বালিঘাটের দখল নিয়ে নয়, বরং বেশ কিছু দিন ধরে তৃণমূল আশ্রিত এক দুষ্কৃতী যে ‘দাদাগিরি’ চালাচ্ছে তার জেরেই দশমীর ভোরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে মঙ্গলকোট ও নানুরে। অশান্তির অন্যতম কেন্দ্র, মঙ্গলকোটের লাখুরিয়ার বাসিন্দারা অন্তত তা-ই বলছেন। শুধু বলাই নয়। আজাদ মুন্সি নামে ওই দুষ্কৃতীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে তৃণমূলেরই মদতে পুষ্ট সাইফুল খানের শরণাপন্ন হয়েছেন অনেকে অনুযোগ এলাকার সিংহ ভাগ বাসিন্দার। শুক্রবার রাত পর্যন্ত পুলিশ এক আজাদ-ঘনিষ্ঠকে গ্রেফতার করেছে।
লাখুরিয়া পঞ্চায়েতের বহু বাসিন্দার অভিযোগ, গত মাস ছয়েক যাবৎ ওই এলাকা ও আশপাশে তাণ্ডব চালিয়েছে আজাদ-বাহিনী। ১০০ দিন প্রকল্পের টাকা লুঠ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দোকানে তোলাবাজি, এমনকী গ্রামবাসীদের মারধরও করা হয়েছে। লাখুরিয়া গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে ঝিলেরায় ডেরা গেড়ে সেখান থেকেই ৪-৫টি গ্রামে ‘শাসন’ চালাচ্ছিল তারা। অতিষ্ঠ হয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা তৃণমূল নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ জানান। গত ১৮ অক্টোবর বিকেলে স্থানীয় আটঘরা ফ্লাড সেন্টারে তৃণমূলের লাখুরিয়া সমন্বয় কমিটি বৈঠকও করে। সেখানে গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রথম অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছিল, “আমাদের অঞ্চলে আজাদ মুন্সি যে কোনও কারণে বসবাস করছেন। তিনি আমাদের তৃণমূল দলের সক্রিয় কর্মী।... আজাদ মুন্সি লাখুরিয়া অজয় নদের বালিঘাটের ব্যবসা নিয়ে থাকবেন। গ্রামবাসীদের উপরে কোনও রকম খারাপ ব্যবহার করতে পারবেন না।” |
স্থানীয় সূত্রের খবর, এলাকায় শান্তি বজায় রাখার জন্য তৃণমূল নেতারা বালিঘাটের দখল কার্যত আজাদের হাতে তুলে দেন। এ নিয়ে নতুন কোনও ‘বিতর্ক’ও ছিল না। লাখুরিয়া পঞ্চায়েত এলাকার তৃণমূল সভাপতি কচন শেখের কথায়, “দশমীর সকালে ওই গোলমালের সঙ্গে বালিঘাটের কোনও সম্পর্ক নেই।” আজাদ মুন্সির বক্তব্য, “বালির ঘাটটি যাতে বৈধতা পায়, তার জন্য ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে।” বস্তুত, গণ্ডগোলের সূত্রপাত অষ্টমীর বিকেলে লাখুরিয়া গ্রামে আজাদ-বাহিনীর এক জনের সঙ্গে এক গ্রামবাসীর মারপিট থেকে। পরের দিন বিকেলে আজাদ-বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘শান্তিমিছিল’ বেরোয়। লাখুরিয়া ছাড়াও আশপাশের চাকদা, সিউর, কোটালঘোষ, বারগ্রাম, তালডাঙা গ্রামের বাসিন্দারা তাতে যোগ দেন। আজাদ নিজেও তখন লাখুরিয়ায় হাজির ছিলেন।
এই টানাপোড়েনের জেরেই শেষমেশ দশমীর ভোরে আজাদ-বাহিনীর সঙ্গে সাইফুল-গোষ্ঠীর সংঘর্ষ বাধে। বোমা-গুলির লড়াই ছাড়াও লাখুরিয়া থেকে ঝিলেরা যাওয়ার মোরাম রাস্তা তিন জায়গায় কেটে দেওয়া হয়। রাস্তা কাটা হয় অজয়ের বাঁধের উপরেও। পুলিশ হেঁটে ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর আগেই আজাদ-বাহিনী অজয় পেরিয়ে বীরভূমে ঢুকে পড়ে। সেখানে তৃণমূল আশ্রিত দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষের জেরে আজাদ-ঘনিষ্ঠ এক যুবক এবং এক নিরীহ চাষির মৃত্যু ঘটে। পরে পুলিশ ঝিলেরা গ্রামের প্রাক্তন সেনাকর্মী, আজাদ-ঘনিষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ মণ্ডলকে গ্রেফতার করেছে। বেশ কিছু বোমাও উদ্ধার হয়েছে। কাটোয়ার সার্কেল ইনস্পেক্টর শচীন্দ্রনাথ পড়িয়া বলেন, “মোরাম রাস্তায় গর্ত করে বোমা রেখে তার উপরে পাতা ছড়িয়ে রেখেছিল দুষ্কৃতীরা। বেশ কিছু লোকজনকে খোঁজা হচ্ছে।” এর মধ্যে কেতুগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজের ভাই, বীরভূমের নানুরের বাসিন্দা কাজল শেখের নামও রয়েছে।
তৃণমূল সূত্রের খবর, এক সময়ে পুলিশের তাড়া খেয়ে মঙ্গলকোট গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা আজাদ ও তার দলবলকে আশ্রয় দিয়েছিলেন ঝিলেরা গ্রামে তৃণমূলের বুথ কমিটির সদস্য সাইফুল খান। কিন্তু গোষ্ঠী রাজনীতির অঙ্ক পাল্টে যাওয়ায় বন্ধুত্ব বদলে গিয়েছে শত্রুতায়। এক সময়ে মঙ্গলকোট-কেতুগ্রামের দলীয় পর্যবেক্ষক অনুব্রত মণ্ডলের অনুগামী বলে পরিচিত আজাদ ইতিমধ্যে আনুগত্য বদলে তাদের বিরোধী কাজল শেখের শিবিরে নাম লিখিয়েছেন। সাইফুল থেকে গিয়েছেন অনুব্রত-গোষ্ঠীতেই। এ দিন সাইফুল অভিযোগ করেন, “আজাদের লোকজন এলাকায় অত্যাচার চালাচ্ছিল। আমাদের দলের বেশ কয়েক জন তাতে মদত দিচ্ছিলেন। প্রতিবাদ করায় আমার পরিবার-সহ সাতটি পরিবারকে গ্রামছাড়া করা হয়।” তাঁদের অভিযোগ, পরিবারগুলি কোটালঘোষে আশ্রয় নিলে আজাদ-বাহিনী সেখানেও হামলা করে। লাখুরিয়ার বিভিন্ন দোকানে হুমকি দিয়ে কোটালঘোষের বাসিন্দাদের বিক্রিবাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোটালঘোষের সব্জি বিক্রেতাদেরও লাখুরিয়া বাজারে বসতে দেওয়া হচ্ছিল না।
আজাদ অবশ্য দাবি করেন, “সব বাজে কথা! ষড়যন্ত্র করে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে।” শেখ সাহানেওয়াজের দাবি, “শেখ শাহজাহানের পরিবার নানুর থানায় যে অভিযোগ করেছে, তাতে কারও সই নেই। এ ভাবে অনেকের নামেই মিথ্যা অভিযোগ হচ্ছে।” অনুব্রতবাবু পাল্টা বলেন, “আজাদ মুন্সি টাকার বিনিময়ে খুনখারাপি করে বেড়াচ্ছে। পুলিশ ওর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিক।” কিন্তু এলাকার বহু বাসিন্দার দাবি, আজাদের হাত থেকে বাঁচতেই চাপে পড়ে তাঁরা সাইফুলকে মদত দিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে লাখুরিয়া গ্রামের কয়েক জন বলেন, “ভবিষ্যতে কী হবে জানি না। পুলিশও আজাদকে ধরছে না। এমতাবস্থায় ডাকাত তাড়াতে গিয়ে চোরের হাত ধরতে হয়েছে আমাদের।” মঙ্গলকোটের ওসি দীপঙ্কর সরকারও বলেন, “এক দুষ্কৃতীকে তাড়াতে গিয়ে গ্রামবাসী অন্য দুষ্কৃতীর সাহায্য নিচ্ছেন। কিন্তু এটা মেনে নেওয়া যায় না।” নানুর ও মঙ্গলকোটে খুন, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের উপরে হামলা-সহ অন্তত ১৫টি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও আজাদকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেন? ওসি-র দাবি, “পুলিশ গেলেই ওরা অজয় টপতে বীরভূমে ঢুকে পড়ছে। দুই জেলার পুলিশ মিলিয়ে যৌথ অভিযানের চিন্তাভাবনা চলছে।”
রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে আইনের শাসন কতটা সক্রিয় হতে পারে, প্রশ্ন কিন্তু থেকে যাচ্ছে তা নিয়েই। |