ব্যান্ডেলের দেবজিৎ বিশ্বাসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে ৭৬ হাজার টাকা উধাও হয়ে যায় গত ফেব্রুয়ারিতে! সেই ঘটনার দু’দিন আগে অকেজো হয়ে যায় দেবজিৎবাবুর মোবাইল। তিন দিন সেই ফোন কাজ করেনি। চতুর্থ দিন নতুন সিম কার্ড নেন তিনি। নম্বর অবশ্য একই থাকে। এর পরই তিনি জানতে পারেন, ওই চার দিনের মধ্যেই নেট-ব্যাঙ্কিং-এর মাধ্যমে তাঁর স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার অ্যাকাউন্টের টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে চলে গিয়েছে।
হাল ছাড়েননি দেবজিৎবাবু। বিহিত চেয়ে প্রথমে পুলিশ, তার পরে ব্যাঙ্ক এবং শেষে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের (আরবিআই) অম্বুড্সম্যানের দ্বারস্থ হন। অম্বুড্সম্যানের নির্দেশে সেপ্টেম্বর মাসে খোয়া যাওয়া টাকা ব্যাঙ্কের কাছ থেকে সুদ সমেত ফেরত পান তিনি। যে কোনও ব্যাঙ্ক (রাষ্ট্রায়ত্ত বা বেসরকারি)-এর ক্ষেত্রে গ্রাহকের কোনও ধরনের অভিযোগ থাকলে এবং ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ গ্রাহককে সন্তুষ্ট করতে না পারলে গ্রাহক অম্বুড্সম্যানের দ্বারস্থ হতে পারেন।
সমস্ত ব্যাঙ্ককেই যেহেতু আরবিআই-এর নিয়ম মেনে চলতে হয় তাই এই অম্বুড্সম্যানের নির্দেশ মেনে চলাটা বাধ্যতামূলক। কলকাতায় আরবিআই-এর অম্বুড্সম্যান মঙ্গল সিংহ সয় বলেন, “ব্যাঙ্ক-জালিয়াতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে যে আরবিআই-এর একটা বিভাগ রয়েছে, তা অনেকেই জানেন না। প্রতারিত হয়েও অনেকে চুপ করে থাকেন।”
আরবিআই-এর হিসেব জানাচ্ছে, ২০১০-২০১১ সালে নেট-ব্যাঙ্কিং প্রতারণার ২০টি অভিযোগ জমা পড়েছিল কলকাতায়। সে বছর প্রায় ১০ লক্ষ টাকার জালিয়াতি হয়েছিল। ২০১১-১২ সালে অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫৬টি। টাকার পরিমাণ ৮৪ লক্ষের বেশি।
নেট-ব্যাঙ্কিং-এ মোবাইল নম্বর নথিভুক্ত করা বাধ্যতামূলক। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, গ্রাহকের অজান্তেই হ্যাকার কম্পিউটারে ঢুকে গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য (যেমন- জন্ম তারিখ, বাবা-মায়ের নাম, ছবি) এবং ফোন নম্বর হাতিয়ে নিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রাহক অচেনা ই-মেল খুলে এই বিপদ ডেকে আনছেন। এর পর মোবাইল সংস্থাকে চুরি করা তথ্য দিয়ে গ্রাহকের ফোন নম্বর সাময়িক অকেজো করে দিচ্ছে হ্যাকার। বলা হচ্ছে, ওই সিম হারিয়ে গিয়েছে। এর পরে হ্যাকার ওই নম্বরের নতুন সিম তুলে নিচ্ছে।
নতুন সিম তোলার সময়ে কোনও এক থানায় করা জাল অভিযোগপত্র এবং গ্রাহকের জাল পরিচয়পত্রও দেখানো হচ্ছে। নতুন সিম হ্যাকারের হাতে চলে যাওয়ায় ইন্টারনেটে টাকা লেনদেনের সময় ব্যাঙ্কের পাঠানো বিশেষ পাসওয়ার্ড হ্যাকারের হাতে চলে যাচ্ছে। তা ছাড়া লেনদেন সংক্রান্ত এসএমএস-ও পাচ্ছেন না গ্রাহক। দেবজিৎবাবুর ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছিল। অম্বুড্সম্যানের মতে, “হ্যাকার-রা তক্কে তক্কে থাকে। কোনও গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে মোটা অঙ্কের টাকা জমা পড়লেই তারা সক্রিয় হয়।”
গোয়েন্দাদের মতে, হ্যাকারদের বেশির ভাগই বিদেশে বসে চক্র চালাচ্ছে। ভারতে তাদের এজেন্ট রয়েছে। সাইবার অপরাধ সমীক্ষা জানাচ্ছে, বিশ্বে প্রতি মিনিটে প্রায় ৮০ জন সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। সাইবার অপরাধের জেরে ২০১১ সালে ভারতে গ্রাহক ও ব্যাঙ্ক মিলিয়ে মোট ক্ষতির পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ব জুড়ে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫৫ লক্ষ কোটি টাকা।
অনেক বিদেশি ভারতে এসেও এই কাজ শুরু করেছেন। দেবজিৎবাবুর মতোই ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতার দেবাশিস দত্তের অ্যাকাউন্ট থেকে ৩ লক্ষ ৯৪ হাজার টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। সেই সময়ে ডায়ালিসিসের জন্য নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন বৃদ্ধ দেবাশিসবাবু। তাঁরও মোবাইল ফোনটি সাময়িক ভাবে অকেজো হয়ে গিয়েছিল। তদন্তে নেমে কলকাতা পুলিশ নবি মুম্বই থেকে দুই নাইজেরীয়কে গ্রেফতার করে।
স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সোদপুর শাখায় রাজেশ সিংহ নামে এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছিল দেবজিৎবাবুর টাকা। তদন্ত করে পুলিশ জানতে পারে, সেই নাম ও ঠিকানা দুই ভুয়ো। কেন পরীক্ষা না করে এমন ব্যক্তিকে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে দিচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আরবিআই। অম্বুড্সম্যান সয়ের কথায়, “নেট-ব্যাঙ্কিং অপরাধের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ অভিযোগ আসছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির বিরুদ্ধে। এই ব্যাঙ্কগুলিকে আরও সতর্ক হতে হবে।” দেবজিৎবাবু বা দেবাশিসবাবুর খোয়া যাওয়া টাকা উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। দু’টি ক্ষেত্রেই গুনাগার দিয়েছে ব্যাঙ্ক।
স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ডিজিএম অমিত বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, নেট-প্রতারণা রুখতে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা নিয়েছেন তাঁরা। ব্যাঙ্ক যখনই জানতে পারছে নেট-ব্যাঙ্কিং-এ নতুন কোনও অ্যাকাউন্ট নথিভুক্ত হচ্ছে, অমনি সেই অ্যাকাউন্টে টাকা স্থানান্তরিত করার উর্দ্ধসীমা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে।
অমিতবাবু বলেন, “প্রথম পাঁচ দিনে ৫০ হাজার টাকার বেশি স্থানান্তরিত করা যাবে না, এমনই নিয়ম চালু করা হয়েছে।” বাকিটা গ্রাহকের সচেতন থাকার উপরেই নির্ভর করছে।
|
|
নেট জালিয়াতি |
• বিশ্বে প্রতি মিনিটে শিকার ৮০ জন |
২০১১-তে ক্ষতি |
|
• ভারতে ৪০
হাজার কোটি |
• বিশ্বে ৫৫ লক্ষ
কোটি টাকা |
|
|
৯ কবচ |
• অচেনা ই-মেল
না খোলা |
|
• প্রাপ্তবয়স্ক সাইটে ঢুকে
ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড
ব্যবহার না করা |
|
|
• ইন্টারনেটে
অচেনা বন্ধু
এড়িয়ে যাওয়া |
|
• অচেনা সাইট থেকে
নেট-ব্যাঙ্কিং মারফত কেনাকাটা এড়িয়ে চলা |
|
• মোবাইল ফোন আচমকা
বিকল হলেই পরিষেবা
সংস্থাকে জানানো |
|
• চার ঘণ্টার বেশি মোবাইল
অকেজো থাকলে
ব্যাঙ্ককে জানানো |
• প্রয়োজনে নেট-ব্যাঙ্কিং অ্যাকাউন্ট সাময়িক বন্ধ রাখা
• নিয়মিত পাসওয়ার্ড বদল
• প্রতারিত হলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করা |
|