।
সব কিছু ঝেড়ে ফেলতে হবে। আচ্ছা, আমি কি শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যাচ্ছি? না, এই শব্দটা আমাদের বাড়িতে কখনও ব্যবহার করা হত না। কেউ কাউকে কক্ষনও পাগল বলত না, অবশ্য পাগল কেউ ছিলও না। অথবা হয়তো সবাই পাগল ছিল। আমি শুধু নদীর ধারে গিয়ে একটানা রুমাল নাড়তে লাগলাম। হঠাৎ দেখি অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি নৌকায় পিছন দিকে কুঁজো হয়ে বসে আছে। আমি অনেক বার ডাকলাম। আর যত জোরে পারি চিৎকার করে বললাম: ‘বাবা, তুমি ওই খোলা আকাশের নীচে বহু বহু দিন রয়েছ। এখন তোমার বয়স হয়েছে তুমি এ বার ফিরে এসো। তোমাকে আর ওই কাজ করতে হবে না... তুমি ফিরে এসো তোমার জায়গায় আমি যাব এখনই, বা যখন তুমি চাইবে, তখনই।’
কথাগুলো বলে ফেলে আমার শরীরে যেন আবার শক্তি ফিরে এল, হৃদ্স্পন্দন স্বাভাবিক হল। উনি আমার কথাগুলো শুনতে পেলেন। উঠে দাঁড়ালেন। ধীরে ধীরে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলেন। তার মানে, উনি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন। হঠাৎই আমার শরীরের গভীরতম প্রদেশ থেকে একটা কাঁপুনি উঠে এল। কারণ, উনি হাত তুলে আমার দিকে নাড়তে শুরু করেছেন বহু বহু দিন পরে, বহু বহু বছর পরে। কিন্তু আমি আমি পারলাম না ভয়ে আমার শরীরের সব লোম খাড়া হয়ে উঠল। ছুটতে শুরু করলাম। উন্মাদ ভয়ে পালিয়ে গেলাম। ওঁকে তখন আমার মনে হচ্ছিল যেন কোনও অন্য গ্রহ থেকে আসা মানুষ। আর এখন আমি ক্ষমা চাইছি সত্যিই ক্ষমা ভিক্ষা চাইছি।
মরণভীতি থেকে যে রকম ভয়ানক হাড়হিম শীতলতা টের পাওয়া যায়, তা-ই পেলাম। অসুস্থ হয়ে পড়লাম। কেউ আর কখনও বাবাকে দেখেনি বা তাঁর কথা শোনেনি। এ রকম শোচনীয় ব্যর্থতার পরও নিজেকে মানুষ বলে ভাবা যায়? আমি জানি যে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু যখন মৃত্যু আসবে, আমি চাই, সবাই যেন আমাকে তুলে ওই ছোট্ট নৌকাটায় শুইয়ে দেয়, আর ভাসিয়ে দেয় ওই চিরন্তন জলের প্রবাহে, দুই দীর্ঘ পারের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া জলস্রোতে, আর আমি সেই স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে, সেই জলের ঘূর্ণিপাকে তলিয়ে যেতে যেতে, নদীর গভীরে ডুবে যেতে যেতে ওই নদীর গভীরে- |
(সংক্ষেপিত)
অনুবাদ সৌম্যশঙ্কর মিত্র |
|
|
|
|
|