আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্পনীতির একশো ভাগ সমর্থক। কৃষিতে আনতে হবে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা। দেশের উন্নতি নতুন নতুন শিল্পস্থাপনে। আকবর বাদশার আমলে এক জন চাষির যে-রকম চেহারা বা পোশাক ছিল, ঠেঙো ধুতি বা ছেঁড়া লুঙ্গি, গেঞ্জি থাক বা না থাক, খালি পা, রোগা ডিগডিগে চেহারা, এখনও সেই চেহারাই দেখি, সেই লাঙল। চিরকাল এ রকমই থাকবে? গ্রাম্য মানুষের শীর্ণ শরীর, পেটের রোগের প্রধান কারণ খালি পায়ে হাঁটা, ভিয়েতনামের চাষিরাও পায়ে গামবুট পরে, গায়ে জামা থাকে। বি বি সি-র একটি অনুষ্ঠানে দেখেছি, একটা ফুটবল খেলার মাঠের আকারের জমিতে নব্য প্রথায় চাষে বছরে দশ হাজার মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন করা যায়। চাষির তিন ছেলের মধ্যে দুটি ছেলে যদি কারখানায় কাজ করতে যায়, তা হলেই আর জমি ভাগ হয় না, তার অবস্থা কিছুটা সচ্ছল হতে পারে। কন্যাপণের জন্য জমি বিক্রি কি কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না? তা নিয়ে কোনও আন্দোলন নেই।
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ মার্চ ২০০৭ (নির্বাচিত অংশ)
|
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, এই বামফ্রন্ট এক বার পাঁচ বছরের জন্য বিরোধী আসনে গিয়ে বসলেই বোধ হয় ভাল হয়। তিরিশ বছরে ক্ষমতার একাধিপত্যে তাতে ক্লেদও জমে যায়। তলার দিকে ক্ষমতার পেশি-আস্ফালন ও অর্থ লোভ বেড়ে যায়। সেই সব খারাপ উপাদান থেকে মুক্ত হয়ে, শুদ্ধ হয়ে তাঁরা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুন। কিন্তু এই পাঁচ বছর ক্ষমতায় বসবে যারা, সেই বিকল্পের কথা ভাবলেই বিবমিষা হয়।...
১৪ মার্চের ঘটনায় অনেকেই নিজস্ব ভাবে প্রতিবাদ করেছেন। আমিও লিখিত ভাবে প্রতিবাদ করেছি, সেই সঙ্গে সরকারি শিল্পনীতিরও সমর্থন জানিয়েছি। যেহেতু আমি শুধু কালো রং দেখিনি, তাই আমার প্রতিবাদ অনেকের পছন্দ হয়নি। তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি এখনও প্রয়োজনে কোনও কোনও নীতির প্রতিবাদ জানাব, আবার যুক্তিসঙ্গত মনে হলে সমর্থনও জানাব। |
প্রতিবাদ, প্রতিবাদ! কলকাতা, ১১ নভেম্বর, ২০০৭ |
যেমন, প্রথমেই নন্দীগ্রামে আবার দুঃখজনক হানাহানির ঘটনা ঘটে গিয়েছে বলেই চলচ্চিত্র উৎসব বন্ধ করে দিতে হবে, আমি তা মনে করি না। মর্মাহত হয়েছি বলেই কি আমরা নাওয়াখাওয়া বন্ধ করেছি? গান-বাজনা শুনি না, হাস্য-পরিহাস একেবারে নিস্তব্ধ? চলচ্চিত্র উৎসবের প্রস্তুতি লাগে অনেক দিন, আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারে একটা নির্দিষ্ট দিনে শুরু করতে হয়, বিদেশিরা প্লেনের টিকিট কাটে কয়েক মাস আগে, এ সম্মেলন ঝট করে বন্ধ করে দিলে দেশের বদনাম হয়, পরের বছর কেউ আসে না। একমাত্র প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই বন্ধ করার যুক্তি দিতে পারে। তবু নন্দীগ্রামের ঘটনার জন্য বেশ কিছু শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী প্রতিবাদ করতে চাইলেন। প্রতিবাদ জানাতেই পারেন, সেটা গণতান্ত্রিক অধিকার। পৃথিবীর অনেক দেশেই চলচ্চিত্র উৎসবে কিছু বিরোধীদের প্রতিবাদ হয় সরকারি নীতি, চলচ্চিত্র নির্বাচন কিংবা কর্মকর্তাদের ব্যবহারের বিরুদ্ধে। কিন্তু সে সব প্রতীকী প্রতিবাদ, কোথাও উৎসব বন্ধ করার দাবি করা হয় না। মিছিল আসে, পুলিশ আটকেও দেয়। এখানেও গান গাইতে গাইতে আগত মিছিলকে আটকে দিয়ে পুলিশ পথ উন্মুক্ত রাখলেই পারত, কয়েক জনকে লালবাজারে লক আপে কিছুক্ষণ আটকে রাখার দরকার ছিল না।... যাঁরা সরকার-বিরোধী প্রতিবাদে নেমেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেক অগ্রগণ্য ব্যক্তির মনোভাবে বেশ ‘হোলিয়ার দ্যান দাউ’ মনোভাব দেখা যাচ্ছে। তাঁরাই যেন আদর্শবাদী, স্বার্থত্যাগী, সরকারের কাছ থেকে কোনও পুরস্কার বা সুবিধে পাওয়ার তোয়াক্কা করেন না, আর যাঁরা প্রতিবাদের জন্য তাঁদের পাশে এসে দাঁড়াননি, তাঁরা যেন সরকারের চাটুকার, সুবিধেলোভী ইত্যাদি। এটা বেশ মজার। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তরুণ মজুমদার, এমনকী এই অধমেরও যে সরকারের কাছ থেকে কিছুই পাওয়ার নেই, তা তাঁরা বোঝেন না।...
বাতাসে নানা রকম মিথ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায় এই ভেবে যে হঠাৎ এই যে অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের বাতাবরণ সৃষ্টি হল, তাতে আমাদের এ রাজ্যের উন্নয়ন প্রক্রিয়া থমকে যাবে না তো?...
আমি ঠিক করেছি, আমি আর কোনও দিন কোনও মিছিলে যাব না। আমি না গেলেও কারও কিছু যাবে আসবে না। আমি, বাংলা ভাষার একজন সেবক, এখনও বিবেকের দংশন অসহ্য হলে লেখার মাধ্যমেই প্রতিবাদ জানাব, অথবা সমর্থন জানাব বন্ধুদের, পথে নামার প্রয়োজন নেই আমার।
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ নভেম্বর ২০০৭ (নির্বাচিত অংশ) |