এ-ও এক পরিবর্তন!
বাংলাদেশ সংক্রান্ত বিদেশনীতিতে এক নিঃশব্দ রণকৌশলগত পরিবর্তন করল ভারত।
ভারতের আমন্ত্রণে আগামিকাল সাত দিনের সফরে নয়াদিল্লি আসছেন বাংলাদেশের বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বিদেশ মন্ত্রক সূত্র বলছে, সচেতন ও সুপরিকল্পিত ভাবে এই সফরের আয়োজন করা হয়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন আসন্ন। শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া বইছে। ফলে সেখানে যদি ক্ষমতার পালা বদল ঘটে, তার জন্য তৈরি থাকতে চাইছে ভারত। তারা এই বার্তাই দিতে চায় যে, ’৭১-র মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সব রকম শ্রদ্ধা রাখলেও, বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুধু সেই স্মৃতির আবেগ-তাড়িত নয়। খালেদাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারত বুঝিয়ে দিতে চাইছে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামি লিগের সঙ্গে বিএনপি-র যে বিরোধই থাক না কেন, নিরপেক্ষ বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে দুই দলের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায় তারা।
বিএনপি নেত্রীকে আমন্ত্রণের বিষয়টি হাসিনার সরকারকে আগাম জানিয়েও রেখেছে ভারত। দিল্লির তরফে ঢাকাকে বলা হয়েছে, দুই রাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দু’দশের বিরোধী দলের আস্থা অর্জন করা জরুরি। খালেদাকে আমন্ত্রণ করা সেই আস্থা অর্জনেরই প্রক্রিয়া। ভারত এ কথা বললেও এই সফর ঘিরে হাসিনা সরকারের একটা নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। ঘটনাচক্রে খালেদার সফরের সময় দিল্লিতে থাকছেন না বাংলাদেশের হাই কমিশনার তারিক করিম।
বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, কিছু দিন আগে বাংলাদেশের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মহম্মদ এরশাদ ভারতে এসেছিলেন। তখনও হাসিনা সরকার এ রকমই মনোভাব দেখিয়েছিল। তবে তাদের বোঝানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র শেখ আকবরউদ্দিন আজ বলেন, “বেগম খালেদা জিয়ার এই সফর বাংলাদেশের বহু দলভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে ভারতের নিবিড় যোগাযোগের অধ্যায়। এই সফর দ্বিপাক্ষিক সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ করে দেবে। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ককে আরও ইতিবাচক গতি দেবে।”
কংগ্রেস বা বিজেপি, দিল্লিতে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সব সময় সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে এসেছে। ২০০২ সালে কাঠমান্ডুর সার্ক সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার। তখন সদ্য হাঁটু অপারেশন করিয়েছেন বাজপেয়ী। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানতে পারলেন হাঁটুর সমস্যায় ভুগছেন খালেদাও। তাঁকে নিজের চিকিৎসকের ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন বাজপেয়ী।
বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, ভারতের বিদেশনীতি ভারসাম্য রক্ষার পক্ষপাতী। অর্থাৎ, কোনও দেশের সরকারের পাশাপাশি সেখানকার বিরোধী দলকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। পারভেজ মুশারফ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় সে দেশের বিরোধী নেতা নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। বাজপেয়ী আমেরিকা সফরে গিয়ে বিল ক্লিন্টনের পাশাপাশি জর্জ বুশের সঙ্গেও দেখা করতে চেয়েছিলেন। যদিও সময়াভাবে সেই সাক্ষাৎ হয়নি। আবার মায়ানমারে সু চি যখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছেন, তখন তাঁকে সমর্থন করার জন্য ভারতকে অনুরোধ করে আমেরিকা। ভারত সু চি-র সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখলেও সে দেশের জুন্টা সরকারের সঙ্গে তিক্ততা বাড়াতে চায়নি।
শেখ হাসিনার সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে ভারতের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে শুরু করেছিলেন খালেদা জিয়া। বিভিন্ন সময় সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে। কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরেই পুরানো কাসুন্দি ভুলে ভারত-বিরোধিতা লঘু করার একটা চেষ্টা খালেদার পক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছিল বলে বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর। বিশ্বায়ন এবং আর্থিক সংস্কারের যুগে ভারতের বিরোধিতা না করে তাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক পোক্ত করলে বাংলাদেশের জনমতে প্রভাব বেশি পড়বে বলেই মনে করছেন তিনি।
সদ্য পদত্যাগী বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ যখন ঢাকায় গিয়ে খালেদার সঙ্গে বৈঠক করেন, তখনই বিএনপি মুখপাত্র বলেছিলেন যে তাঁরা ভারত-বিদ্বেষী নন। বরং ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান। বিএনপি চায় দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি পাক।
এ বার ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে আলোচনার সময় তিস্তা চুক্তি থেকে শুরু করে টিপাইমুখ বাঁধ, সীমান্তে বাংলাদেশিদের উপর হামলার মতো বিষয় তুলতে চলেছেন খালেদা। নয়াদিল্লিতে হাসিনার সঙ্গে মনমোহন সিংহের যে চুক্তি হয়েছিল, তার রূপায়ণের ব্যাপারেও সরব হবেন তিনি।
চিনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে গত ১৪ অক্টোবর খালেদা সে দেশে গিয়েছিলেন। নয়াদিল্লি যে আওয়ামি লিগের সঙ্গে শক্তিশালী বন্ধুত্বের চিরাচরিত নীতি থেকে খানিকটা সরে এসে বিএনপি-র সঙ্গেও আলোচনার পরিবেশ গড়ে তুলতে চায়, চিন ও পাকিস্তানের সঙ্গে খালেদার সুসম্পর্কও তার একটা বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। ভারত মনে করে বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হলেও রণকৌশলগত দিক থেকে তার গুরুত্ব অনেক।
তাই ভারতের আমন্ত্রণ পেয়ে চিন সফর সেরে ফেরার এক সপ্তাহের মাথায় রবিবার সকাল সাড়ে ন’টায় ঢাকা থেকে জেট এয়ারের বিমানে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দেবেন খালেদা। তাঁর সঙ্গে আসছেন বিএনপি-র স্থায়ী কমিটির সদস্য তারিকুল ইসলাম, ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরি, খালেদার উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, সাবিউদ্দিন আহমেদ, প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান ও নির্বাহী কমিটির সদস্য খালেদা রব্বানি। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এর আগে দু’বার ভারতে এসেছেন খালেদা। তবে বিরোধী নেত্রী হিসেবে এটাই তাঁর প্রথম সফর। গত দু’বারের মতো এ বারও নয়াদিল্লির তাজ হোটেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে রাখা হচ্ছে তাঁকে। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ, বিরোধী দলনেত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন খালেদা। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন, বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাইয়ের সঙ্গেও তাঁর বৈঠকের কথা রয়েছে। |