|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
তাঁর বিষয়ে তিনি এক ভগীরথ |
স্বাতী ভট্টাচার্য |
প্রবন্ধসংগ্রহ ১ ও ২, সুকুমারী ভট্টাচার্য। গাঙচিল, প্রতি খণ্ড ৬৫০.০০ |
এক নৈশভোজে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক টমাস স্ক্যানলনকে এক মহিলা বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, আপনারা সারা দিন কী করেন, চট করে এক কথায় বলতে পারেন?’ তিনি বলেছিলেন, ‘আই মেক ডিস্টিংশনস’। এটা হলে ওটা না-ও হতে পারে, অমুকটা বললেই তমুকটা বলা হয়ে গেল না, এমন সূক্ষ্ম পার্থক্যের বিচারই দার্শনিকের সারা দিনের কাজ। ‘কথাটা না-ভেবেই বলেছিলাম, কিন্তু ভুল বলিনি,’ ক্লাসে বলেছিলেন স্ক্যানলন।
৯১ বছরের সুকুমারী ভট্টাচার্যকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন, ‘এক কথায় বলুন, সারা জীবন আপনি কী করেছেন?’ তবে স্বচ্ছন্দে তিনি বলতে পারেন, ‘আই ডিমিস্টিফাই।’ কয়েক হাজার বছরের দূরত্ব যেন পূর্বপুরুষদের চারপাশে গৌরবের ছটা তৈরি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করেছেন এই ক্ষীণতনু বাঙালি মহিলা। বেদ-বেদান্তের যুগে আলবাল-তরুলতা সব মঙ্গলালোকে উজ্জ্বল, সমাজ ন্যায়নীতির পরাকাষ্ঠা, মূর্খের এই কল্পলোককে তাঁর পাণ্ডিত্য আর কাণ্ডজ্ঞানের আঘাতে ধুলোয় ফেলেছেন সুকুমারী। চারপাশে আজ যত অন্যায়, অমর্যাদা দেখি আমরা, প্রবলের নিপীড়নকে সমর্থন করার যত আয়োজন, সে সবের শিকড় আছে বেদ-ব্রাহ্মণের যুগে। শুধু শিকড়ই বা কেন, শাখা-প্রশাখা মেলে সে যুগেও অগণিত মানুষের শ্বাসরোধ করেছে সে বিষবৃক্ষ। অনার্য, বিজিত, কৃষ্ণাঙ্গ, বনবাসী, নারী, দাস, সবার প্রতি নিষ্করুণ ছিল সে দিনের হিন্দুরা। আজকের মতোই।
সুকুমারীর আবেগ-বর্জিত, ন্যায়পরায়ণ জ্ঞানচর্চা দীর্ঘ দিন ধরে বাঙালি প্রবন্ধ-পাঠকের পরিচিত। কিন্তু তাঁর কাজের পরিধি ও বৈচিত্র হয়তো তত স্পষ্ট হয়নি। তাঁর প্রবন্ধ সংগ্রহের খণ্ডগুলি (এটি তাঁর বাংলা রচনার সংগ্রহও বটে) সেই ফাঁক পূরণ করবে। তাঁর মৌলিক অবদানের আভাস প্রথম দুই খণ্ডেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আগামী বইমেলায় তৃতীয় ও শেষ খণ্ডটি প্রকাশিত হলে তা সম্পূর্ণ হবে।
ইতিহাস পাঠ ও ব্যাখ্যার যে ধারা সুকুমারী সারা জীবন চর্চা করেছেন, তা ‘মার্কসীয়’ কি না তা নিয়ে তর্ক হতে পারে (মার্কস কি মার্কসীয় ছিলেন?) তবে মার্কস-অনুপ্রেরিত বলা চলে নিশ্চয়ই। উৎপাদনের রীতি-পদ্ধতির বিবর্তনের সূত্র ধরে ভারতের প্রাচীন ইতিহাস বোঝার চেষ্টা যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে প্রভাবশালী দামোদর ধর্মানন্দ কোসম্বি। কোসম্বির অনুগমন করেছেন অনেকে। সুকুমারীর বিশিষ্টতা দুটো। এক, মুখের ভাষায় ইতিহাস লেখা। আর দুই, তাঁর অক্লান্ত, বোঝাপড়াহীন নারীবাদ। ‘প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ’ শিরোনামে প্রথম খণ্ডে তাঁর যে প্রবন্ধগুলি সংকলিত, সুকুমারীর অবদান চিন্তা করতে চাইলে গোড়াতেই সেগুলি রাখতে হবে। বেদ, সংহিতা, ব্রাহ্মণের নানা পংক্তিতে নারীকে ‘ঊনমানব’ করে রাখার যে অবিচ্ছিন্ন প্রয়াস, তা ক্ষুব্ধ করে, বেদনাহতও করে। যাজ্ঞবল্ক্যকে আমরা সেই পুরুষ বলে জানি, যিনি নিজের স্ত্রীকে আত্মার স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছিলেন। সেই ঋষিই কিন্তু বলে গিয়েছেন, স্ত্রী স্বামীর সম্ভোগেচ্ছা চরিতার্থ করতে অস্বীকার করলে স্বামী তাকে প্রথমে বোঝাতে চেষ্টা করবে, তার পরে উপহার দিয়ে তাকে কিনে নিতে চেষ্টা করবে, এবং তার পরেও রাজি না হলে হাত বা লাঠি দিয়ে মেরে তাকে বশ করবে। সম্পত্তি, শিক্ষা, এমনকী নিজের দেহের উপর কোনও অধিকার যাতে মেয়েদের না থাকে, শাস্ত্রে তার সুনিপুণ আয়োজন চলেছে বহু শতাব্দী জুড়ে। এ কথাগুলো আজ অত চমকে না-ও দিতে পারে, কারণ সম্প্রতি সাহিত্যে-মঞ্চে-চলচ্চিত্রে প্রাচীন ভারতের নারী-অবমাননা নানা ভাবে অভিব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু যে সময়ে সুকুমারী প্রথম লিখছিলেন, সেই নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে এত সুলভ ছিল না এমন বিশ্লেষণ।
এই সংকলনের অনুবাদ, সংশোধন, সম্পাদনার পরিশ্রমটি অনেকে মিলে বহন করেছেন। তাঁরা পাঠকের ধন্যবাদ দাবি করেন। তবে একটি সমস্যা হল, অনেক রচনারই প্রথম প্রকাশের তারিখ দেওয়া নেই। তাই কেবল এই সংকলনের উপর নির্ভর করলে সুকুমারীর চিন্তার বিবর্তন বুঝতে, অন্যদের সঙ্গে তাঁর অবস্থান তুলনা করতে অসুবিধে হয়। লেখকের একটি বিস্তারিত পরিচিতি, তাঁর লেখাগুলি নিয়ে একটি আলোচনা বা ভূমিকারও খুব প্রয়োজন ছিল। শোনা যাচ্ছে, তৃতীয় খণ্ডে এগুলি থাকবে। শেষরক্ষা হয় তা হলে। ‘খাদ্যের অধিকার’ নিয়ে যখন এত কথা হচ্ছে, তখন বড় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ‘বেদে ক্ষুধা প্রসঙ্গ।’ বহু সাক্ষ্য-প্রমাণ, বহু কাহিনী থেকে এক নিষ্করুণ সমাজ ব্যবস্থার বিবরণ ফুটিয়ে তুলেছেন সুকুমারী। সেখানে সমাজের অধিকাংশের অন্নাভাব প্রায় অনিবার্য, খাদ্যনিরাপত্তার কোনও বালাই নেই গরিবের। তাই বারবার দেবতার কাছে অন্নপ্রার্থনা, এমনকী আরাধ্য দেবতাকেই অন্ন বলে দেখার এত নিদর্শন। জাতপাত ভেদে খাদ্যাখাদ্য নিশ্চয়ের যে গুরুত্ব আমরা দিয়ে এসেছি বরাবর, ঝাপসা ভাবে ভেবেছি, শাস্ত্রে এমনই রয়েছে, সে সবই রূঢ় ধাক্কা খায় যখন দেখি ঋগ্বেদের ব্রাহ্মণ ঋষি বামদেব খিদের জ্বালায় কুকুরের নাড়িভুঁড়ি রান্না করে খেয়েছেন, যা চণ্ডালেরও অখাদ্য। উপনিষদের যুগে, যখন ঐহিক সম্পদের চাইতে অমৃতত্ব লাভ করাই মুখ্য হয়ে উঠেছিল, তখনও বারবার অন্নের প্রশংসা, অন্নের যাচ্ঞা উচ্চারিত। লাঙলে লোহার ফাল সে যুগে সবুজ বিপ্লব ঘটিয়েছিল, এ যুগে যেমন ঘটিয়েছে সংকর বীজ, রাসায়নিক সার। কিন্তু বাড়তি খাদ্য ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে তখনও পৌঁছয়নি, আজও নয়। সুকুমারী চিন্তা করেছেন এই শ্রেণিদ্বন্দ্বের ফ্রেমে।
শ্রেণিদ্বন্দ্বের যে ধারণা ক্ষুধার ব্যাখ্যায় এত সুপ্রযুক্ত, ‘বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য’ প্রবন্ধগুলির ক্ষেত্রে কিন্তু তা হয় না। ব্রাহ্মণরা যাগযজ্ঞে বিশ্বাস টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রার্থিত ফল না পেয়ে কিছু লোক যজ্ঞে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন, সে বেশ বোঝা গেল। কিন্তু আস্তিক-নাস্তিকের বিভাগকে কী করে শ্রেণিবিভাগে ফেলা চলে, তা স্পষ্ট নয়। সুকুমারী লিখছেন, ‘যে-মানুষ দুঃখে, অভাবে, অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে ইহজীবন যাপন করে গেল, তার পক্ষে জন্মান্তর তো অভিশাপ।’ কেন? সে জন্মান্তরে সুখলাভের আশা করতে পারে, বা স্বর্গলাভ। ‘অভাগীর স্বর্গ’ স্মরণ করুন। পরজন্মের আশঙ্কা থেকে নাস্তিকতার সূত্রপাত (আবার মোক্ষতত্ত্বেরও সূত্রপাত সেটাই, বলছেন অন্যত্র), আর নাস্তিকতাই ‘লোকায়ত’ দর্শন, এমন ইঙ্গিত সুকুমারী আগাগোড়াই দিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠা করেননি। নৃতত্ত্ব কিংবা ইতিহাস কি সে সাক্ষ্য দেয়?
উত্তর-আধুনিকতায় বিশ্বাসীরা বলবেন, ক্ষমতা থেকেই জ্ঞানের উদ্ভব, সব যুগে, সব সমাজে। ক্ষমতাবানের আধিপত্যকে যা আঘাত করতে পারে, তেমন যুক্তি-তর্ক-দৃষ্টান্ত স্পষ্ট করে ব্যক্ত করতে না পারাই গরিব-প্রান্তবাসীর অক্ষমতার বড় কারণ। আশিস নন্দীকে অনুসরণ করে বলা চলে, গণহত্যা বা দাসপ্রথার মতো জঘন্য অপরাধের ইতিবৃত্তও থেকে যায় সম্মিলিত স্মৃতির অনালোকিত জগতে। তা বয়ে চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, কাজ করে এক বিশাল, ব্যাপৃত চেতনায়। কিন্তু তা সঙ্গীত, শিল্প বা সাহিত্যে নিজেকে সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে পারে না।
কিংবা টমাস কুন বিজ্ঞানে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে পদ্ধতি দেখিয়েছেন, তার অনুসরণে বলা চলে, জ্ঞানের যে কোনও নির্দিষ্ট ব্যবস্থার মধ্যেই জমা হতে থাকে এমন সব দৃষ্টান্ত, যাকে ওই জ্ঞান-ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করতে পারে না। প্রথম প্রথম সেগুলি তুচ্ছ, এবং প্রশ্নকারীরা মূঢ়, নিন্দনীয় বলে উপেক্ষিত হয়। ক্রমশ তাদের শক্তি বাড়ে, বিকল্প এক জ্ঞানব্যবস্থা নিয়ে আসে নতুন ব্যাখ্যা, নতুন প্রশ্ন ওঠে, নতুন উত্তরের খোঁজ পড়ে, বদলে যায় বিশ্বকে দেখার ফ্রেম। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জ অবদমিতের থেকেই আসে, এমন তো নয়। প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে ক্ষমতার নানা অলিন্দে।
সুকুমারীর কলম খনিত্রের মতো তুলে আনে এমন সব তর্কের উপাদান। তাঁর বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ বাতিল করে যিনি দেবেন, তিনিও সুকুমারীকে বাতিল করতে পারবেন না। সাধারণের দুর্লঙ্ঘ্য পাঠ থেকে তাদের জীবন পুষ্ট করার বিষয়বস্তু আকর্ষণ করে নিয়ে এসেছেন তিনি, বিলিয়েছেন সবার মধ্যে। তাঁর বিষয়ে তিনি এক ভগীরথ। |
|
|
|
|
|