সুপারম্যান বিশ্বখ্যাত কমিক স্ট্রিপের অতিমানব যিনি অন্য গ্রহ হইতে আসিয়া অবিশ্বাস্য দেহশক্তি ও অসামান্য হৃদয়বত্তার যুগলসম্মিলনে প্রবল সংকট হইতে পৃথিবীর বিপন্নদের ত্রাণ করিতেছেন প্রায় সত্তর বৎসর ধরিয়া, এ বার চাকুরি ছাড়িলেন। না, সুপারম্যানের চাকুরি নহে। উনি যখন সুপারম্যান থাকেন না তখন ‘দ্য ডেলি প্ল্যানেট’ সংবাদপত্রে এক নিরীহ সাংবাদিকের বেশ ধরিয়া ক্লার্ক কেন্ট নামে বিরাজ করেন। মালিকের অন্যায় তর্জনের কালে ক্লার্ক উত্তেজিত হইয়া তাঁহার পদত্যাগের কথা জানাইলেন। কিন্তু কেবল কর্তার প্রতি ক্ষোভ নহে, সিদ্ধান্তের অন্য গভীর কারণ রহিয়াছে। তিনি বলিলেন, ‘আমি এই শিক্ষা ও বিশ্বাস সম্বল করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছিলাম, শব্দের অব্যর্থ ব্যবহার নদীর গতিপথ বদলাইয়া দিতে পারে... কিন্তু আজ সংবাদপত্রে ঘটনার স্থান লইয়াছে মতামত। তথ্যের স্থান লইয়াছে বিনোদন। সাংবাদিকরা হইয়া পড়িয়াছে স্টেনোগ্রাফার। সংবাদ বলিয়া যাহা ইদানীং চলিতেছে, তাহা পড়িয়া কেবল আমিই বীতশ্রদ্ধ তাহা নিশ্চয় সত্য নহে!’ যে ব্যক্তি অন্য অবতার ধারণ করিয়া লাগাতার লাইনচ্যুত ট্রেন বায়ুচ্যুত প্লেন অট্টালিকাচ্যুত শিশু বাঁচাইতেছেন, এক বার কক্ষচ্যুত পৃথিবীকে অবধি আঁকড়াইয়া নিজ পথে ফিরাইয়াছিলেন, এ বার আদর্শচ্যুত সংবাদপত্রকে স্বধর্মে ফিরাইয়া আনিতে চাহিলেন। তাহা অবশ্য গায়ের জোরে সম্ভব নহে। তিনি ভবিষ্যতে নিজস্ব সংবাদপত্র খুলিবেন কি না তাহাও স্পষ্ট নহে। কিন্তু প্রতিবাদটি, বিরক্তিটি, অভিমানটি স্পষ্ট।
সংবাদপত্র অধুনা আপাদমাথা হলুদ বর্ণ রঞ্জিত: অভিযোগ বহু মানুষের। খ্যাত বুদ্ধিজীবী বলিয়াছেন, ইদানীং সংবাদপত্রের তৃতীয় পৃষ্ঠাটিই প্রথম পৃষ্ঠা, অর্থাৎ পেজ-থ্রি সেলেব্রিটির কেচ্ছা-উদযাপন কাগজগুলির মুখ্য কর্মসূচি। পূর্বেও খ্যাত ব্যক্তিদের জীবন ও যাপন লইয়া লোকের উৎসাহ ছিল প্রবল এবং সংবাদপত্র সে উৎসাহকে যথেষ্ট তৃপ্ত করিবার চেষ্টা করিত, কিন্তু এখন যেন কাগজের একমাত্র ধ্যানজ্ঞানই গসিপ লিপিবদ্ধকরণ ও তাহা স্বাদু গদ্যে পরিবেশন। একটি বিখ্যাত কৌতুক-উক্তি: সংবাদপত্রের সম্পাদকের কর্তব্য বহু যত্নে গম ও ভুসি পৃথক করিয়া, ভুসিটি ছাপিয়া দেওয়া। এখন কথাটি রসিকতায় সীমাবদ্ধ থাকিতেছে না, ক্রমেই যেন অনস্বীকার্য সত্যের আকার ধারণ করিতেছে। এক খ্যাত সংবাদপত্রের এই পেজ-থ্রি-প্রবণতার বিরুদ্ধে আর এক সংবাদপত্র সম্প্রতি বিজ্ঞাপন করিয়াছিল: আমাদের কাগজে তিন নম্বর ছাড়াও অন্য পৃষ্ঠা রহিয়াছে, যেমন এক নম্বর, দুই নম্বর, চার নম্বর...
আদর্শ সংবাদপত্রের কর্তব্য কী? বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করিয়া, সে বিষয়ে ঔচিত্য-অনৌচিত্যের দৃষ্টিকোণ আনিয়া পাঠককে শিক্ষিত করা ও সমাজের অন্যায়গুলির প্রতি কর্তৃপক্ষ ও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ। তাহা ছাড়িয়া, কোন মহাতারকা কোন পার্টিতে স্বচ্ছ পোশাক পরিয়াছিলেন ইহাকে কতিপয় সম্পাদক অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাবিতেছেন কেন? উত্তর বহুস্তরী। টেলিভিশনের চটুলতা ও চপলতার (ও তজ্জনিত গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার) সহিত লড়িতে গিয়া বহু কাগজ নিজেকে ‘যুগোপযোগী’ করিতে তরল ছাঁচে ঢালিতেছে। হয়তো, পূর্বে সংবাদপত্র ভাবিত, সাধারণ মানুষের রুচি গড়িবার পবিত্র দায় তাহার রহিয়াছে, এখন সে মনে করে, মানুষের রুচি অনুযায়ী নিজেকে না গড়িলে লক্ষ্মী পলাইবেন। অধিক জরুরি প্রশ্ন: পাঠক কি তাঁহার আদর্শ রক্ষা করিতেছেন? তিনি কি বাজারে তাঁহার অসংখ্য চাহিদা জ্ঞাপনের মধ্য দিয়া এমন সংবাদপত্রই দাবি করিতেছেন না, যা অনেকগুলি রসালো ও স্থূল ‘তৃতীয় পৃষ্ঠা’ প্রত্যহ সাজাইয়া দিবে? তবে এই নীতি ও অর্থনীতি, কর্তব্য ও চলতি প্রবণতা, স্রোতের বিপরীতে চলিবার সাহস ও তলাইয়া যাইবার ঝুঁকি এতগুলি জটিল তরঙ্গাঘাতের মধ্যে হাল ও পাল সামলাইবে কে? সুপারম্যান? তাহা হয়তো ঝটিতি চাকুরি ছাড়িয়া দিবার অপেক্ষা অনেক গুণ শক্ত হইবে! |