একটি পরিবার। তিনটি প্রজন্ম। একটি বাঁশের সাঁকো। এই তিনের সর্ম্পক যে কতটা কাছের তার প্রমাণ হিঙ্গলগঞ্জের যোগেশগঞ্জ পঞ্চায়েতের হেমনগর গ্রাম।
গোমতী নদীর ধারে একটি বাঁশ ও বিচালি দিয়ে তৈরি ঘর। পাশেই রয়েছে একটি বাঁশের সাঁকো। যে কোন দিন ওই সাঁকো পারাপার করতে গেলে দেখা যাবে বসে রয়েছেন বৃদ্ধা কি। সাঁকো পাহারা দিচ্ছেন। না। কোন আধাভৌতিক ব্যাপার নেই এর ভিতর। নেই কোনও সরকারি নির্দেশিকাও। শুধুমাত্র প্রাণের টানে দীর্ঘদিন ধরে সাঁকোটি পাহারা দিচ্ছেন হেমনগর গ্রামের গোস্বামী পাড়ার মণ্ডলেরা।
সুন্দরবন লাগোয়া গোমতী নদীর একদিকে হেমনগর ও অন্যদিকে পারঘুমটি গ্রাম। দুই গ্রামে আছে দুটি হাইস্কুল। স্কুল কিংবা বাজার যেতে হলে গোমতী নদী পার হওয়া জরুরী। অনেক বছর আগে অক্ষয় মণ্ডল তাঁর নৌকা করে কোনও পারিশ্রমিক ছাড়াই স্থানীয় বাসিন্দাদের নদী পারাপার করাতেন। অক্ষয়বাবু মারা যাওয়ার পর নৌকা পারাপারের দায়িত্ব নেন তাঁর ছেলে হরিপদ মণ্ডল। কিন্তু কিছু দিন চলার নষ্ট হয়ে যায় নৌকাটি। তখন হরিপদবাবু জঙ্গল থেকে বাঁশ কেটে নিয়ে এসে নিজের উদ্যোগেই নদীর উপরে তৈরি করেন বাঁশের সাঁকো। তারপর থেকে তিনিই দায়িত্ব নিয়ে এলাকার মানুষকে পারাপারে সাহায্য করতেন। কিছুদিন পর হরিপদবাবু অসুস্থ হয়ে গেলে সাঁকো পাহারার দায়িত্ব নেন তাঁর স্ত্রী কমলা মণ্ডল। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৯৫ সালে মারা যান হরিপদবাবু। |
কমলাদেবীও তখন বেশ অসুস্থ। কিন্তু বন্ধ হয়নি সাঁকো পাহারা। দাদু, বাবা, মার দেখানো পথ ধরে সাঁকো পাহারার দায়িত্ব নেন কমলাদেবীর ছেলে স্বপন মণ্ডল ও মেয়ে সুমিত্রা মণ্ডল। ততদিনে ওই লোকমুখে সাঁকোটির নাম হয়ে গিয়েছে ‘বুড়ির সাঁকো’। কিছুদিন পর সুমিত্রার বিয়ে হয়ে যায় উত্তর প্রদেশে। সাঁকো দেখভালের দায়িত্ব আসে স্বপনের উপরে।
কিন্তু তারমধ্যেই সুন্দরবনে ঘটে গিয়েছে আয়লার তান্ডব। ফলে কাজের খোঁজে ভিনরাজ্যে পাড়ি দেয় স্বপন। সাঁকো পাহারার দায়িত্বে ফিরে আসেন কমলাদেবী। তার সঙ্গী হিসাবে পাশে থাকে স্বপনের স্ত্রী সপ্তমী। এখন দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত সাঁকো পাহারার দায়িত্বে থাকেন বৌমা। ভোরে দায়িত্বে থাকেন শাশুড়ি। এখন অবশ্য সাঁকোর রক্ষণাবেক্ষনের জন্য সামান্য কিছু ‘পারানি’ নেওয়া শুরু হয়েছে। সপ্তমী মণ্ডল জানালেন,“আমার শ্বশুর হরিপদবাবু তাঁর বাবাকে মানুষের সুবিধার জন্য সাঁকো পাহারা দিতে নির্দেশ দিয়ে গেছিলেন। আমরা সেই নির্দেশ পালন করছি। তবে এখন বাঁশ, পেরেক প্রভৃতির দাম বেড়ে যাওয়ায় সামান্য অনুদান নিতে বাধ্য হচ্ছি।” ৫০ পয়সা কিংবা ১ টাকা যে যা দেয় তাই নেন বলে জানালেন সপ্তমীদেবী।
তবে আয়লা পরবর্তী সুন্দরবনে এখন কাজের অভাব। তাই এলাকার বেশির ভাগ মানুষ পাড়ি দিচ্ছেন বাইরে। তা ছাড়া অন্যদিক দিয়ে একটি রাস্তা তৈরি হওয়ায় বাঁশের সাঁকোটি এখন খুব বেশি মানুষ ব্যবহার করেন না। কমলাদেবী জানালেন, “এখন দিনরাত মিলিয়ে সব মিলিয়ে ১০-১২ জন মানুষ সাঁকো পারাপার করেন।” স্থানীয় বাসিন্দা দিনেশ গোস্বামী, তাপস রপ্তানরা জানান, “দীর্ঘদিন ধরেই মণ্ডলেরা সাঁকোটি রক্ষা করে চলেছে।” তবে বাঁশের সাঁকোর উপর দিয়ে যাতায়াত করাটা ক্রমশ ঝুঁকির হয়ে পড়ছে বলেও জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কার্তিক জোয়ারদার, রেণুকা মণ্ডল, কাজল মণ্ডলেরা জানালেন, “অসুস্থ মানুষকে নিয়ে ওই সাঁকোর উপর দিয়ে যাতায়াত করাটা খুবই সমস্যার। বর্ষার দিনে সাঁকোতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। সে কারণে অনেকই ঘুরপথে গ্রামে পৌঁছায়। একটি কাঠের সেতু হওয়া খুবই প্রয়োজন।” সমস্যার কথা মেনে নিলেন কমলাদেবীও। তিনি বললেন, “এতদিন আমরা গ্রামবাসীদের সুবিধার কথা ভেবে প্রাণ দিয়ে সাঁকোটিকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষনের খরচ বহন করার ক্ষমতা আমাদের নেই। সরকার যদি সেই ব্যবস্থা করে তাহলে খুব ভালো হয়।” যোগেশগঞ্জ বাজারে জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য রায়মঙ্গল নদী দিয়ে প্রায়ই যন্ত্রচালিত নৌকা গোমতি নদীতে প্রবেশ করে। ওই নৌকাগুলির ধাক্কায় প্রায়ই সাঁকোটি ক্ষতিগ্রস্থ হয় বলেও জানালেন কমলাদেবী। যার ফলে ক্রমশ আরও কঠিন হয়ে পড়ছে সেতুটিকে বাঁচানো।
সেই হিসাবে স্থায়ী রোজগার কিছু নেই। ছেলের পাঠানো টাকাই সম্বল। তাও শুধুমাত্র প্রাণের টানে দিনরাত এক করে সাঁকো পাহারা দিয়ে চলেছেন মণ্ডল পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই ‘অধিকার’ যে তাদের কাছে গর্বের বিষয়। |