যাঁহারা ছটপূজা করেন, সেই সকল গোষ্ঠীর সরকারি কর্মচারীরা এখন হইতে ছটপূজার দিনে ছুটি লইতে পারিবেন। এই উপহার স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কলিকাতা ও মহাকরণকে যদি ছুটি পালনের রাজধানী বলা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তবে ছুটির দেবীও আখ্যা দেওয়া যায়। এই তো সে দিন শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে সরকারি কর্মীদের ছুটির মাঝখানে একটি কাজের দিনকে (২৬ অক্টোবর) ছুটির দিনে পরিণত করিয়া তিনি টানা দশ দিন সরকারি দফতরে কর্মহীনতা ও অবকাশ যাপনের সুবর্ণসুযোগ করিয়া দিয়া রাজ্য সরকারি কর্মীদের কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছেন। এ বার মূলত বিহার ও অংশত ঝাড়খণ্ডের মানুষদের যাপনীয় সূর্য-উপাসনা ‘ছট-পরব’কে ছুটির দিন ঘোষণা করিয়া তিনি রাজ্যে বসবাসকারী বিহারি ও ঝাড়খণ্ডিদেরও ধন্যবাদভাজন হইলেন। এ ভাবেই হয়তো জনসাধারণের এই অংশের সমর্থনও সুনিশ্চিত করিয়া ফেলা গেল।
এই নূতন ছুটির সংযোজনের ফলে পশ্চিমবঙ্গে সপ্তাহান্তিক সরকারি ছুটি সহ কর্মচারীদের বছরে অফিসে না গিয়া বেতন পাওয়ার দিনের সংখ্যা দাঁড়াইল ১৩৮, অর্থাৎ বছরের মোট দিবসের ৩৭.৮ শতাংশ। ইহার মধ্য দিয়া সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ অনুশীলনের একটা পরাকাষ্ঠাও মুখ্যমন্ত্রী রচনা করিয়া ফেলিলেন। তাঁহার সৃষ্ট নজিরে উৎসাহিত হইয়া রাজ্যে বসবাসকারী অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মানুষও অতঃপর তাঁহাদের পূজা-পরবের দিনগুলিতে ছুটি উদ্যাপনের আবদার জানাইতে পারেন। যেমন দক্ষিণবঙ্গের জনজাতীয় মানুষদের পালনীয় টুসু ও ভাদু পরবের দিন সরকারি ছুটি ঘোষণার দাবি উঠিতে পারে। উত্তরবঙ্গের কোচ-রাজবংশীরা নিজস্ব উৎসবের জন্য সরকারি ছুটির দাবিদার হইতে পারেন। অযোধ্যা পাহাড়ের আদিবাসীরা তাঁহাদের শিকার উৎসবের দিনটি ছুটির বায়না ধরিতে পারেন। ইছামতী নদীতে বাইচ প্রতিযোগিতার দিনটিই বা ছুটির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হইবে না কেন? কত মানুষ তো এই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করিতে দূরদূরান্ত হইতে পাড়ি জমান। শান্তিপুরের রাস উৎসব কি কম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা? সপরিবার সেই রাসের মেলা দেখিতেই বা সরকার ছুটি মঞ্জুর করিবে না কেন? মুখ্যমন্ত্রী অতএব আর সকল কাজ ফেলিয়া ছুটির দিন বাড়াইবার কর্তব্যে নিয়োজিত থাকিতে পারেন। রাজ্যে বসবাসকারী মালয়ালমভাষীদের খুশি করিতে তিনি ওনাম উৎসবে ছুটি ঘোষণা করিতে পারেন, তামিলদের খুশি করিতে পোঙ্গল উৎসবের দিন, অসমিয়াভাষীদের জন্য রঙ্গালি ও ভোগালি বিহুর দিন, মরাঠিদের জন্য গণেশ-চতুর্থী, গুজরাতিদের জন্য রামনবমীর দিনগুলিও সরকারি ছুটির তালিকাভুক্ত করিয়া লইতে পারেন।
নিন্দুকেরা বলিতে পারেন, এত ছুটি-ছুটি করিলে কাজের দিন বলিয়া আর কী পড়িয়া থাকে? উত্তরে বলা যায়, কাজের দিন থাকার দরকারই বা কী? কাজ না করিলেই কিংবা চলচ্চিত্র উৎসব, শিল্প-মেলা, বিজয়া সম্মিলনী ইত্যাদি উদ্যাপন করিলেই যদি চলিয়া যায়, তবে খামখা নিত্যদিন অফিসে যাওয়ার একঘেয়ে, বিরক্তিকর পুনরাবর্তনে নিয়োজিত থাকা কেন? তাহার অপেক্ষা যদি সিনেমা-থিয়েটার-যাত্রা-সংস্কৃতিমনস্ক মুখ্যমন্ত্রীর পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া রাজ্যের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর পূজা-পরব উদ্যাপনে শামিল হওয়া যায়, তবে রাজ্যবাসীর মধ্যে এক ধরনের কৃষ্টিগত সংশ্লেষ ও সংহতিও অর্জিত হইতে পারে। সরকারি অফিসে ছুটি থাকিলে যদি লগ্নিকারীরা নিরুৎসাহ হন, শিল্পমন্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে না-পারায় যদি তাঁহাদের নিরুদ্ধ অভিমান জন্মায়, সেটা তাঁহাদের মানসিকতার সমস্যা, রাজ্যের অগ্রাধিকারের সমস্যা নয়। পশ্চিমবঙ্গ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুযোগ্য নেতৃত্বে সরকারি কর্মচারীদের নানাবিধ সুযোগসুবিধা দিতেই থাকিবে। তাহাতে যদি কাহারও গাত্রদাহ হয়, হউক! মুখ্যমন্ত্রী সার বুঝিয়াছেন। তিনি জানেন, আনন্দই ব্রহ্মস্বরূপ। এবং সেই আনন্দের প্রকৃত উৎস অবকাশযাপনেই। আশা করা যায়, অচিরেই তিনি আনন্দের পাত্র পূর্ণ করিবেন। বছরের বাকি কয়টি দিনও ছুটি ঘোষিত হইবে। বাঙালির বারো মাসে তিনশত ছেষট্টি পার্বণ, সুতরাং উপলক্ষের অভাব হইবে না। |