পুস্তক পরিচয় ১...
সাংঘাতিক ইতিহাসের প্রস্তুতি
জোসেফ অ্যান্টন: আ মেমোয়্যার, সলমন রুশদি। জোনাথান কেপ (লন্ডন), ৭৯৯.০০
লমন রুশদির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৯৯-এ। সেই বছরের গোড়ায় তিনি দ্য গ্রাউন্ড বিনিথ হার ফিট উপন্যাস প্রকাশ করেন, এবং জুলাই মাসে কেমব্রিজের এক সাহিত্যসভায় নিজের লেখা পাঠ করে আলোচনায় যোগ দেন। উপস্থিত সকলে পশ্চিমী সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক। ক’দিন ধরে ডরিস লেসিং, হ্যারল্ড পিন্টারের মতো লেখকের সাহিত্য-পাঠ ও আলোচনা শুনে মুগ্ধ হয়েছি। বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে রুশদিকে দেখার এবং শোনার। কিন্তু যখন তিনি কলেজে ঢুকলেন, চোখ চলে গেল তাঁর চারজন দেহরক্ষীর দিকে, যাদের কড়া নজরে কেবল লেখক নন, আমরাও আছি। মনে মনে এদের নাম দিয়েছিলাম, ‘দ্য মেন ইন ব্ল্যাক’। লেখক তাঁর বই থেকে পাঠ করলেন, প্রশ্নের উত্তর দিলেন— কিন্তু কালো পোশাক পরা এই চারজনের উপস্থিতি যেন আর একটি নিহিত কাহিনির ইঙ্গিত বহন করে গেল, যার সম্পূর্ণ রূপ আমাদের অজানা। সেই কাহিনিই আজ রুশদি তুলে ধরেছেন এই স্মৃতিকথায়।
১৯৮৯-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি রুশদির বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয় এবং তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। দীর্ঘ দশ বছর ধরে সেই ফতোয়ার কালো ছায়া তাঁর স্বাভাবিক জীবনকে গ্রাস করে, প্রাণভয়ে তাঁকে নানা স্থানে অজ্ঞাতবাসে কঠিন সরকারি পাহারায় দিন কাটাতে হয়। আমি যখন তাঁকে দেখি, শতক শেষ হতে চলেছে, ফতোয়ার প্রকোপও কিছুটা স্তিমিত। সে বছর ব্রিটিশ সরকার রুশদির জীবন ঘিরে বিপদের আশঙ্কাকে ‘এ’ থেকে ‘বি’ স্তরে নামিয়ে আনে। ২০০০-এ রুশদি ভারত সফরের ভিসা পান, পুত্র জফরকে নিয়ে এ দেশে আসেন, প্রচুর সম্মান ও ভালবাসা পান এ দেশের সাহিত্যিক ও সাহিত্যপ্রেমীদের পক্ষ থেকে। তা-ও, খুব সম্প্রতি জয়পুরের সাহিত্যমেলায় যে নাটক হয়েছিল, তা প্রমাণ করে যে এখনও সঙ্কট কাটেনি, হয়তো কোনও দিনই কাটবে না। তাই এই বইটি পড়া একান্ত জরুরি।
রুশদি বইটিকে ‘স্মৃতিকথা’ আখ্যা দিলেও, রচনায় তিনি উত্তম পুরুষ অবলম্বন না করে আগাগোড়া লিখে গিয়েছেন ‘সলমন’ নামক কোনও ব্যক্তিকে নিয়ে। এ ভাবে তিনি লেখার বিষয়বস্তু থেকে কিছুটা দূরত্ব স্থাপন করতে পেরেছেন। এই জীবনবৃত্তান্তের নাম দিয়েছেন ‘জোসেফ অ্যান্টন’— জোসেফ কনরাড ও অ্যান্টন শেকভ-এর নাম মিলিয়ে সেই অভিশপ্ত সময়ে ব্যবহৃত রুশদির একটি ছদ্মনাম। অথচ কাহিনি একান্ত রুশদির নিজের, অলীক বাস্তব নয়, বাস্তব-ই। জীবনের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি মোড়, সুখ-দুঃখ-ভালবাসা, এক পুত্রের বড় হওয়া, আর এক পুত্রের জন্ম, প্রথম বিবাহ থেকে চতুর্থ বিবাহ কিছুই বাদ পড়েনি। কোন বন্ধু পাশে দাঁড়িয়েছিল, কে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, আবার কার সঙ্গে তর্ক-বিবাদে জড়াতে হয়েছিল, সবই আমরা জানতে পারি। দশ বছর ফতোয়া-নশিন অবস্থায় সলমন রুশদি অন্তত তিনটে বই লিখেছেন, এক পত্নীকে ছেড়ে আর এক জনকে বিয়ে করেছেন, দ্য ভিন্টেজ বুক অব ইন্ডিয়ান রাইটিং সম্পাদনা করেছেন, ছোটবড় নানা ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। খুব কাছের মানুষকে হারিয়েছেন, আবার নতুন কিছু সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। জানার, বোঝার অনেক আছে এই বইয়ে, কিন্তু সর্বোপরি লেখক যা বোঝাতে চেয়েছেন, তা হল সেই প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত অবস্থায় দিন কাটানোর অদ্ভুত চাপ, আত্মগ্লানি, বিষণ্ণতা, একঘেয়েমি।
এক ধরনের একঘেয়েমি কি লেখার মধ্যেও এসে গিয়েছে? এই স্মৃতিকথার যে অংশগুলি আমাকে সবচেয়ে বেশি টেনেছে, তা হল গোড়ার দিকের কাহিনি, ফতোয়া জারির আগের কথা। যেমন রুশদির ছেলেবেলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন, লেখক হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। পিতার সঙ্গে, ছেলে জফরের সঙ্গে, প্রথম স্ত্রী ক্ল্যারিসার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের মর্মভেদী, বেদনাপূর্ণ কিছু বর্ণনা আমরা পাই এই বইয়ে। দীর্ঘ দশ বছরের দুঃস্বপ্ন হয়তো রুশদিকে অনেকটা আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছিল। ঠিক যখন তিনি লেখার গুণে পৃথিবীকে হাতে পেয়েছিলেন, ঠিক সেই সময়ে যেন তাঁর হাত থেকে সেই পৃথিবীকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়, তিনি একা হয়ে গেলেন। আক্ষরিক অর্থে অবশ্য একা হননি, পাশে ছিলেন অনেকেই। তবে যে কোনও লেখকের পক্ষেই এই অভিজ্ঞতা চরম নির্বাসনের সমান, এবং তা এক ধরণের বিকারের সৃষ্টি করে। রুশদির এই আখ্যানে তার ইঙ্গিতও আছে। প্রায়ই, বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে, এই রচনাকে মনে হয়েছে আত্মকেন্দ্রিক, একঘেয়ে, অতি দীর্ঘ। আবার তারই মধ্যে মধ্যে আমরা স্পষ্ট আভাস পাই রুশদির মাহাত্ম্যের। প্রথমটি সাময়িক প্রতিক্রিয়া, দ্বিতীয়টি অনস্বীকার্য সত্য।
সম্মানিত। ‘নাইটহুড’ পাওয়ার পর রুশদি।
বইয়ের গোড়ার দিকে রয়েছে রুশদির ইতিহাস-অধ্যয়নের কথা। কেমব্রিজে পড়াকালীন ইসলাম সম্পর্কে তাঁর পঠনপাঠনের একটি উদ্দেশ্য ছিল ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তাঁর পারিবারিক ধর্মকে দেখা। দ্য সাটানিক ভার্সেস— যে বইটির জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হল মূলত ইসলামের ইতিহাসকে নতুন করে দেখার চেষ্টা। কিন্তু সেই দেখা কল্পনার মধ্যে দিয়ে, রূপকের মধ্যে দিয়ে। তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাসে রুশদি কথার জালে পাঠককে জড়িয়ে ফেলেছেন, ভাষার ছন্দে তাকে সম্মোহিত করেছেন। এই আত্মকথায় বরং তিনি ইতিহাসকে স্ব-মর্যাদা দিতে চেষ্টা করেছেন চেষ্টা করেছেন ‘বর্তমানের ইতিহাস’ লিখতে। হয়তো আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন যে সেই ইতিহাসে বড়-ছোটর সমান স্থানএক-একটা ঘটনা যখন ঘটে, আমরা বুঝতে পারি না কোনটা বড়, কোনটা ছোট। তাই জীবনের দশটি বছরের তুচ্ছতা ও একঘেয়েমিতে ভরা আখ্যানের পর, শেষ অধ্যায়ে রুশদি চলে আসেন ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বরের সেই ঘটনায়, যার ফল পৃথিবীসুদ্ধ মানুষ আজও ভোগ করছেন। ছাত্র হিসাবে রুশদি যে ইতিহাস অধ্যয়ন করেছিলেন, মাঝ-বয়সে তাঁকে যে ইতিহাসের অংশীদার হতে হয়েছিল, সবটাই যেন এই শেষ অধ্যায়ের সাংঘাতিক ইতিহাসের জন্য এক ধরনের প্রস্তুতি।
ইতিহাস, মৃত্যু, ভয়, প্রেম— এ ছাড়া আর একটি মূল বিষয় বইটিতে বার বার ফিরে আসে। তা হল ভারত, এবং সলমন রুশদির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক। রুশদির জন্ম মুম্বই শহরে, ছেলেবেলা কাটে সেখানেই। তাঁর বাবা-মা’র মুম্বই ছেড়ে করাচি চলে যাওয়া ছেলে সলমনের প্রতি যেন এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা। এই বইটিতে তিনি স্পষ্টই বলছেন, ভারত পারে তাঁকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করতে, আবার মুহূর্তে কাছে টেনে নিতে। নিজেকে তিনি ভারতীয় লেখক বলে মনে করেন, যদিও তাঁর জীবনের প্রধান ভাগ কেটেছে ব্রিটেন ও আমেরিকায়। রুশদির এই কাহিনি তাই প্রবাসী ভারতীয়ের কাহিনি, এক ধরনের ছিন্নমূল, ঘরছাড়া, অশান্ত দেশবোধের কথা।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.