কান্নার কি শেষ আছে? তবু জীবন তো থেমে থাকে না। বেঁচে থাকার জন্য আবার এই প্রাত্যহিকতায় নিজেকে সঁপে দিতে হয় অন্যদের মতোই। যেমন দিয়েছেন ইব্রাহিম মণ্ডল ওরফে মিন্টু। এ বার ওঁর সঙ্গে আসেনি মনসুর। ১০ বছরের ছেলে। কাঁসরের কাঠি নেড়ে সে-ও তার বাবার সঙ্গে পুজো মণ্ডপের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত। গত তিন বছরে বেশ নজর কেড়েছিল অনেকেরই। ঢাকের তালে কাঁসর বাজিয়ে নিজেও নাচত। গত বছরেই দু’একটা চ্যানেল সরাসরি দেখিয়েছিল খুদে সেই কাঁসর বাজিয়ের ছবি।
ভাগ্যে সইল না সুখ। এ বছর আলোয় মাতাল হওয়া কোনও প্যান্ডেলেই আর কাঁসর বাজাতে দেখা যাবে না তাকে। বর্ষার মুখেই কী এক অজানা জ্বরে আর হাসপাতাল থেকে বাড়িই ফিরল না মনসুর। নাঃ, চোখে আর জল নেই ইব্রাহিমের। কাঁসরটা আলতো হাতে ছুঁয়ে বিড়বিড় করে বলে গেলেন কত কথা। মহালয়ার পরদিনই বাবার হাত ধরে নানা ঢাকির ভিড়ে লালগোলা প্যাসেঞ্জারে বসে মুড়ি-মশলা খেতে খেতে চলে আসত মনসুর। সবার ছোট বলেই ভীষণ ভালবাসত ওকে সবাই। পুজোর ক’দিন আগে থেকেই শিয়ালদহ চত্বরে তাদের অস্থায়ী ডেরা। যতক্ষণ না ডাক আসে কোনও পুজো কমিটি থেকে। পাঁচ বছরে অবশ্য ডাক পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয়নি ইব্রাহিমকে। উত্তর কলকাতার এক পুজো প্যান্ডেলে তিনিই ছিলেন বাঁধাধরা ঢাকি। আর সঙ্গী সেই মনসুর।
দশমীর দু’দিন পরে দল বেঁধে বাড়ি ফেরা। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া মায়ের জন্য পছন্দের শাড়ি। পুজো প্যান্ডেল থেকে পাওয়া একগাদা মিষ্টির প্যাকেট। মনসুরের কাঁসর ঘণ্টায় এখন আর হাত দেওয়ারই কেউ নেই!
কৃষ্ণনগর ছাড়িয়ে ২২ কিলোমিটার দূরে জলঙ্গি নদীর ধারে ইব্রাহিমের বাড়ি। বছরে ৬ মাস ছাতা সেলাইয়ের কাজ করলেও বাকি ৬ মাস ঢাকির কাজ। দুর্গাপুজো থেকে নববর্ষের হালখাতা। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম। কখনও কখনও জেলা শহরেও। শুধু দুর্গাপুজোতেই কলকাতায় আসা।
মনসুর মারা যাবার পরে আর ঢাকের কাঠিতে হাত দিতে চাননি ইব্রাহিম। কিন্তু সে সংকল্প রাখতে পারেননি স্ত্রী পরভিনের অনুরোধে। ওই কাঁসরঘণ্টার মৃদু-তীক্ষ্ন রণনে পরভিন যেন হারানো সন্তানকেই বাঁচিয়ে রাখতে চান। ইব্রাহিম যখন ঢাক বাজাবেন, তখন এক বার না এক বার তো মনে হবে ওই অতটুকু ছেলেটাও যেন তার বাপের পাশে দাঁড়িয়েই মৃদু মৃদু হাসছে বাজনার বোলে! বৃষ্টি নেমেছে ইব্রাহিমের দু’চোখে। “আমার জীবনে এ কোন অভিশাপ!” দুর্গাপুজোর রোশনাইয়ে ঘুরে ঘুরে ফেরে বাবার আর্তি। হাজারো জনতার কানে ঢাকের বোল পাঠাতে পাঠাতে নিজের হারানো ছেলেটার মুখেও এক টুকরো হাসি টানতে চান ইব্রাহিম। ওই হাসির জন্যই তো সব কিছু! |