|
|
|
|
|
|
|
একলা খেপু |
লাগাতার মশকরা সহ্য না করতে পেরে এক জন দুই সহকর্মীকে গুলি করলেন।
তা বলে তো আর খ্যাপানোর দুরন্ত মস্তি বন্ধ রাখা যায় না! চন্দ্রিল ভট্টাচার্য |
যাশ্শালা, খ্যাপাব না? এই স্ট্রেসপূর্ণ জিন্দেগিতে আনন্দ-মোয়া পাকাব না? তোতলা ছোঁড়া দেখলে জিগাব না, ‘ক্ক-ক্ক-ক্কী রে, ক্ক-ক্ক-ক্কী খবর’? বুকহীন মেয়েছেলে দেখলে ‘ম্যানচেস্টার’ চিক্কুর কাটব না? বুড়ো প্যাসেঞ্জার লেডিজ সিটের সামনে খাড়া থাকলে হাঁকব না, ‘কী দাদ্দু, ইঞ্জিন এখনও চালু?’ কুচ্ছিত মেয়ে ফুসুরফুসুর প্রেম করছে দেখলে ছুড়ব না, ‘অ্যা বাবা, মুখ না পাছা’? কেন বাওয়া? তুমি মজা নিতে পারো না, তোমার সেন্স অব হিউমারে ল্যাক, সেই জন্যে আমরা রোয়াকে বসে পলিটিকাল কারেক্টনেসের সিরাপ চুষব কেন? এ জিনিস নিয়ানডার্থাল যুগ থেকে চলে আসছে, তোর মুগুর পলকা তো টন্ট খাবি হালকা। আমাদের পাড়ায় বামন ভিখিরি এসে যেই ছাগলের মতো গলা কাঁপিয়ে ভিক্ষে চায়, ডবল কমিক কাঁপা গলায় সব জানলা থেকে রিটার্ন। যে মাতাল রাস্তায় গড়গড়, বাচ্চাদের ডেকে আমাদের ডিরেকশন, শালার মুখে মুতে দে। এ তো হবেই বাপু। অনেক মানুষ মিলে একলা মানুষকে অপমান করার মস্তি, উয়াঃ, গ্রুপ-সেক্সের দেড়া। সেই জন্যেই গলির ল্যাম্পপোস্টে চোর বেঁধে ন্যাড়া করা হচ্ছে হচ্ছে শুনে লুঙ্গি খসাতে খসাতে দৌড়। সেই জন্যেই হাফ-ল্যাংটো পাগলকে ত্যানা টেনে ফুল-ল্যাংটো করার খিলখিলিয়া ভিড়। অ্যাকচুয়ালি, ক্ষমতার মেঠাই ইহা: সংখ্যায় বা গাত্রজোরে জিতছি জেনে হেরো, অসহায়, লেবড়ে-যাওয়া, পিতপিতে পাবলিকের পেছনে সপাটে ক্যাঁৎ, সঙ্গমরত কুকুর-কুকুরীর জয়েন্ট যৌনাঙ্গে ঠাটিয়ে আধলা, কলেজের শিডিউল কাস্ট বন্ধুকে রসিয়ে ‘সোনার চাঁদ’। হিহি। ওই দ্যাখ ঘা বেয়ে পুঁজ। নোতরদামের কুঁজ। খ্যাখ্যাখ্যা। খেপ্পু খেপুয়া খেপচন্দর, বিষ চোঁয়াব তোর অন্দর, ফুঁসবি ঠুসবি সেন্টুমেন্টু পুষবি, বাথরুমে ঢুকে গরম কান্না চুষবি। খ্যাপানো, সব শিল্পের মতোই, অনেক প্রকার। কিছু ডোজ কঠিন শূল, কিছু মাইল্ড বিছুটিফুল। সবচেয়ে কমন তো চলতিফিরতি মেয়েদের বুক পাছা নিয়ে টোন কাটা, যত টাইট গেঞ্জি, তত ক্ষীর! তবে, এর চেয়ে বাহাত্তর গুণ জমাটি: প্রতিবন্ধীকে খ্যাপানো। ওঃ, মাইরি, পৃথিবীতে আসবে হাত-পা-চোখ-কান ছাড়া, হাঁটতে চলতে ধ্যাড়ান্তি মেরে অগা-চাউনি, আবার নেকু আবদার: আমরা-ওরা একই ডিমের চাট্টি কুসুম! হোস্টেলে পড়তাম, একটা মিনমিনে অন্ধ ছেলেকে প্রতি রোববার এক বন্ধু ফাটফাটি ক্যালান দিত। আচমকা এ দিক থেকে চুল টানছে, তক্ষুনি ঘুরে গিয়ে উলটো দিক থেকে টেনে থাবড়া, পেছনে ছুটে কষিয়ে গাঁট্টা। অন্ধটা একেবারে হাঁকপাঁক, শেষে ঠোঁটে কষ গড়িয়ে চিৎকার। তার পর লাফিয়ে উঠে হাওয়ায় আনতাবড়ি বাঁইবাঁই। হাঃ, কার্টুন, পাগলা জগাই! তবে অন্ধ তো আর হরদম মিলবে না, মন চাঙাতে দুরন্ত টার্গেট: পাগল, ভিখিরি, মাতাল। পাগলাগুলো তো শালা জন্মেইছে খ্যাপানি খেতে। পুঁটলি টান মেরে বড় রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিলেই, ফায়ার! একটা পাগলি ছিল, শাড়ি দাও গামছা দাও, কিচ্ছু দিয়ে ঢাকবে না, মাল সারা দিন কমপ্লিট উদোম। পাবলিক নুইসেন্স। তা ঠা-ঠা দুপুরে ওর ওইখানটা টিপ করে সবাই মিলে কুচি কুচি ঢিল ছোড়া হবে না? তখন সে কী জন্তুর মতো গুঙিয়ে কান্না, যেন আমরাই নোংরামির জাসু! এই ২৬ নভেম্বর, কালনার সহজপুর গ্রামে, জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসানের সময়, ধীরেন হেমব্রম নামের পাগলটা হাঁসুয়া নিয়ে চাতুর হেমব্রমের ওপর চড়াও হয়ে এলোপাথাড়ি কোপের পর কোপ। পালায়নি, একটা মাঠে চুপ বসে ছিল। পুলিশে ধরার পর বলল, সবাই ওকে খ্যাপাত, কিন্তু চাতুর একেবারে জিনা হারাম করে দিয়েছিল, দেখলেই ঢিল ছুড়ত, ধাক্কা দিত, ভয় দেখাত। তাই খুন, বদলা। উদ্ভট মাইরি। তুই পাগলা, তোকে পটাং পটাং ঢিল মারবে না তো কি জিলিপি খাওয়াবে? আরও একটা ঘরানা আছে, আসলি টেস্ট ম্যাচ, বহুত হাইটে মজা-চবচব, বোলে তো ওটাই রিয়েল আর্টিস্টিক খ্যাপানো: একটা এমনি লোককে, ভালই শার্ট-টার্ট পরা, পাগলাও নয় ছাগলাও নয়, কিন্তু কেমন শালা বেচারা টাইপ একটা পিকুলিয়ার নাম ছাপ্পা লাগাও, আর গাঁতিয়ে টার্গেট করো। রোজ, মিলিটারি ডালকুত্তার ডিসিপ্লিনে, সকাল-বিকেল শালাকে খেপিয়ে তাতাও। মাকড়াটা প্রথমে বুঝবেই না, হচ্ছেটা কী। কেন রদ্দা? |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
কিছু দিনের মধ্যেই কুচকুচে সমঝ: ত্রাণহীন ট্র্যাপে পড়েছে, পালাবার এঁদোগলি ভি নেই। বাড়িতে সে বাপ, স্বামী, কাকু। এ দিকে বাজার করতে বেরলেই মুরগি, হো-ও-ও খোরাক। কোত্থেকে আওয়াজ উড়ে আসবে, কে পাঁচশো চিনি ওজনের সময় জিভের তলায় নিক-নেম মালিশ মারবে, রেগেমেগে অ্যাই চিল্লালেই কোত্থেকে দাউদাউ কোরাসে আকাশ-বাতাস-ক্যারমবোর্ডময় প্যাঁক শুরু মালটা থই পাবে না। যে কোনও মানুষ আসে যায়, অফিস করে, গ্রিলের বারান্দায় রাত্তিরে সিগারেট ফোঁকে, তার একটা বেসিক সম্মান আছে, বখেড়া না বাধলে সেই মানটাকে কেউ ছ্যাঁদা করে না। কিন্তু এই বাছাই লোকগুলোর সিম্পল সিম্পল বাঁচার রোদ্দুর-ছায়াগুলো আমরা সিকনির রুমালের মতো মুচড়ে ড্যালা। তুমি শুয়ার পটল কিনতে গেলেও আওয়াজ খাবে, অফিস গেলে তোমার টিপিনবাক্স রোজ লোপাট হয়ে যাবে, তোমার বউয়ের ডাকনামের সঙ্গে প্লাস দিয়ে একটা টেরিফিক অসভ্য কথা তোমার টেবিলে কম্পাস দিয়ে দাগানো থাকবে। পুড়কিটা ফাটফাটি! লোকটা সমাজের নিচু-নোংরা-ন্যাংটা নয়, দিব্যি গেরস্থ, কিন্তু স্রেফ আমাদের ডিসিশনে হড়াক্সে তার জীবনটা খাক। স্লাইট আঁচে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তোমায় সেঁকব চাঁদু। তুমি ছুটি নাওনি, তোমার সি.এল. দরখাস্ত জমা পড়ে গেল। তুমি বাথরুম ঘুরে এসে দেখলে, চেয়ার ভর্তি গুটখার থুতু, সবাই মন দিয়ে ফাইল দেখছে। তুমি নিজের চুল মুঠো করে হিঁচিয়ে টানবে, কষ্টপিন্ডি গিলে গিলে গলগণ্ড পাকাবে, তবু বুঝতে পারবে না, কেন, কেন তুমিই, কী অপরাধে দণ্ডিত, কেন তোমার প্রতিটি ঘণ্টা মিনিট অভিশাপের বাচ্চা হয়ে বাঁচবে। কেন তোমার ঘাড়েই ঠকাস আছড়াবে এঁটো চপের টুকরো। দোষটা কিন্তু আমাদের নয় ভাই। তুমি নর্মাল হলেই এ সব হত না। কেজি ক্লাসেও তো ভেকু-ভেকু ছেলেকে অন্যরা ঘেঁটি ধরে থুতনি ঠুকে দেয় বেঞ্চে। ডাইরির পাতা ছিঁড়ে দেয়। দেবেই বাবা। নেচারের ধর্ম। মিসফিটকে ঠোকরানো হবে। এবং সেটাই তো উচিত। তুমি শালা বেঁটে গুড়গুড়ে হবে আর তোমায় নাটাচন্দর ডাকা হবে না? তুমি ব্যাটা ট্যারা হবে আর তোমায় দেড় ব্যাটারি বলা হবে না? তোমার পাছা এক্সট্রা উঁচু হবে আর তোমায় ‘ডেঁয়ো’ বুলানো হবে না? এগুলো সমাজের ভাল কাজ, নর্মালকে জয়-জয়কার করিয়ে, অ্যাবনর্মালকে খুঁচিয়ে রক্ত বের করে দেওয়া। তোমার গলতি, এবং বাড়তি অ্যাট্রাকশন: দেখতে-শুনতে তুমি নর্মাল, কিন্তু কিছু একটা সিগন্যাল বিপবিপ: তুমি আসলে তারকাটা। কই অমিতাভ বচ্চনকে তো কেউ মুরগি করছে না? তুমি সবার কাছে রেপ হচ্ছ মানে শিয়োর তোমার মধ্যে কোথাও ‘আয় রেপ কর’ ব্যাপারটা ছিল। আমরা তো বাপ বিশ্রাম নেব না, আমাদের আমোদ-তেষ্টা তো ক্লান্তিহীন, প্রেম করতে বসে চাট্টি ঘাস ছেঁড়ার সাইড-সুখের মতো আমরা তো ঘুরুফিরু নিরীহকে ধামসাব থ্যাঁতাব প্লেজার নেবই, আমরা তোমায় বক দেখাব বেড়াল ডাকব তোমার টাক নিয়ে খোঁটা দেব তোমার আত্মহত্যার অ্যাটেম্প্ট নিয়ে রসিকতা কাটব তোমার মেয়ের টিউশন-স্যর নিয়ে ছড়া বানাব তোমার নাক খোঁটা আর গোল্লা পাকানো নকল করব। আর এই নাগাড় খ্যাপানো থেকেই জন্ম নেবে এই নিশ্চিত ধারণা যে তোমায় খ্যাপানো যায়, যার ভাই-ধারণা: তোমায় খ্যাপানোই উচিত। অন্তত, খুব অনুচিত নয়, কারণ সকলেই তো করছে। এই ভাবনার গুঁড়ো তার পর ডানা নেবে আমাদের ব্যাচ থেকে পরের ব্যাচে, নতুন কলিগ, নতুন ছাত্র, নতুন বাচ্চা, সবাই মুখস্থ মারবে, একে ‘কটা বাজে?’ শুধোলেই উদ্দাম রগড়। তুমি খাওয়ার টেবিলে রুটি পাকিয়ে স্ট্যাচু হয়ে যাবে তুমি মাঝরাতে বাথরুমে উঠে ঘাড়ে-মাথায় জল থাবড়াবে তুমি বাচ্চার মুখে ‘ওরা তোমায় হেগো বলে চেঁচিয়ে ডাকল কেন বাবা’ শুনে ভাববে এক্ষুনি কেন চড়চড় করে ফেটে যাচ্ছে না এই আকাশ রেললাইন কারখানা ধরিত্রী সূর্য তুমি চুল আঁচড়াবার সময় বুকের মধ্যে কেঁউকেঁউ পশুর আর্তনাদ শুনবে: আজ, আবার, আজকেও আবার, রোজ বছরের পর বছর আবার, আরও, তার চেয়ে চ ডাক ছেড়ে পালাই পেপারওয়েট ছুড়ি কাচ ফাড়ি। কিন্তু কিছুই করতে পারবে না, কারণ এখেনে না হয়েছে খুন না রাহাজানি, অকলুষ ইয়ার্কি-পানে এত রক্ত-আঁখ হানার কী আছে? পাত্তা না দিলেই হয়। তুমি খ্যাপো, তাই আরও খ্যাপায়। তবে বাছা, ভিলেন কে? আমরা পকেটে হাত দিয়ে ক্রিকেট রগড়াব পাড়ায় রক্ত দেব মড়াকে কাঁধ, আর কল্পনাগ্রাফে ছোট্ট মশার মতোও গুনগুনাবে না এই খ্যাপানোই, প্রতিরোধহীন একা-কে গরম শিক খুঁচিয়ে নিরাপদ আনন্দ পোয়ানোর প্রবণতাই ১০ দিয়ে গুণ করলে র্যাগিং, ছেলেটাকে নড়া ধরে ‘খা বাল্বে চকাস চুমু’, আর ২৩৭ দিয়ে গুণ করলে আবু ঘ্রাইব, কয়েদিটাকে নিজের পায়খানা খাইয়ে ‘কী বে, টেস্টি?’ তার পর, এক চমৎকার দুপুরে, একলা-খেপুয়া কখনও গায়ের জোরে বিশাল খ্যাপ-পঞ্চায়েতের সঙ্গে পারবে না জেনে, এক জন তোমার মুদ্রাদোষ নকল করে দেখাবে আর বলবে, ‘জানেন চ্যাটার্জিদা কাল চিড়িয়াখানার বাঁদরটা কীরম করছিল? অ্যাই, অ্যাই দেকুন, ঠিইক অ্যাইরম’, আর অমনি তুমি ঠিকরে উঠবে মুখে গয়ের তুলে চ্যাঁচাবে খ্যাঁচাবে চেয়ার উল্টোবে ‘কী বললি শালা’ তড়পাবে আর সব্বাই হাততালি দেবে ঠোঁট চকাবে চোখ মারবে কনুই গোঁতাবে, হর্রা ছড়িয়ে পড়বে সিলিং কার্নিশ খোলা নালাময়, আর কেউ ভাবতেই পারবে না হড়বড় করে তুমি, চিরন্তন বক্রা, মুরগি, ক্লাউন, বেরিয়ে যাচ্ছ ইউরিনালে নয় ক্যান্টিনে নয় চা-দোকানে নয়, আসলে তোমার গাধার টুপির ভেতর থেকে চকিতে বের করে আনছ একটা বন্দুক, যাতে টুপটুপে সান্ত্বনা-ফোঁটার মতো বসে আছে চারটে মরিয়া মাথা-কোটা বুলেট। |
|
|
|
|
|