বিনোদন উডস্টকের স্মৃতি উস্কে
দিল সান্টানার ম্যাজিক

গোটা শহর জুড়ে ব্ল্যাক ম্যাজিকের ঘোর যেন। গোটা শহরটার দম বন্ধ।
গোটা শহরটা কান পেতে রয়েছে জাস্ট ওয়ান নোট। নিজের সঙ্গীতকে এই তিনটে শব্দেই বর্ণনা করেন মেক্সিকান-আমেরিকান রক গিটারিস্ট কার্লোস সান্টানা। শুক্রবার বেঙ্গালুরুতে তাঁর ভক্তরা কর গুনছিলেন, কখন বেজে উঠবে ওই একটা ঝঙ্কার!
থানিসান্দ্রা রোডের ভারতীয় সিটি। গোটা শহরটার গন্তব্যপথ চলে গিয়েছে ওই মঞ্চটার দিকে। কখন ‘ভ্লাদিভার রক অ্যান্ড ইন্ডিয়া মিউজিক ফেস্টিভ্যালে’ মঞ্চের দখল নেবেন কার্লোস সান্টানা!
ঝুলিতে দশ-দশটা গ্র্যামি। রোলিং স্টোন ম্যাগাজিনের বিচারে বিশ্বের সর্বকালের সেরা ১০০ গিটারিস্টের তালিকায় ১৫ নম্বরে সান্টানার নাম। ভারতে এই প্রথম শো। সান্টানা কিন্তু অকপট, “আমেরিকার পতাকা উড়িয়ে ভারতে প্রতিভার দেখনদারি করতে আমি আসিনি। আমি মনে করি, শুধু মাদার টেরিজা বা গাঁধী নন... আমি, আপনি, আমরা সকলে এই দুনিয়াকে বদলাতে পারি।”
শো শুরুর বেশ খানিকটা আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। তখনই যেন কার্নিভাল শুরু হয়ে গিয়েছে গোটা এলাকা জুড়ে। পুরো এলাকাটাই সবুজে মোড়া। বিনামূল্যে বিলোনো হচ্ছে স্মারক। আর একটা খোলা শামিয়ানা। যার মধ্যে দর্শকদের মধ্যে থেকে যে কেউ গিয়ে গান গেয়ে উঠতে পারেন। দেখা মিলল বেশ কিছু বাঙালিরও। কেউ কেউ আমায় চিনতে পেরে ছবিও তুললেন।
বিকেল ৫টা ৩৬ মিনিট। মঞ্চে উঠল শিলংয়ের ব্যান্ড ‘ইন্ডাস ক্রিড’। ওরাই প্রথম ‘ভারতীয় রক সাউন্ড’ শুনিয়েছিল। ওদের রক গানের অনুপ্রেরণা যে সান্টানাই, মঞ্চ থেকে জানিয়ে দিল ওরা। ওদের প্রথম গানটার নাম ছিল ‘ডিজল্ভ’। পাঁচটা চল্লিশ নাগাদ হঠাৎ দেখি মঞ্চে সান্টানা স্বয়ং। পরনে নানা রঙের ছোপ দেওয়া সাদা জামা আর সাদা ট্রাউজার। মাথায় ট্রেডমার্ক হ্যাট। ওঁকে দেখেই কান ফাটানো চিৎকারের বিস্ফোরণ। তখন উনি অবশ্য শুধুই দর্শক। স্টেজের বাঁ দিকে একটা তাঁবুতে বসে ইন্দাস ক্রিডের দ্বিতীয় গান, ‘হোয়াই ডিড ইউ টেক দ্য মানি’, শুনলেন সান্টানা। এই দু’টো গানই ওরা গাইল ওদের নতুন অ্যালবাম ‘ইভলভ্’ থেকে। তৃতীয় গান, ‘ট্র্যাপড্ ইন মাই বডি’, শুরু হওয়ার খানিক পরেই চলে গেলেন তিনি।
বিকেল ৬টা ৩৬ মিনিট। স্টেজের পিছনের এলসিডিতে ভেসে উঠল সান্টানার বিখ্যাত লোগো। মঞ্চে তখন ওঁর বিখ্যাত পিআরএস গিটার টিউন করা হচ্ছে। মিনিট কুড়ি পরে তানপুরার স্যাম্পল আওয়াজের সঙ্গে সান্টানার গিটারের সঙ্গতে শুরু হল শো। মঞ্চের ২২ গজ দূরে দাঁড়িয়ে সম্মোহিত হলাম ওঁর সেই দুনিয়া মাতানো ‘ওয়ান নোট সাসটেন’-এর জাদুতে।
বেঙ্গালুরুর কনসার্টে। ছবি: এএফপি।
জাদুর অবশ্য তখনও অনেক বাকি। প্রথম গানের নামেই তো জাদু। ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক উওম্যান’। তার রেশ কাটতে না কাটতেই সান্টানার স্বর, “আপনারা আমাদের হৃদয় ছুঁয়েছেন। আমরা এক পরিবার। এক মন। ভালবাসাও এক।” তার পরই বললেন, “আমরা মহিলাদের খুশি করতে ভালবাসি। ওঁরা খুশি হলেই চার দিক সুন্দর হয়ে যায়।” অমনি শুরু হয়ে গেল ‘মারিয়া মারিয়া’। খানিক পরে মঞ্চে বসে পড়ে সান্টানা ঢিমে তালে শুরু করলেন ‘ইউরোপা’। জায়ান্ট স্ক্রিনে ক্যামেরা তখন ক্লোজ-আপে ধরেছে গিটারে সেই জাদু-আঙুল। স্টেজে এলেন বিশ্বখ্যাত সেশনস্ ড্রামার ডেনিস চেম্বারস্। এলেন সান্টানার স্ত্রী সিন্ডি। তিনিও ড্রামার। সান্টানা শুরু করলেন ‘কোরাজোন এসপিনাল্ডো’। বাজাতে বাজাতেই স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, “উনি হাই হিল পরে ড্রাম বাজান”। এর পর একা সিন্ডি। আমেরিকার গায়িকা-অভিনেত্রী হুপি গোল্ডবার্গ রেগে গেলে যেমন লাগবেন তেমনই দেখাচ্ছিল ওঁকে। বাজাতে বাজাতে তিন তিনটে স্টিক ক্ষয়ে গেল। মঞ্চে ফিরলেন সান্টানা। বললেন, “আয়্যাম সো ব্লেসড্।”
পুরো শো’টার বুনোটটাই ছাঁচে ফেলা। তবে মাঝে মাঝেই ছাঁচ ভেঙে দিচ্ছেন সান্টানা। তাতে তাল কাটছে না এতটুকুও। সেই ভেঙে যাওয়া যেন ফের গিটার দিয়ে গড়ে দিচ্ছেন তিনি। কোথাও কোনও গিমিক নেই। নেই কোনও লেসার শো’র কেরামতি। অধিকাংশ ভিনদেশি তারকারাই যেটা করে থাকেন, বিজাতীয় হিন্দিতে ‘নমস্কার’সান্টানা সে সবের ধারও মাড়ালেন না। নমস্কার করলেন নীরবে। সেই নীরবতাই যেন কত বাঙ্ময়।
অনেক ক্ষণ ধরেই অনুরোধ আসছিল ‘জিঙ্গো’র জন্য। অনুরোধ রাখলেন। আফ্রিকান ছন্দ। সান্টানার হাতে খঞ্জনির মতো দেখতে পারকাশ্ন। দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেল এই গানটাই সান্টানা ও এরিক ক্ল্যাপটনকে একসঙ্গে বাজাতে শুনেছি। এখানে এরিক নেই। সান্টানা একাই মাতিয়ে দিলেন।
দর্শকদের নাচ থামছিল না। মঞ্চ থেকে আস্কারা এল। মামাসে মামাসা মামাকুসা। যার মানে, ডোন্ট স্টপ স্টিল ইউ গেট এনাফ। এর পর বাজালেন উডস্টক ফেস্টিভ্যালের সেই বিখ্যাত গান ‘ইভিল ওয়েস’। ১৯৬৯-এর এই গানটাই সান্টানাকে দেয় বিশ্বজোড়া খ্যাতি। অর্গ্যান-হেভি সাউন্ড। আসল গানে এত গিটার ছিল না। এখানে সান্টানা বাড়িয়ে দিলেন। তবে কি-বোর্ডের দীর্ঘ সোলোও রয়েছে। এই গানের পুরনো ভিডিওতে সান্টানাকে নিজে গাইতেও দেখা যায়। এখানে দুই ভোকালিস্টই গাইছিল। তবে ওঁর গিটার কথা বলছিল।
নেশার আবহ পুরো এলাকা জুড়ে। সুরের নেশা। বাতাসে গাঁজার গন্ধ। জায়ান্ট স্ক্রিনে ফুটে উঠছে সব বিখ্যাত কনসার্টের ফুটেজ। ঠোঁট কামড়ে, কোমর বেঁকিয়ে গিটার বাজাচ্ছেন সান্টানা। পিছনে স্ক্রিনে। সামনের মঞ্চে সশরীরে। দু’টো ছবি যেন দু’টো সত্তা। মাঝে মাঝে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে এক হয়ে যাচ্ছে। ঘিরে ধরছে আমাদের।
উনি বাজালেন জন কলট্রেনের ‘আ লাভ সুপ্রিম’। গানের মাঝে মাঝে উল্লেখ করলেন জন লেনন, বিটলস্, বব মার্লে এবং রবিশঙ্করের কথা। বললেন, “হলিউড-বলিউড সবই হল ইলিউশন। সবই ফেক, কৃত্রিম। সবই ফোনি।” এর আগে ভিডিওতে দেখেছি ওনার বাজানো। শুনেছি কান পেতে। কিন্তু এ ভাবে চোখ বুজে ‘প্রোটেস্ট র্যাপ’ করতে কখনও দেখিনি। গানের মধ্যে মধ্যে চোখ বন্ধ করে উনি প্রতিবাদ জানিয়ে গেলেন। অশান্তি, যুদ্ধ, ধ্বংস ও বিভেদের বিরুদ্ধে। জায়ান্ট স্ক্রিনে ডানা মেলছে পায়রা। জামায় লেখা, ‘পিস’।
তার পর শুরু হল ‘স্মুদ’ এবং সান্টানার কাল্ট নাম্বার ‘সোল স্যাক্রিফাইস’। ইদানীংকার শোগুলোতে উনি এটা বাজাচ্ছিলেন না। এটা আমাদের বাড়তি পাওনা। জায়ান্ট স্ক্রিনে গানটার ভিডিও চলতে থাকায় মেজাজটাই বদলে গিয়েছিল। জনতা তখন পাগলপারা। কেউ লাফাচ্ছে, কেউ অন্যকে জড়িয়ে ধরছে, প্রিয়জনকে দিচ্ছে চুম্বন। দুলছে হাজার পনেরো শরীর। ফিরে আসছ
শো’র প্রায় শেষের দিকে তাঁর গিটারে বিটলসে্র সেই দুনিয়া কাঁপানো সুর। ‘হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলি উইপস্’। ফিরতে ফিরতে সত্যিই গাইতে ইচ্ছে করছিল, আরও এক বার চলো ফিরে যাই। সান্টানার সম্মোহনে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.