অস্ত্র পুনর্বাসন
জীয়নকাঠির ছোঁয়ায় সাড় ফিরছে শয্যাবন্দি অসাড় জীবনে
ষাট ছুঁইছুঁই বয়স। মাস তিনেকের মধ্যেই চাকরি থেকে অবসর নেবেন। সাদামাটা চেহারাটা দেখলে বোঝার উপায় নেই, শরীরের উপর দিয়ে সদ্য এতটা ঝড় বয়ে গিয়েছে।
“স্পষ্ট মনে আছে। তখনও হাতে স্টিয়ারিং ধরা। শরীরটা কেমন যেন লাগছিল। হঠাৎ মনে হল ডান পা-টা অবশ হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ ডান হাতটাও...।”
গত বছর ১৫ ডিসেম্বর বাস চালাতে চালাতেই স্ট্রোক হয় বিষ্ণুপদ দে-র। সহকর্মীদের সহযোগিতায় প্রাণে বাঁচলেও, অসাড় হয়ে যায় শরীরের ডান দিকটা। চলে যায় বাকশক্তি। বন্ধ চোখের পাতায় বন্দি হয়ে যায় ডান চোখের দৃষ্টি।
‘প্যারালিসিস’ বা পক্ষাঘাত। কোনও রোগ-ব্যাধি বা জরা নয়, রোগের ফেলে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন। আমেরিকান সংস্থা ‘ক্রিস্টোফার ও ডানা রিভ ফাউন্ডেশন’-এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীতে গড়ে ৫০ জন মানুষের মধ্যে অন্তত এক জন পক্ষাঘাতের শিকার। অথচ বিশেষজ্ঞদের আক্ষেপ, পক্ষাঘাত নিয়ে সে অর্থে প্রচার নেই। বিদেশে এর চিকিৎসা বহুল প্রচলিত। কিন্তু এ দেশে কলকাতা, ভেলোর, বেঙ্গালুরুর কিছু চিকিৎসাকেন্দ্র ছাড়া এর চল এখনও নেই। মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতারও অত্যন্ত অভাব। বেশির ভাগ মানুষই জানেন না ঠিক মতো চিকিৎসা করালে পক্ষাঘাত সারিয়ে সুস্থ জীবনে ফেরা সম্ভব।
বিষ্ণুপদবাবু ফিরেছেন। টানা দশ মাসের চিকিৎসায় এখন তিনি প্রায় চাঙ্গা। এক বছরও হয়নি, এর মধ্যেই কাজে যোগ দিয়েছেন। হাঁটাচলা-কথা বলায় আড়ষ্টতা নেই বললেই চলে। বাস আর চালান না। তবে নিয়মিত অফিসে যান। লেখাপড়ার কাজ সামলান।
চিকিৎসা চলছে রিহ্যাবে। ছবি: দেবস্মিতা চক্রবর্তী
চিকিৎসার পরিভাষায় এই প্রক্রিয়াটা রিহ্যাবিলিটেশন নামে পরিচিত। তার জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় সুস্থ হয়ে উঠছেন অনেকেই, দাবি কলকাতার একটি বিশেষজ্ঞ দলের। যার নেতৃত্বে ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশনিস্ট মৌলিমাধব ঘটক।
রামরাজাতলার বাসিন্দা জয়দেব কুণ্ডু মাসচারেক আগে শিরদাঁড়ায় টিউমার নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। অস্ত্রোপচার করাতেই অসাড় হয়ে যায় দু’টো পা। জয়দেববাবুকে বাঁচাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায় তাঁর পরিবার। কিন্তু রিহ্যাবিলিটেশন-এ উঠে দাঁড়িয়েছেন জয়দেববাবু। একটুআধটু হাঁটছেনও। সোজা হয়ে বসতে পারতেন না। এখন তা-ও পারছেন।
স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত থেকেই সাধারণত প্যারালিসিস হয়। বিশেষত স্পাইনাল কর্ড কোনও ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্ট্রোকের পর পিছু নিয়েছে পক্ষাঘাত। এমনিতে মস্তিষ্কের বাঁ দিকের স্নায়ুকোষগুলি শরীরের ডান দিকের চালচলন নিয়ন্ত্রণ করে। আর মগজের ডান দিক চালায় দেহের বাঁ দিককে। তাই মগজের বাঁ দিকে স্ট্রোকের (রক্ত চলাচলে বিঘ্ন) ফলে যদি স্নায়ু অকেজো হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে অসাড় হয়ে যায় শরীরের ডান দিক। ডান দিকে স্ট্রোক হলে ঠিক উল্টো। আবার ডান হাতি মানুষের ক্ষেত্রে ভাবনাকে ভাষা দেয় মগজের বাঁ দিক। ওই অংশে স্ট্রোক হলে শরীরের পাশাপাশি কথাও হারিয়ে যায়। বাঁ হাতিদের ক্ষেত্রে সমীকরণটা উল্টো।
আবার কেউ হয়তো দিব্যি কথা বলছেন, কিন্তু বই কিংবা খবরের কাগজের শব্দগুলো কিছুতেই চিনতে পারছেন না। এ, বি, সি, ডি... সবই ‘বহির্বিশ্বের’। আবার অনেকে চষে ফেলছেন খবরের কাগজ, সারাদিন বুঁদ হয়ে গল্প-উপন্যাসে। কিন্তু স্ত্রী এসে যখন জিজ্ঞাসা করছেন, “কী গো, কেমন আছ?” কয়েকটা শব্দতরঙ্গ ছাড়া কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কারণ শুনে শুনে শব্দ চেনা, আর কাগজের উপর শব্দের আঁচড় বোঝার জন্য মগজের আলাদা আলাদা অংশ কাজ করে। কোন অংশটা বিকল হচ্ছে, তার উপরেই নির্ভর করছে রোগীর উপরে প্রভাব।
পুনর্বাসনের তিন মন্ত্র
• পক্ষাঘাত হয়ে গেলে দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করুন।
• প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শ।
• তাই বাড়িতে রেখে নয়, দরকার রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে ২৪ ঘণ্টার নজরদারি।
‘ন্যাশনাল স্পাইনাল কর্ড ইনজুরি সেন্টার’-এর ডিরেক্টর জেনারেল এ কে মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু সুস্থ জীবনে কী ভাবে ফেরা যায়, তা নিয়ে সে অর্থে সচেতনতা বাড়ছে না।” বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেল্থ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্স’-এর সহকারী অধ্যাপক অনুপম গুপ্তও এ বিষয়ে একমত।
গোটা দেশেই ছবিটা প্রায় একই রকম যে লোকটা দু’দিন আগেই দিব্যি হেঁটেচলে বেড়াতেন, নিয়মিত অফিস যেতেন, সন্ধ্যায় পাড়ায় আড্ডা মারতেন, হঠাৎ পঙ্গুত্বে তাঁর মানসিক জোর ভেঙেচুরে চৌচির। রিহ্যাবিলিটেশন প্রক্রিয়ায় ২৪ ঘণ্টা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দলের কড়া পাহারায় চলে রোগীর মনোবল ফিরিয়ে আনার প্রয়াস আর তার সঙ্গে ছয় থেরাপি। কী রকম? • অকেজো পেশীকোষ ও স্নায়ুকে কাজে লাগাতে ফিজিওথেরাপি বা শারীরচর্চা।
জামার বোতাম লাগানো থেকে শুরু করে, পাতা ওল্টানো, কিংবা কলম ধরা কোনও জিনিসের গতিপ্রকৃতি, ভারসাম্য বুঝে দৈনন্দিন কাজ করতে শেখানো। যাকে বলে অকুপেশনাল থেরাপি।
ইলেকট্রোথেরাপি বিদ্যুৎ তরঙ্গের সাহায্যে পেশীকোষের সাড় ফেরানো।
মনের ভাবনাগুলোকে ভাষায় বদলাতে স্পিচ থেরাপি।
মনের জোর বাড়াতে সাইকোথেরাপি। এবং সবশেষে
কগনিটিভ থেরাপি। একটা গোল আর চৌকো জিনিসের চেহারার তফাত।
একটা পেন ধরতে আঙুলের ভাঁজ কেমন হবে, আর দেশলাই বাক্স ধরতেই বা কেমন, কিংবা সামনে থেকে ছুটে আসা বলটাকে মুঠোয় ধরতে হাত কী ভাবে বাড়াতে হবে। গতিপ্রকৃতির ভারসাম্য ফেরাতেই এই থেরাপি।
“যেমন ধরুন...” এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বললেন, “মণিপুরের এক ভদ্রলোক হৃদরোগে আক্রান্ত হন বছর পাঁচেক আগে। চিকিৎসায় অনেকটাই সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু কিছুতেই সই করতে পারছিলেন না। পেনটাকে কী ভাবে ধরবেন, কতটা জোর দিলে তবে লেখা পড়বে, আঙুলটাকে কী ভাবে ঘোরালে অক্ষরগুলো লেখা সম্ভব এই সব কিছু একসঙ্গে মাথাতে সাজাতেই পারছিলেন না তিনি। অকুপেশনাল ও কগনিটিভ থেরাপির মাধ্যমে তাঁকে সুস্থ করা হল।”
সাড় ফেরাতে কী ভাবে কাজ করে এই থেরাপিগুলো? ধরা যাক, কথা বলার দায়িত্বে মস্তিষ্কের যে অংশগুলো রয়েছে, স্ট্রোকের ফলে সেগুলো অকেজো হয়ে গেল। এ বার ওই কোষগুলোর নীচে বেশ কিছু কোষস্তর এত দিন ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। এক বিশেষজ্ঞের কথায়, “বাবার মৃত্যুর পর ছেলে যেমন সংসারের হাল ধরে, ঠিক তেমনই এই কোষগুলোও কথা বলার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাব। আমরা বিভিন্ন থেরাপির মাধ্যমে ওই কোষগুলোকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করি।”
যে কোনও রোগীই এতে সুস্থ হয়ে যেতে পারে? চিকিৎসকদের মতে, সেটা নির্ভর করে কতটা জায়গা জুড়ে আঘাত, তার উপর। তা ছাড়া, বয়সও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিংবা আঘাতটা কত পুরনো। স্নায়ুবিশেষজ্ঞ সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “রোগী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলে, সঙ্গে সঙ্গে রিহ্যাবিলিটেশনের মাধ্যমে তাঁর চিকিৎসা শুরু করা উচিত। ফেলে রাখা উচিত নয়।” সম্পূর্ণ আগের মতো না-ও যদি হয়, এক জন রোগীকে আংশিক সুস্থতা ফিরিয়ে দেওয়া গেলেও সেটা বড় সাফল্য। রিহ্যাবিলিটেশন সেটা অনেকটাই করতে পারে, দাবি করছেন চিকিৎসকরা।

আমেরিকার উপজাতি পাচ্ছে ‘সন্ত’
ঠোঁটে ছোট্ট একটা ক্ষত থেকেই শরীরে ছড়ায় সংক্রমণ। চিকিৎসকেরাও হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাবা-মা পাঁচ বছরের জেক ফিঙ্কবোনারের অঙ্গ দানেরও চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছিলেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে শরণাপন্ন হন কাটেরি টেকাকুইথার কাছে। তার পরেই নাকি সুস্থ হতে শুরু করে জেক। এই ঘটনাকে ‘অবিশ্বাস্য’ আখ্যা দিয়ে কাটেরিকে ‘সন্ত’ আখ্যা দিতে চলেছে ভ্যাটিকান। এর ফলে এই প্রথম আমেরিকার উপজাতি সম্প্রদায়ের কেউ ‘সন্ত’ হচ্ছেন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.