বিনোদন পর্দায় গাঁধী-দেহতত্ত্ব মিশেল
কি পাল্টাবে শহরের ছবি

বিটার যখন কলকাতায় শু্যটিং করা হয়, তখন তার নাম ছিল ‘সাধনা’। কারণ? পরিচালক অমিতাভ চক্রবর্তীর ভয় ছিল, ‘কসমিক সেক্স’ নাম রেখে শু্যট করলে হয়তো গণ্ডগোল হতে পারে।
দেহতত্ত্ব এ ছবির ভিত্তি। যদিও সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্রের জন্যে এখনও আবেদন করেননি পরিচালক। রবিবার সিনে সেন্ট্রালের ‘ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম ফর নিউ সিনেমা’-র সমাপ্তিসূচক ছবি এটি। এই প্রথম কলকাতায় ছবিটি দেখানো হচ্ছে। এর আগে দেখানো হয়েছে দিল্লিতে। সেখানে ‘ওসিয়ান্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এ ছবির নায়িকা ঋ শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কারও পেয়েছেন। ভারতীয় কোনও ছবিতে এই প্রথম আলোচনা করা হয়েছে গাঁধীজির ব্রহ্মচর্য দর্শন নিয়ে। তার সঙ্গে দেহতত্ত্ব।
আঠারো বছরের সদ্যযুবক কৃপা এই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র। চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন অংশুমান মিত্র। এক রাতে বাবার সঙ্গে বিরোধ হয় কৃপার। বাবাকে সে খুন করে বসে। ভয় আর গ্লানিতে কৃপা বাড়ি ছেড়ে পালায়। সেই রাতেই তার সঙ্গে দেখা হয় অনেক মানুষের। যৌনতা এবং হিংসা নিয়ে হয় অনেক রকম অভিজ্ঞতা। ভোরবেলা গঙ্গার ধারে এক মহিলার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনি কৃপাকে দত্তক নেন। তার পর শুরু হয় এক সাধনা। যে সাধনার বলে কৃপা বুঝতে পারে, কী ভাবে মানুষ তার যৌনশক্তি ব্যবহার করে পৌঁছতে পারে ঈশ্বরের কাছে।
কিন্তু যে শহরে বাংলা ছবিকে সাবালক হতে গিয়ে বারবার ঠোক্কর খেতে হয়, যেখানে পাওলি দামের ‘ছত্রাক’-এর একটি ক্লিপ আলোড়ন ফেলে দেয়, সেখানে এমন একটি ছবি দেখানোর আগে কী বলছেন প্রযোজক-পরিচালক?
পরিচালক অমিতাভ কলকাতার প্রদর্শন নিয়ে আশাবাদী। “বাংলার মানুষ যথেষ্ট প্রগতিশীল। আমার ছবিতে যৌনতা নিয়ে যা বলা আছে তার সব কিছুই আমাদের গ্রামেগঞ্জে বহু প্রচলিত। লালন ফকিরেরও এ বিষয় নিয়ে গান আছে,” বলেছেন অমিতাভ। পরিচালক অশোক বিশ্বনাথন, যিনি এ ছবির কার্যনির্বাহী প্রযোজক, জানালেন, ছবিটি দিল্লিতে দেখানোর পরেই সিনে সেন্ট্রালের কর্মকর্তারা তা কলকাতায় দেখানোর ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছিলেন। অশোক বললেন, “আমার বিশ্বাস, ছবিটি মানুষকে কোথাও না কোথাও স্পর্শ করবে। বাংলায় এমন একটি সামগ্রিক ছবি দেখানো হয়নি যার মধ্যে যৌনতা একটা অংশ। ছবির দৃশ্যায়ন অপূর্ব। কেউ আবার হয়তো বিরক্ত হতে পারেন যদি বিষয় নিয়ে ছুৎমার্গ থাকে। তবে আমি মনে করি, ছবিটি বানানো আর দেখানোটাই একটি নতুন পদক্ষেপ। আমরা উত্তরণের দিকেই এগোচ্ছি।”
‘কসমিক সেক্স’ ছবির একটি দৃশ্য।
অশোকের মতে, গাঁধীজির ব্রহ্মচর্য নিয়ে ছবির যে অংশটিতে আলোচনা করা হয়েছে, সেটিই এই ছবির অন্যতম স্পর্শকাতর জায়গা। “গাঁধীজি সম্পর্কে ছবির নায়ক পড়াশোনা করে জানতে পারেন, কী ভাবে গাঁধীজি তাঁর যৌন স্পৃহাকে দমন করার চেষ্টা করেন নগ্ন মহিলাদের সান্নিধ্যে এসে। তার পর ছেলেটির দেখা হয় এক মা-রূপী মহিলার সঙ্গে। যিনি কৃপাকে বোঝান, গাঁধীজির দর্শনটা একটা স্তর অবধি যায়। তন্ত্রসাধনা যাঁরা করেন, তাঁরা যৌনতার মধ্যে দিয়েই যৌনতাকে অতিক্রম করেন। ভারতীয় কোনও ছবিতে এ ভাবে যৌনতা নিয়ে কাজ হয়নি।”
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অমিতাভের আগের তথ্যচিত্রেও দেহতত্ত্ব নিয়ে কথা ছিল। সেটি মুর্শিদাবাদে দেখাতে গিয়ে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয় তাঁর। “গ্রামের এক দরিদ্র মহিলা তথ্যচিত্রটি দেখার পরে আবেগে কেঁদে ফেলেন। আমার হাতটা ধরে বলেন, ‘দাদা আসলটা দেখালেন না?’ সত্যিকারের বাংলাকে জানতে হলে এই সব প্রতিক্রিয়াকে অগ্রাহ্য করা যায় না,” বললেন পরিচালক। ছ’জন প্রযোজক নাকচ করে দেওয়ার পরে নিজের টাকা দিয়ে এই ছবিটি বানিয়েছেন তিনি।
এবং ছবিতে যৌনতা নিয়ে কোনও লুকোচুরি নেই। পরিচালকের কথায়, “ঋ এ বিষয়ে খুব আধুনিক। বিকিনি পরে ‘বোল্ড’ হওয়ার চেষ্টা নেই কোনও। এমনও দৃশ্য আছে, যেখানে ঋ সামনে থেকে পুরোপুরি নগ্ন। নায়কও তাই। কিন্তু তাই বলে নগ্নতা নিয়ে আমি সুড়সুড়ি দিই না। ছবির এক দৃশ্যে ওঁরা এ ভাবেই বসে দেহতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। এই দৃশ্যটি সম্পর্কে শুনতে যেমনই লাগুক, ছবিতে এটি দেখে কেউ যদি এটিকে অশ্লীল বলতে পারে, তা হলে আমি তাঁকে মেডেল দেব।”
দিল্লির দুটো স্ক্রিনিংয়ে কোনও ঝামেলা হয়নি। নগ্নতা দেখানো নিয়ে কারও কোনও আশঙ্কা ছিল না। ঋ-ও ছিলেন দিল্লির প্রদর্শনে। কোনও অতিরিক্ত নিরাপত্তার প্রয়োজন পড়েনি সেখানে। কলকাতাতেও তা লাগবে না বলেই মনে করেন পরিচালক।
তবে এখানকার স্ক্রিনিংয়ে ঋ থাকতে পারছেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তাসের দেশ’ অবলম্বনে ঋ অভিনীত একটি ছবি দেখানো হয়েছে রোম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। ঋ সেই নিয়ে ব্যস্ত। রোম থেকে ঋ জানালেন, “কলকাতার এই স্ক্রিনিংটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এটা একটা বিতর্ক শুরু করে দিতে পারে। আমি থাকতে পারছি না বলে আক্ষেপ হচ্ছে। তবে অধীর আগ্রহে বসে থাকব কলকাতার মানুষের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য।” ‘তাসের দেশ’-এর পরিচালক কিউ (যাঁর ‘গান্ডু’ ছবিটি বিতর্কের ঝড় তুলেছিল) জানালেন, কলকাতার অনেক দর্শকই ব্যতিক্রমী ছবি পছন্দ করেন। তাঁর কথায়, “অনেকে ভাবছেন কলকাতা শহরটা ‘কসমিক সেক্স’-এর মতো ছবির জন্য তৈরি কি না। ভেবে দেখুন এই শহর থেকেই তো এই সব অলটারনেটিভ ছবির কথা ভাবা হচ্ছে। আমার অমিতাভর দৃষ্টিভঙ্গিটা ভাল লাগে। ভাল লাগে এ ছবিতে ঋ-এর অভিনয়ও।”
শ্রীলঙ্কা থেকে ‘কসমিক সেক্স’এর টিমকে অভিনন্দন জানিয়েছেন ‘ছত্রাক’-এর পরিচালক বিমুক্তি জয়সুন্দর। বলেছেন, “আমি খুশি যে, ‘ছত্রাক’-এর পরে এই রকম একটি ছবি বানানো হয়েছে। আমার ছবির ক্ষেত্রে মানুষ শুধুমাত্র একটা ক্লিপ দেখে ছবিটার সমালোচনা করেছেন। পুরো ছবিটা না দেখে বিচার করা উচিত নয়। ‘কসমিক সেক্স’ দেখানো হলে মানসিকতাটা হয়তো বদলাবে। তখন হয়তো ‘ছত্রাক’ এ শহরে দেখানো যাবে।”
পাওলি দামের কথায়, “অমিতাভ চক্রবর্তী ভাল পরিচালক। ওঁর ছবি ভাল হবে বলে আশা করছি। একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রী তাঁর পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গিকেই রূপায়িত করেন। আমি মনে করি না প্রত্যেকটি ছবিতেই নগ্নতা থাকাটা প্রয়োজনীয়। আবার ছবিতে নগ্নতা থাকলেই সেটি খারাপ, এটা ভাবা ঠিক না।”
কিন্তু সেন্সর বোর্ড কী বলবে? অমিতাভরা তো এখনও সেন্সরের ছাড়পত্রের আবেদন করেননি। সেন্সর বোর্ড সদস্য অনসূয়া চৌধুরী জানালেন, সাধারণত সামনে থেকে (ফুল ফ্রন্টাল) নগ্নতায় সেন্সর বোর্ড বাংলা ছবিতে অনুমতি দেয় না। “তবে যদি দৃশ্যগুলোর সঙ্গে ছবির প্রাসঙ্গিকতা থাকে, তা হলে ভেবে দেখা যেতে পারে,” বললেন অনসূয়া।
দর্শক তৈরি। ছবি ভাল লাগা না লাগাটা পরের বিষয়। তবে এই রকম একটি বাংলা ছবি কলকাতায় দেখানোটা দৃষ্টান্ত তৈরি করবে বলেই মনে করছেন বিমুক্তি। বিতর্ক হয়তো হবে, হয়তো বা হবে না। তবে এ সবের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে কেরলের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি দেখানোর তোড়জোড়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.