সদ্যসমাপ্ত চলচ্চিত্র উৎসবে এ বারের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল যে ছবি, তার নাম আমুর। কান উৎসবে সেরা শিরোপা পাওয়া এই ছবির মূল চরিত্র এক বৃদ্ধ দম্পতি। অভিনয় করছিলেন দুই প্রখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী, জাঁ লুই ত্রিন্তিনান্ত এবং ইমানুয়েলা রিভা।
ইমানুয়েলার বয়স ৮৫, জাঁ ৮১।
কলকাতার মঞ্চে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ৭৭ বছরের রাজা লিয়ারকে দেখার জন্য টিকিটের হাহাকার। এই সপ্তাহান্তে এ শহরের দর্শকের জন্য অপেক্ষা করছে আরও একটা চমক। সাত ও আটের দশকে মঞ্চ কাঁপানো দুটি প্রযোজনা ফিরিয়ে আনছেন অরুণ মুখোপাধ্যায়। মারীচ সংবাদ আর জগন্নাথ। ২৫ নভেম্বর জগন্নাথের ভুমিকায় অভিনয় করবেন ৭৫ বছরের যুবক, অরুণ। কাউন্টার খোলার দু’দিনের মধ্যেই প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ।
বাংলা নাটকের জনপ্রিয়তম প্রযোজনাগুলির মধ্যে মারীচ এবং জগন্নাথের আসন অনেক দিন ধরেই পাকা। ১৯৭৩ সালের নাটক ‘মারীচ’ প্রায় ৮০০ শো হয়েছে। ‘জগন্নাথে’র শো হয়েছে ৬০০-র বেশি। অরুণবাবু জানাচ্ছেন, মারীচ লেখা হয়েছিল সাত দিনে। নাটকটা প্রথম অভিনয় হয়েছিল মহাকরণের কর্মীদের নিয়ে। তার পরে দলের ব্যানারে নাটকটা আবার করা হয়। ‘‘মারীচ যে এতটা জনপ্রিয় হবে, সেটা আমি নিজেও ভাবিনি’’, বললেন অরুণ। |
পাশাপাশি ‘জগন্নাথ’ নিয়ে ভাবনাটা ছিল অনেক দিনের। লু শুনের ‘দ্য ট্রু স্টোরি অফ আ কিউ’ গল্পটা উনি পড়েছিলেন ছয়ের দশকের মাঝামাঝি। তখন থেকেই ওই আধারে একটা নাটক লেখার কথা ভেবে আসছিলেন। শেষ পর্যন্ত নাটকটা লেখা হল প্রায় দশ বছর পরে। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম মঞ্চস্থ হল জগন্নাথ।
মারীচ এবং জগন্নাথ, দু’টি নাটকই ছিল আদ্যন্ত রাজনৈতিক। ঘোষিত ভাবেই বামপন্থী মেজাজের। কিন্তু কট্টর বামপন্থীদের একাংশের মধ্যে জগন্নাথকে ঘিরে যথেষ্ট অস্বস্তিও ছিল। নিম্নবর্গের শ্রেণিচেতনা সংক্রান্ত সাবেকি ধ্যানধারণার সঙ্গে এ নাটক খাপ খায় না বলে অনেকে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু জনপ্রিয়তার তোড়ে সে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল জগন্নাথ। অশোক মিত্র থেকে শঙ্খ ঘোষ, মৃণাল সেন থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সকলে অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন প্রযোজনাটির।
জগন্নাথ শেষ অভিনয় হয়, ঠিক দশ বছর আগে। অরুণবাবু তখন ৬৫। এ বার তিনি ৭৫। জগন্নাথের চরিত্রটি যে শুধু যুবকের তাই নয়, যে পরিমাণ শরীরী অভিনয়ের প্রয়োজন হয় এ নাটকে, তার বিচারে এটা বিরাট চ্যালেঞ্জ নিঃসন্দেহে। নাট্যজগতের অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে, শম্ভু মিত্র ৬৫ বছর বয়সেও ‘চার অধ্যায়’ করেছেন। লরেন্স অলিভিয়ের যখন ‘হ্যামলেট’ করতেন, তখন তিনি যুবক নন কোনও মতেই। “চেহারা নয়, মঞ্চে অভিনয়ের ব্যাপ্তিটাই বড় কথা”, বললেন সুমন মুখোপাধ্যায়। “বয়স, সময় এবং অভিজ্ঞতার সঙ্গে চরিত্রকে জানা-বোঝা, ব্যাখ্যা করার দৃষ্টিকোণ ভিন্ন মাত্রা পায়। তাবড় নাট্যব্যক্তিত্বরা যেমন বলেন, হ্যামলেটের বয়সে দাঁড়িয়ে হ্যামলেট-এর প্রতি সুবিচার করাই যায় না।” ২০১২-য় এসে তাই জগন্নাথ কতটা পাল্টাল, সেটাই দেখার অপেক্ষায় থিয়েটারের নতুন প্রজন্ম।
সুমন নিজে ‘মারীচ’-এর প্রথম শো থেকে অভিনয় করেছেন এ বারেও মেরিবাবা-র গান তিনিই গাইবেন। বাবাকে ছোট থেকে কাজ করতে দেখেছেন। লিয়ার-এ সৌমিত্রর সঙ্গে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বললেন, “স্টেজের একটা জাদু আছে। সৌমিত্রবাবুকে দেখেছি, স্টেজে উঠলেই অন্য মানুষ। শরীরের ভাষাই বদলে যায়।” এক কথা বলছেন সুজন মুখোপাধ্যায়। নিজে বাবার সঙ্গে অভিনয় করবেন ‘জগন্নাথ’-এ। বাবা এই ধকলটা নিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে চিন্তা ছিল। “কিন্তু রিহার্সাল দিতে গিয়ে দেখলাম, শারীরিক বাধা কাটিয়ে উনি ১০০ শতাংশ দেওয়ার জন্য তৈরি।” অরুণবাবু নিজেও বলছেন, “দু’একটা মুভমেন্ট একটু বদলে নিচ্ছি। বাকিটা পেরে যাব মনে হচ্ছে।”
সুমন-সুজন অত্যুক্তি করেননি, ‘‘জগন্নাথ আর অরুণ মুখোপাধ্যায় আসলে সমার্থক।” |