শোনা যাচ্ছে হলদিয়ায়। এবং বৃহত্তর পশ্চিমবঙ্গে। এর পিছনে
ভোটের রাজনীতির এক বিকৃত রূপ। রাজ্যের ভবিষ্যৎ? আতঙ্কিত
সুপর্ণ পাঠক |
হলদিয়া বন্দরে কাজ না করতে দেওয়ার কাজিয়ায় এ বার বলি কর্মকর্তাদের পরিবার। রেহাই পায়নি এক বছরের শিশুও। মাঝরাতে তাঁদের তুলে নিয়ে মেচেদা স্টেশনে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে হুমকি সহ। অভিযোগ, পুলিশও নিষ্ক্রিয় ছিল ঘটনা ঘটার পরেও। তা হলে কি এটাই পরিবর্তন?
শিল্পমহল কিন্তু ভাবছেন এ রাজ্যের ভবিতব্য এটাই। এবং তাঁদের এই ধারণা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। শুধু লগ্নি নিয়ে বিবাদ বা হলদিয়ার ঘটনা নয়, রাজ্যের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রশাসনিক চিন্তা ও প্রতিক্রিয়াই ক্রমাগত একটা ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। মাৎস্যন্যায়ের ভয়। আসলে এই পরিস্থিতিটা ভোটের রাজনীতির একটা বিকৃত রূপের পরিণাম। এ রাজনীতিতে গদি টিকিয়ে রাখার নাকি কিছু মৌলিক নিয়ম আছে। তার অন্যতম: প্রতিশ্রুতি দাও, কিন্তু ভুলেও তা কার্যকর কোরো না। উন্নয়নের স্লোগান তোলো, কিন্তু ওই রাস্তায় হেঁটো না। তবে ভাবটা রেখো, যেন, যা বলছ তা-ই করার চেষ্টা করছ। নিন্দুকেরা ইদানীং বলেন, জ্যোতিবাবুর রাজ্যের শীর্ষপদে টিঁকে থাকার মূল মন্ত্র নাকি ছিল এটাই। এর বিপরীতে হেঁটেই সর্বনাশ ডেকে এনেছিলেন বুদ্ধবাবু।
হয়তো। কারণ উন্নয়নের রাস্তায় হাঁটতে গেলে তার চাহিদা মেনে এগোতে হবে। তাতে অনেক কসরত। অনেক অপ্রিয় সিদ্ধান্ত। তাই ওই পথে না হেঁটে স্থবিরতা মেনে নিলে ঝুঁকি কম। দক্ষতার প্রয়োজন শুধু স্লোগানে, ‘যা করছি তা তোমাদের কথা মেনেই করছি’ এই কথাটি ধরে রাখার চেষ্টায়। আর দানছত্রের রাজনীতিতে। |
শ্রমিকের স্বার্থ? হলদিয়া, ২০১২ |
এই রাজনীতির মূল উপপাদ্য হল, ভোটবাক্সে আনুগত্যের উপস্থিতিই গদি বজায় রাখবে। আনুগত্য তৈরির এই প্রক্রিয়ায় মেনে নিতে হয় অনুগতের বিচ্যুতি, তার কাজের ধারা রাজ্যের বৃহত্তর স্বার্থের পরিপন্থী হলেও। আর যে শুধু পেশার প্রতি অনুগত, তাকে মারতে হয়। কারণ সে তো পেশার প্রতি অনুগত থাকবে, দলের প্রতি নয়। দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক সেই আদিকাণ্ড থেকেই। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর পরই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মিডিয়াকে নিয়ে দেখতে গেলেন বাঙ্গুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি। সবার সামনে অপমানিত হলেন সংস্থার ডিরেক্টর, শ্যামাপদ গড়াই। শোনা যায়, দু’টি গর্হিত অপরাধ করেছিলেন তিনি। এক, সর্বসমক্ষে কান ধরে উঠবস করে নেতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেননি। দুই, ‘রোগী দেখতে হবে’ বলে দেখা করার সময় বদলাতে বলেছিলেন। এটা প্রশাসনের চোখে ঔদ্ধত্য।
ফল? শ্যামাপদ গড়াই এখন বেসরকারি চিকিৎসক। ফল? বাঙ্গুরের রোগীরা হারালেন এক জন দক্ষ ডাক্তারের সেবা। তাতে কী? স্লোগানটা তো হল! ‘এই দেখো, তোমাদের কথা ভেবেই এটা করলাম। এদের জন্যই হাসপাতালের এই হাল। উদ্ধত। এরা সাধারণ মানুষকে মানুষ মনে করে না।’ স্লোগানের রাজনীতিতে যুক্তির জায়গা নেই। স্বাস্থ্য দফতরকে দক্ষ করার থেকে শ্যামাপদবাবুকে অপমান করে নিজের কর্মচেতনা প্রমাণ করা সোজা। শ্যামাপদবাবু চলে যাওয়ার পরে এমন কিছু পরিবর্তন হয়নি ওই হাসপাতালের কর্মদক্ষতায়। কিন্তু সাধারণের মনে থেকে গেল ছবিটা।
কী হারাল রাজ্য? যে ক’টি ভাল ডাক্তার এখনও স্বাস্থ্য বিভাগে আছেন, রাজ্য হারাল তাঁদের কাজের প্রতি আনুগত্য। কেন? এ রাজ্যে নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যই চিরকালীন শেষ কথা। পরিবর্তনের নেত্রীও তা-ই বিশ্বাস করেন। কাজের বিনিময়ে এই পুরস্কার কে-ই বা চাইবে? ফলে রয়ে যায় একটাই প্রশ্ন। যে রাজ্যে শ্যামাপদ বাবুদের মতো অভিজ্ঞ পেশাদারদের বিচার রাস্তায় দাঁড়িয়ে করে দেন মুখ্যমন্ত্রী, স্বয়ং সেই রাজ্য প্রশাসন কোথায় দাঁড়িয়ে? রাজ্যের বাইরে বার্তা যায় একটাই। পশ্চিমবঙ্গে পা রাখার আগে ভাবো। পারলে এড়িয়ে যাও।
ধরা যাক অরুণ সিংহের কথা। তিনি সাধারণের সাধ্যের মধ্যে এনে দিয়েছেন সদ্যোজাতকের চিকিৎসা। এই ‘পুরুলিয়া মডেল’ ব্যবহারে আগ্রহী বিভিন্ন রাজ্য, এমনকী ভুটান ও বাংলাদেশও। তাঁর অন্যায়, রাজনীতির প্রতি বেশি অনুগত সহকর্মীকে পাত্তা না দিয়ে তিনি কাজের প্রতি আনুগত্যকে বেছে নিয়েছেন। তিনি এখন অন্যত্র বদলি, টাকা নয়ছয়ের অভিযোগে। না কি, আরও বড় এক ভুল করেছিলেন তিনি? বিশ্বাস করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গেও কাজ করা যায়? এই সব ঘটনা মেধাসম্পদের রাজ্য নিয়ে মেধার ব্যাপারিদের মনেও প্রশ্নচিহ্ন খাড়া করে দিচ্ছে। ভাবমূর্তি ডুবেই চলেছে। প্রশাসন বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে।
আনুগত্যলোভী রাজনীতির এই অঙ্ক লগ্নি ও সুস্থ আর্থিক কর্মকাণ্ডের বিরোধী। লগ্নিকারীদের প্রথম আনুগত্য তাঁদের লগ্নির প্রতি। নিজের টাকা ঢালার পরে যদি তাঁদের এ বি জি-র মতো বার্তা দেওয়া হয় যে, লগ্নি নয়, অনুগতর স্বার্থ রেখে চলতে হবে, তাঁরা কেন রাজ্যের পথ মাড়াবেন? লগ্নি চায় আইনের রাজত্ব। কর্মমুখী প্রশাসন। যে রাজ্যে প্রশাসন বিবশ, সেখানে টাকা ঢালার ঝুঁকি লগ্নিকারী নেবে কেন?
দক্ষিণ ইতালির সিসিলিতেও আস্থা হারিয়েছিল লগ্নি। স্লোগানের রাজনীতি, বিবশ প্রশাসন, স্বাস্থ্য থেকে পুলিশ, সবই পঙ্গু। কোষাগারের টাকায় তৈরি হচ্ছিল থিয়েটার হল, গোটাচ্ছিল কারখানা। কারখানা না হলে চাকরি দেবে কে? আবার চাকরি না থাকলে গদিরও সমস্যা। অতএব দানছত্র। সাড়ে তিন লক্ষ হেক্টর বনের ঘাস তুলতে ৪০ হাজার লোকের মাইনে দেওয়া শুরু হল। এই টাকা আসে কোষাগার থেকে। কিন্তু আর্থিক কর্মকাণ্ড লাভজনক না হলে করদাতার পকেটে টাকা আসবে কোথা থেকে? কেন্দ্রীয় সরকারও এক দিন বেঁকে বসে। বাজার থেকে ঋণ করতে হয়। কিন্তু দেউলিয়াকে কে টাকা দেবে? আর এটাই সময় অসামাজিক মানুষের উপরে উঠে আসার। শুরু হয় বন্দুকের রাজত্ব। গুণ্ডারাজ। বন্দুকের জোর নির্ধারণ করতে থাকে বিনিয়োগের টিঁকে থাকার অঙ্ক। মাফিয়াই হয়ে দাঁড়ায় আসল প্রশাসক।
হলদিয়া বন্দরে যা ঘটছে তা কি সিঙ্গুর-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে সিসিলির উপসংহারেরই পদধ্বনি? |