শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগের খরা,
ক্যাম্পাসে বিদায় বাংলা

থ্য-প্রযুক্তির আকর্ষণে সামান্য হলেও ভাটার টান। তাই আবার সিভিল-মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভিড় বাড়ছে। কিন্তু পাশ করে বেরিয়ে ওই সব শাখার নতুন ইঞ্জিনিয়ারদের অধিকাংশকে চাকরির জন্য ছুটতে হচ্ছে ভিন রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গে কাজের বিশেষ সুযোগ ওঁরা পাচ্ছেন না। যার অন্যতম কারণ হিসেবে এ রাজ্যে উৎপাদন-শিল্পে লগ্নির আকালকে দায়ী করছে শিল্প-বণিকমহলের একাংশ।
২০০৮-এর সেই বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দার পর থেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাম্পাসে ‘আইটি’-র ঔজ্জ্বল্য-কৌলীন্য যেন কিছুটা ম্লান। উল্টে মেকানিক্যাল-ইলেকট্রিক্যাল-সিভিল-কেমিক্যালের মতো ‘কোর’ শাখায় আসনের চাহিদা ফের ঊর্ধ্বমুখী। সিভিল-মেকানিক্যাল পাশ করে বেরিয়ে আসা ছেলেমেয়েরা চাকরি পাচ্ছেন ঠিকই। তবে সরকারি-বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোয় ‘প্লেসমেন্ট’-এর পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, কোর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধিকাংশ নতুন স্নাতকের চাকরি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে।
এবং এর প্রেক্ষিতে শিল্পমহলের একাংশের বক্তব্য: নতুন প্রকল্প (গ্রিনফিল্ড প্রজেক্ট) না-হলে নতুন ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরি হওয়া কঠিন। অথচ এ রাজ্যে সিভিল-মেকানিক্যাল-ইলেকট্রিক্যাল ইত্যাদি শাখায় যত ইঞ্জিনিয়ার ফি বছর বেরোচ্ছেন, উৎপাদন-শিল্পে তাঁদের সকলকে নেওয়ার মতো নতুন প্রকল্পের সংখ্যা সে তুলনায় নগণ্য। “পাশাপাশি নতুন কারখানায় যে ধরনের নয়া প্রযুক্তির সুযোগ, পুরনো কারখানায় তা রাখা কঠিন। ফলে ইন্সট্রুমেন্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো শাখায় এ রাজ্যে নতুন কাজের সুযোগ নেই বললেই চলে।” মন্তব্য রাজ্যের এক শিল্প-কর্তার।
মগজ চালান
কোন শাখা বাইরে চাকরি
মেকানিক্যাল ৭০%
সিভিল ৪০%
ইনস্ট্রুমেন্টেশন প্রায় ১০০%
ইলেকট্রিক্যাল ৭৫%
ইলেকট্রনিক্স ৮০%
* বিভিন্ন বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সূত্রে পাওয়া এ বছরের তথ্য
পরিণামে ‘ব্রেন ড্রেন’ অব্যাহত। কর্পোরেট মহলের নিয়োগের ছবিতেও এই মগজ চালানের প্রবণতা স্পষ্ট। শিল্পম-সূত্রের খবর: ব্রিটিশ অক্সিজেন, গোদরেজ, ম্যাকনেলি ভারত, টেলকন, রিলায়্যান্সের মতো সংস্থা এ বছর পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কলেজের ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ে এসেছিল। ভিন রাজ্যের প্রকল্পের জন্যই অধিকাংশ ইঞ্জিনিয়ারকে নেওয়া হয়েছে। যেমন কলকাতার হেরিটেজ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-র মুখপাত্র জানাচ্ছেন, তাঁদের ক্যাম্পাসে ব্রিটিশ অক্সিজেন ও রিলায়্যান্স এসেছিল। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সব স্নাতকের চাকরি হয়েছে রাজ্যের বাইরে। কলকাতার আর এক বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, গোদরেজের মতো সংস্থার হাত ধরে তাঁদের কোর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বেশ কিছু স্নাতক মহারাষ্ট্রে চলে যাচ্ছেন।
রাজ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পঠন-পাঠন বা গবেষণায় যে দুই প্রতিষ্ঠানের নাম সর্বাগ্রে আসে, সেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি (বেসু) কী বলছে?
বেসু-র উপাচার্য অজয় রায় বলেন, কোন পড়ুয়া কোথায় চাকরি পেলেন, তার বিস্তারিত তথ্য তাঁদের কাছে নেই। অজয়বাবুর মতে, উৎপাদন-শিল্পের কোন শাখায় ওঁরা কাজ করছেন, পোস্টিং তার উপরে নির্ভর করে। যেমন, কেউ গাড়ি শিল্পে থাকলে স্বভাবতই তাঁর কাজের জায়গা হবে পুণে বা চেন্নাই। “আবার কোর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অনেক স্নাতক বহুজাতিকেও চাকরি পান। সে ক্ষেত্রে ওঁরা বিদেশেও পাড়ি দিতে পারেন।” মন্তব্য অজয়বাবুর। অন্য দিকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর: পাশ করে বেরিয়ে বহু ইঞ্জিনিয়ারকে প্রথমে বাইরে যেতে হচ্ছে। কারণ, অধিকাংশ বড় সংস্থার কারখানা এখানে নেই। অথচ সদ্য ডিগ্রি পাওয়া ইঞ্জিনিয়ারকে প্রশিক্ষণ নিতে হয় কারখানায়। যাদবপুরের প্লেসমেন্ট ও ট্রেনিং বিভাগের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য বলেন, “কারখানায় প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পরে ওঁদের বিভিন্ন প্রকল্পে কাজে লাগানো হয়। সে ক্ষেত্রে এ রাজ্যের কোনও প্রকল্প থাকলে এখানেও পোস্টিং হতে পারে।”
অর্থাৎ, অন্য রাজ্য দিয়ে চাকরিপর্ব শুরু করা ছাড়া অনেকেরই উপায় থাকছে না। রাজ্য কী ভাবছে?
শিল্প-প্রশাসনের দাবি, মেধাসম্পদের ভিন রাজ্যে ও বিদেশে পাড়ি দেওয়াটা নতুন কিছু নয়। বরং পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান সরকার প্রবণতাটা রোখার চেষ্টা করছে। শিল্প-বাণিজ্যমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় একাধিক সভায় বলেছেন, নিজভূমে ফিরতে ইচ্ছুক বঙ্গসন্তানদের সরকার যাবতীয় সহযোগিতা করবে। যদিও তেমন পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি বলে শিল্প-বাণিজ্যমহলের অনেকে মনে করছেন। কী বলছেন তাঁরা?
বণিকসভা বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সের প্রেসিডেন্ট কল্লোল দত্তের মতে, দেশ জুড়েই উৎপাদন ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বৃদ্ধির অভাব স্পষ্ট। তার উপরে এ রাজ্যে শিল্পে লগ্নির অভাবে কর্মসংস্থানে টান পড়েছে। তিনি বলেন, “মন্দার পরে মেকানিক্যাল, সিভিল ইত্যাদির কদর ফিরছে। অথচ এখানে যাঁরা পাশ করে বেরোচ্ছেন, তাঁরা রাজ্যের বাইরে পা রাখতে বাধ্য হচ্ছেন।” মানবসম্পদ-বিশেষজ্ঞ তুষার বসুর আক্ষেপ, “গত পনেরো বছর যাবৎ এ রাজ্য থেকে বাইরে চাকরি করতে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি যা, তাতে ভবিষ্যতেও এটা ঠেকানো মুশকিল।”
অন্য দিকে বণিকসভা সিআইআইয়ের রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পে কর্মসংস্থানের যে ছবি মিলছে, তা-ও বিশেষ আশাপ্রদ কিছু নয়। দেখা যাচ্ছে, মোটামুটি সব রাজ্যে শিল্পক্ষেত্রে সর্বাধিক হারে কর্মসংস্থান হলেও পশ্চিমবঙ্গে সেই হার নগণ্য। এখানে জীবিকা জোগানোয় সবার আগে পরিষেবা ক্ষেত্র বা সার্ভিস সেক্টর (যার মধ্যে রেস্তোরাঁ-বিপণি, নিরাপত্তারক্ষীর কাজ থেকে শুরু করে কলসেন্টারের চাকরিও রয়েছে)। তথ্য বলছে, এরাজ্যে উৎপাদন-শিল্পে কর্মসংস্থানে বৃদ্ধির হার সাকুল্যে ১.২১%। খনিশিল্পে ২.৩৪%, নির্মাণে ৯.৭৩%। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে তা প্রায় ১০% নেমে গিয়েছে!
তথ্য-প্রযুক্তিতে অবশ্য একটু অন্য রকম। সফ্টওয়্যারসংস্থাগুলির সর্বভারতীয় সংগঠন ‘ন্যাসকম’-এর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান সুপর্ণ মৈত্রের দাবি, পশ্চিমবঙ্গে আইটি’তে নিয়োগের ছবি যথেষ্ট উজ্জ্বল। “গত দু’বছরে এ রাজ্যে তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পে দশ হাজারের বেশি চাকরি হয়েছে।” বলছেন সুপর্ণবাবু। সংশ্লিষ্ট শিল্পমহলের দাবি: চার বছর বা তার আগে, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আইটি’র তুঙ্গ চাহিদা থাকাকালীন যাঁরা ওই শাখায় ভর্তি হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে পাশ করে বেরিয়ে এ রাজ্যেই পছন্দের চাকরি পেয়ে গিয়েছেন। এ হেন বৈপরীত্য কেন?
ওই মহলের একাংশের ব্যাখ্যা: ইনফোসিস’কে বাদ দিলেও তথ্য-প্রযুক্তির বেশ কিছু তাবড় সংস্থা পশ্চিমবঙ্গে এসেছে। গড়েছে বড় প্রকল্প। তালিকায় উইপ্রো, কগনিজ্যান্ট, টিসিএস, আইবিএমের মতো ‘নক্ষত্র’রাও রয়েছে। তাই নতুন আইটি ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরি হয়েছে তুলনায় বেশি। কিন্তু যথেষ্ট সংখ্যক কোর ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগের মতো বড় শিল্প-কারখানা সাম্প্রতিক কালের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। উল্টে টাটার গাড়ি-প্রকল্প রাজ্য থেকে পাট গুটিয়েছে। এমনকী, এ প্রসঙ্গে হলদিয়া থেকে এবিজি-বিদায়ের ঘটনারও উল্লেখ করছেন শিল্প-কর্তাদের অনেকে। তাঁদের মতে, গাড়ি কারখানা তো বটেই, এবিজি-র মতো পণ্য খালাসকারী সংস্থাতেও কোর ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরির সুযোগ ছিল অনেক বেশি।
সে সুযোগ ফস্কেছে। অতএব, ঘরের ভাত খেয়ে চাকরি করতে হলে উৎপাদন-শিল্পেও ‘নক্ষত্র সমাবেশের’ অপেক্ষায় থাকা ছাড়া উপায় কী?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.