দূষণকে দুষছেন মৎস্যজীবীরা
নদী থেকে গায়েব হচ্ছে স্বাদে কুলীন মাছ
ম্বায় ইঞ্চি দু’য়েক। গায়ে এমন দাগ কাটা, মনে হতে পারে শাড়ি পরেছে। চলতি নাম, বউ মাছ। কিন্তু উত্তরবঙ্গের নদীর এই মাছ শেষ কবে জালে পড়েছে মনে করতে পারছেন না ডুয়ার্সের দোমহনির সত্তরোর্ধ্ব মৎস্যজীবী রামচন্দ্র দাস।
জলপাইগুড়ির রানিরহাটের মধ্য পঞ্চাশের বৈদ্যনাথ দাস জলঢাকায় মাছ ধরেন চার দশক ধরে। বাপ-ঠাকুর্দার সঙ্গে জাল ফেলতে গিয়ে ভ্যাদা, শীলন, বালুচাটা, বড় চাঁদা, পাবদা, বাতাসি, রিঠা, বাঘারির মতো সুস্বাদু মাছেদের সঙ্গে হয়েছিল পরিচয়। তাঁর আক্ষেপ, “কৈশোরে চেনা মাছগুলো গত ১০ বছরে জালে প্রায় ওঠেইনি। দেখা মেলা ভার কাজলি, কুরসা, খাটা, রাইখর, সোনালি আড়, উড়ল, সরপুঁটি মাছেরও।” উত্তরবঙ্গের প্রবীণ মৎস্যজীবীদের একটা বড় অংশের হতাশা, “নদ-নদী থেকে হারাতে বসেছে বোরোলি, বাঁশপাতা, মহাশোল, পাথরচাটার মতো স্বাদে কুলীন মাছেরা।” মালদহের পুনর্ভবা থেকে কোচবিহারের তোর্সা বা বালুরঘাটের আত্রেয়ীপ্রায় সব নদীতে জাল ফেলে দিন গুজরান করা মৎস্যজীবীদের গলায় ওই সুর।
অথচ, উত্তরের মিষ্টি জলের নানা প্রজাতির ‘মিঠে মাছ’-এর চাহিদা চিরকালই। কোচবিহারের মহারানি ইন্দিরা দেবী যখন কলকাতা বা মুম্বইয়ে থাকতেন, তখন তাঁর জন্য বিমানে বোরোলি মাছ পাঠানো হত রাজ পরিবারের তরফে। রাজ-আমল পেরিয়ে বাম আমলেও প্রশাসকের পছন্দের মেনুতে পাকাপাকি ঠাঁই মিলেছিল বোরোলির। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসু তাঁর আপ্ত সহায়ক জয়কৃষ্ণ ঘোষকে বোরোলির স্বাদ চেখে দেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। জয়কৃষ্ণবাবুর স্মৃতিচারণ, “জ্যোতিবাবুই আমাকে প্রথম বোরোলি মাছ খেতে বলেন। খাওয়ার পরে উনি মাছটার স্বাদ কেমন জানতে চেয়েছিলেন। মাছটা খুব ভাল লেগেছিল। বলেছিলাম, ‘দারুণ’।”
উত্তরবঙ্গের নদীতে বিলুপ্তপ্রায় মাছ
বোরোলি, কালবোস, কুর্সা, শোল, মহাশোল, পাবদা, বাছা, বাঁশপাতা, বাতাসি, বোয়াল,
চ্যালা, চিতল, বৌমাছ, তিনকাটা, চাঁদা, মৌরলা, খলিসা, দারিকা, ট্যাপা, পাথরচাটা,
ট্যাংরা, ফলুই, রাইখোর, পিয়ালি, রিঠা, বেলে, ডাগর, আড়, বোয়াল, মৃগেল।

শেষ নিয়মিত দেখা মিলত বছর দশেক আগে।
কিন্তু মৎস্যজীবীদের অভিজ্ঞতা, এখন তিস্তা ও তোর্সায় বোরোলি মেলা ভার। মৎস্য-রসিকদের ক্ষোভ, অন্য মাছের কুচোকে বোরোলি বলে চালানোর কারবার চলছে। তা ছাড়া, বাজারে এখন চালানি মাছের ছড়াছড়ি। তাঁরা বলছেন, “ধ্যুস! উত্তরবঙ্গের নদীর মাছের স্বাদই আলাদা। আমরা চালানি মাছ মুখে তুলতে পারি না।” তাঁরা জানাচ্ছেন, এক দশক আগেও যে বোরোলি মাছ ৬০ টাকা কিলো দরে বিক্রি হত, এখন তার দাম ৩৫০-৪০০ টাকা।
দক্ষিণ দিনাজপুরের আত্রেয়ী নদীতে এক সময় রাইখড়, সোনালি আড় মাছ প্রচুর পরিমাণে মিলত। এখন সে সব মাছ বাজারে নেই বললেই চলে। মালদহে মহানন্দা, টাঙন নদীতে এক সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে মেলা খয়রা, ফলুই, চেলা, চিতল, সরপুঁটি, বেলে, ভাঙন, উরুল মাছ এখন প্রায় দেখাই যায় না। প্রায় সব জেলাতেই এই পরিস্থিতির জন্য নদীর পাশের জমিতে কড়া রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ছড়ানো, দ্রুত গতিতে নগরায়নের ফলে দূষণ বেড়ে যাওয়া এবং মশারি জালের ব্যবহারের (খুব ছোট ফাঁকের এই জাল ব্যবহার করা হলে শুধু পূর্ণবয়স্কই নয়, ধরা পড়ে অপরিণত মাছও। ফলে, মাছের বংশবৃদ্ধির সুযোগ কমে) মতো কিছু কারণ দেখছেন মৎস্যজীবীরা।
‘সারা ভারত মৎস্যজীবী ও মৎস্য শ্রমিক ফেডারেশন’-এর হিসেবে গোটা উত্তরবঙ্গের মৎস্যজীবীর সংখ্যা প্রায় আড়াই লক্ষ। ওই সংগঠনের অন্যতম কর্তা শিবেন পৈতের কথায়, “আমরা সমীক্ষা করে দেখেছি, নদীর গভীরতা কমে যাওয়া, জলে কড়া রাসায়নিক মেশায় মাছ মরছে। তা ছাড়া, মশারি জাল, বিষ তেল ও জলে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে মাছ ধরার প্রবণতা বেড়েছে কিছু লোকের মধ্যে। ফলে, মহাশোল, পাবদা, চিতল, পাথরচাটা, বাঁশপাতা, কুর্সার মতো অন্তত ১৫টি প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। বোরোলি মাছও সঙ্কটে।”
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ২০০৭ থেকে তিস্তা নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিয়ে সমীক্ষা করেছেন। প্রাথমিক ভাবে তাঁরা দেখেছেন, কয়েকটি প্রজাতির মাছ এখন আর উত্তরবঙ্গের নদীতে নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তথা মৎস্য গবেষক সুদীপ বরাট বলেন, “যথেচ্ছ মাছ ধরা হচ্ছে। বাড়ছে নদী-দূষণ। দূষণের মাত্রা বাড়লে মাছ তো বিলুপ্ত হবেই। বর্ষাকাল মাছের প্রজননের সময়। তখন মাছ ধরা চলবে না। নজরদারি বাড়াতে হবে।”
রাজ্য বন্যপ্রাণ বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অনিমেষ বসু জানান, চেপ্টি, চ্যালা, স্বর্ণ চাঁদার মতো কিছু মাছ উত্তরবঙ্গের হাতেগোনা কয়েকটি এলাকায় মেলে। ওই মাছগুলো যাতে ঠিকঠাক বংশবৃদ্ধি করতে পারে, সে জন্য সরকারি কর্মসূচি নিতে মৎস্য দফতরকে অনুরোধ করেছেন অনিমেষবাবু। জলপাইগুড়ির মৎস্য আধিকারিক পার্থসারথি দাস বলেন, “মৎস্যজীবীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ চলছে। ফি বছর নদীতে মাছ ছাড়া হচ্ছে। যে সমস্ত মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে, তার সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন নদীতে সরপুঁটি, ভ্যাদা, চিতল ও মৌরলা মাছ ছাড়ার কাজ শুরু হয়েছে।”
কিন্তু মৎস্যজীবীদের একাংশের বক্তব্য, “সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। নানা দূষণের জন্য প্রতিদিন নদী-খালে মাছ মরে ভেসে উঠছে। মাছ কমায় বাপ-ঠাকুর্দার পেশা ছেড়ে আমাদের অনেকে দিনমজুর হয়ে গিয়েছেন। এমনই চললে, মাছগুলোর মতো আমাদেরও ভিটেছাড়া না হতে হয়!”


বোরোলি রেসিপি
জ্যোতিবাবুর জন্য বোরোলি মাছ রান্না করতেন অধীর দাস। ১৯৯৭ সালে তিনি বন দফতরের পাচক পদ থেকে অবসর নেন। তিনি জানান, মাছ কুটে লেবু, নুন, হলুদ ও লবণ দিয়ে মেখে পাঁচ মিনিট রাখতে হবে। আদা বাটা, সামান্য কালো জিরে ফোড়ন দিয়ে ওই তেলে জিরে বাটা, আদা বাটা, হলুদ, আস্ত কাঁচা লঙ্কা সামান্য জল দিয়ে কম আঁচে সাঁতলাতে হবে। জল শুকিয়ে তেল ভাসলে পরিমাণ মতো ঝোলের জন্য জল ঢেলে ফোটাতে হবে। ফুটন্ত জলে ভাজা মাছ ছেড়ে দু’তিন মিনিট রাখার পরে নামিয়ে পরিবেশন করা হত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.