এক কালে যা ছিল সবুজ দিয়ে ঘেরা, সেখানেই আজ বাতাসের রং ধূসর। নিঃশ্বাসে দূষণের বিষ।
নিঃশ্বাস নিতে পারলে অবশ্য। দুর্গাপুরে এখন বহু ঘরেই হাঁপানিতে রুদ্ধ শ্বাস। টেবিলে ছড়ানো ইনহেলার। মাঝরাতে বাচ্চার নীল হয়ে ওঠা মুখ।
শীত নামছে। বাতাস ভারী হচ্ছে। আরও চেপে বসছে শ্বাসকষ্টের ভার।
পরিবেশ মন্ত্রকের হিসেবে, গোটা দেশে সবচেয়ে দূষিত ২৫টি শহরের মধ্যে দু’টি এই রাজ্যে। একটি কলকাতার উপকণ্ঠে হাওড়া, অপরটি দুর্গাপুর। দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট ও নানা অনুসারী শিল্প তো ছিলই। তার পাশাপাশি গত এক দশক ধরে একের পর এক ছোট কারখানা গড়ে উঠেছে (যার মধ্যে বেশি দূষণ ছড়ানোর জন্য কুখ্যাত স্পঞ্জ আয়রন কারখানাও রয়েছে)। এবং অনেক কারখানার বিরুদ্ধেই দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি না মানার অভিযোগ রয়েছে। পরিস্থিতি এমনই যে, দুর্গাপুরে নতুন করে কারখানা গড়ার ছাড়পত্র দিচ্ছে না পরিবেশ মন্ত্রক।
কিন্তু যা আছে তা-ই যথেষ্ট! একেই শীতের শুরু ও শেষে শ্বাসকষ্টের প্রকোপ বাড়ে। শিশুরা, বিশেষ করে সদ্যোজাতেরা সহজে আক্রান্ত হয়। দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ জ্যোতির্ময় ঘোষ জানান, তিনি আগে অন্যত্র চাকরি করেছেন। কিন্তু দুর্গাপুরের মতো এত শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসা তাঁকে কোথাও করতে হয়নি। তাঁর মতে, “দূষণের কারণে আসানসোল ও দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের বাতাসে অবাঞ্ছিত কণার উপস্থিতি বেশি। তা নিশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুস বা শ্বাসনালীতে ঢুকে বিপদ ডেকে আনছে।” দুর্গাপুরে একটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের চেয়ারম্যান সত্যজিৎ বসুও বলেন, “আমাদের এখানে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দিন-দিন বাড়ছে। দূষণই এর প্রধান কারণ।” |
সম্প্রতি রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় কাঁকসায় এক অনুষ্ঠানে দাবি করেন, বিগত কয়েক মাসে দূষণ রোধে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ করা হয়েছে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রন পর্ষদেরও দাবি, দূষণ রোধে লাগাতার অভিযান চালানো হচ্ছে। জরিমানা ছাড়াও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শহরবাসীর অভিজ্ঞতা অবশ্য অন্য কথা বলছে। তাঁদের বড় অংশের অভিযোগ, রোজই বিভিন্ন কারখানা থেকে গলগল করে কালো ধোঁয়া বাতাসে মিশছে। বিভিন্ন কারখানায় দূষণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র (ইলেকট্রোস্ট্যাটিক প্রসিপিটেটর বা ইএসপি) ব্যবহার করার কথা। তা চালু থাকলে ভাসমান দূষণ-কণা কম পরিমাণে বাতাসে মেশে। কিন্তু বহু কারখানায় তা চালানো হয় না বলে। এতে বিদ্যুতের খরচ কমে, মুনাফা বাড়ে। দূষণ থেকে বাঁচতে সগড়ভাঙ্গা, বিধাননগর, রাতুরিয়া প্রভৃতি এলাকায় বাড়ির জানালা প্রায় সারা দিন বন্ধ রাখেন বাসিন্দারা। বিধাননগরের বাসিন্দা সত্যজিৎবাবুও বলেন, “সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, বারান্দায় কালো আস্তরণ পড়ে গিয়েছে। এ তো রোজকার ব্যাপার।”
চিকিৎসকদের মতে, শ্বাসকষ্টের অন্যতম প্রধান কারণ বাতাসে ভাসমান কণা। এর মধ্যে যেমন ধুলো আছে, তেমনই আছে বিভিন্ন যানবাহন ও কল-কারখানা থেকে নির্গত কার্বন, সিলিকা, অ্যাসবেস্টস, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ ও অন্য ধাতুর আকরিক, কয়লার গুঁড়ো। শ্বাস নেওয়ার সময় বড় কণা আটকে যায় নাসিকা ঝিল্লিতে। ছোট কণা নাকের ভিতরে থাকা মাসকুলার লেয়ারে যে আধা-তরল পদার্থ থাকে, সেখানে আটকে যায়। কিন্তু ২.৫ মাইক্রোন আকৃতির ছোট কণিকা চলে যায় ভিতরে। ট্রাকিয়া হয়ে তা পৌঁছয় ফুসফুসের অ্যালভিওলাইয়ে। নাক দিয়ে টানা অক্সিজেন রক্তে গিয়ে মেশে। কিন্তু ওই সব কণা অ্যালভিওলাইয়েই জমতে থাকে। যত তার সংখ্যা বাড়ে, পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে ফুসফুসের কর্মক্ষমতা। ক্রমে ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটে। হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেয়।
|
সত্যজিৎ বসু
চেয়ারম্যান, দ্য মিশন হাসপাতাল
দূষণ থেকেই দুর্গাপুরে শ্বাসকষ্টের সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।
|
মাধুরী চৌধুরী
গৃহবধূ, হর্ষবর্ধন রোড
আমার স্বামী মৃত্যুর আগে দীর্ঘ দিন শ্বাসকষ্টে ভুগেছেন। এখন আমিও ভুগছি। |
|
চিকিৎসকেরা বলছেন
• বেশি ধোঁয়া-ধুলোয় যাবেন না।
• শীতের শুরুতে ঠান্ডা বা সর্দি লাগা এড়ানোর চেষ্টা করুন।
• যেখানে বেশি দূষণ, অন্তত সন্ধ্যার আগেই
দরজা-জানলা বন্ধ করে দিন।
• ঘরে ধুলো বা ছাইয়ের আস্তরণ জমতে দেবেন না।
প্রয়োজনে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে সাফ করুন।
• শ্বাসকষ্টের সমস্যা বেশি থাকলে রাস্তায়
চলতে-ফিরতে মাস্ক ব্যবহার করুন। |
লক্ষ্মী বাউরি
গৃহবধূ, অঙ্গদপুর
কারখানার গায়েই আমাদের বাড়ি। খুব কষ্ট পাচ্ছি। কী অবস্থা, তা কহতব্য নয়।
|
উমাকান্ত চৈতাল
ব্যবসায়ী, আকবর রোড
আমার ইদানীং শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। দুর্গাপুরের বাইরে কোথাও গেলে আরাম বোধ হয়। |
|
|
|
পরিবেশ দফতরের এক আধিকারিক অবশ্য দাবি করেন, “দুর্গাপুরে আগের থেকে ইএসপি যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। তবে নানা কারণে বাতাসে ভাসমান কণার পরিমাণও বাড়ছে।” তাঁর মতে, ইএসপি ব্যবহার করেও সব ভাসমান কণা আটকানো যায় না। যন্ত্রের সঠিক চালনা বা সামান্য ত্রুটির কারণেও আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন কারখানায় লোহা, সিলিকা, কয়লা প্রভৃতির সুক্ষ্ম গুঁড়ি ডাঁই করে রাখা হয়। সেই কণাও বাতাসে মেশে। কলকাতার মতো মহানগরে বিপুল সংখ্যক গাড়ির জ্বালানি পুড়ে বাতাসে হাইড্রোকার্বন মেশে, যা থেকে চোখ জ্বালা করে। কিন্তু দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের বাতাসে হাইড্রোকার্বন তত বেশি নয়। বরং স্পঞ্জ আয়রণ, ফেরো অ্যালয়, তাপবিদ্যুৎ কারখানা থেকে নির্গত অন্য ধরনের ক্ষতিকর কণা ভেসে বেড়ায়। পরিবেশবিদদের মতে, শিল্পপ্রধান ব্যস্ত শহরে ভাসমান কণার ওড়াউড়ি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি মানলে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
দুর্গাপুরের মেয়র অপূর্ব মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “আমি নিজেও মাঝে-মধ্যে শ্বাসকষ্ট ভুগি। মেয়র হওয়ার পরে বিভিন্ন কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে দূষণ রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ করা ও বৃক্ষরোপণের আর্জি জানিয়েছি। পুরসভার পক্ষ থেকেও বিভিন্ন ক্লাব ও সংগঠনের মাধ্যমে বৃক্ষরোপণ চলছে।”
গাছ পোঁতা জরুরি। কিন্তু দূষণকে উৎসেই বিনাশ করতে না পারলে নাগরিকেরা ফের বুক ভরে শ্বাস নিতে পারবেন কি? |