|
|
|
|
|
|
|
জাস্ট যাচ্ছি |
শুভময় মিত্র |
প্রায় অন্ধকার হলঘরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। ইচ্ছে করেই আলো কমানো রয়েছে। কারণ ছোট স্ক্রিনে প্রোজেকশন করে সিনেমা দেখানো হয়। এক জন ঢুকল, তার পর কিছু হচ্ছে না বলে হন্তদন্ত হয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। ওই ঘরে প্রচুর জাহাজের মডেল আছে। মাস্তুল, পাল, দড়ি, ক্যাপস্টান, ডেক, সব কিছু নিখুঁত ভাবে তৈরি। কাচের বাক্সে ভাসছে আলতো ভাবে। নীচে ছোট্ট প্লেটে লেখা আছে ইতিহাস। মন দিয়ে দেখতে দেখতে পাশের ঘর থেকে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের শব্দ পেয়ে চলে এসেছি, নিশ্চয়ই সিনেমার সাউন্ডট্র্যাক, খুট খুট করে এক জন মহিলা ঢুকলেন,
লং স্কার্ট পরা। তাঁর হাত ধরে আছে ছোট্ট পরি, ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল ঘরে, আলো পড়ল স্ক্রিনে। সাদা-কালো ছবি। ভারী ধারাভাষ্য।
জাহাজের ডেকের ওপর থেকে তোলা ছবি, জাহাজের সামনেটা পাগলের মতো উঠছে, নামছে। এলোপাথাড়ি সমুদ্রের ঢেউ ছোবল মারছে, ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। অদৃশ্য গলা পূর্বাভাস দিচ্ছে খারাপ আবহাওয়ার, সতর্ক করছে আমাদের। কিন্তু স্ক্রিনের মহাপ্রলয়ে বন্দি জাহাজের মধ্যে হুড়োহুড়ির দৃশ্য। মানুষের আর্তনাদ। জাহাজের পাঁজর ভাঙছে, ভেঙে পড়ছে কালো আকাশ। জল থেকে দেখা যাচ্ছে, অসহায় ভাবে হেলে পড়েছে জাহাজ, মাথা নেমে যাচ্ছে নীচের দিকে, ভয়ঙ্কর আগ্রাসী একটা শব্দ ফিরে ফিরে আসছে মহাসমুদ্রের ওপর থেকে। চোখ বুজে ফেললাম। খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল ছোট্ট মেয়ে, ঝকঝকে পরিষ্কার ম্যারিটাইম মিউজিয়ামের মেঝেতে, সেখানে তখন পর্দায় চমকানো বিদ্যুতের ছায়া দেখে আমি শিউরে উঠছি। বেরিয়ে এলাম বাইরে। বৃষ্টিধোয়া, শান-বাঁধানো লিভারপুলের অ্যালবার্ট ডকের ধারে হাসিখুশি ট্যুরিস্ট, দোকানপাট। পাশেই মার্সি নদী। ও পাশটা বার্কেনহেড। লিভারপুল মানেই দ্য বিট্লস। আবার টাইটানিকও বটে। দুভার্গা জাহাজটার রেজিস্ট্রেশন লিভারপুলেই।
চার পাশে অজস্র আর্ট মিউজিয়াম, কাফে, স্যুভেনিরের দোকান। দাঁড়িয়ে পড়লাম ছবির দোকানের সামনে। দরজা খোলা। দোকানদার নেই। র্যাকে, দেওয়ালে সর্বত্র ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। সব ছবিতেই সমুদ্রের ধার, বালি, সূর্যাস্ত আর এক বা একাধিক উলঙ্গ পুরুষ। বিলেতে ইন্টারনেট সস্তা। ফোনেই ছবির ক্যাপশন গুগ্ল করে জেনে নিলাম জল-পুরুষদের গোপন গল্পটা। হাঁটা লাগালাম। দেখতে দেখতে চলেছি সস্তার ময়লাটে দোকানপাট। অন্যমনস্ক, উদাসী বেকার যুবক সরাসরি দেখে যাচ্ছে রংমাখা ফ্যাকাশে মেয়েদের আসা-যাওয়া। অনেক দোকানে লেখা আছে বুকমেকার। জেনে গিয়েছি, এরা বই তৈরি করে না। এ সব বেটিং-এর জায়গা। বড় রাস্তা থেকে ডাইনে-বাঁয়ে ঢুকছে ছোট রাস্তা। উঠে যাচ্ছে। নেমে আসছে। সেখানে দিব্যি চলছে নীলচে সবুজ ডাব্লডেকার বাস। পরিষ্কার সাদা জামা পরে স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছেন মোটাসোটা মেমসাহেব। |
|
ছবি: শুভময় মিত্র |
পুরীতে পৌঁছে ফ্ল্যাগস্টাফ থেকে যেমন প্রথম সমুদ্র দেখা যায়, তেমন সাউথ রোডের শেষ প্রান্তে, ডাইনে ঘুরে বাঁয়ে তাকাতেই বালি চোখে পড়ল। ভুসভুসে বালির মিনি পাহাড়ের মাথায় উঠতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। খুব আনন্দ হলে, দারুণ কোনও প্রাপ্তি হলে, আমার এমন হয়। রোদ নামছে স্লেট-নীল আকাশের মেঘের ধার দিয়ে, সাবধানে, আইরিশ সি-তে। একটু নীচে বিশাল ফাঁকা ক্রসবি বিচ। ছাতা নেই, দোকান নেই, বেলুনওয়ালা, আইসক্রিমওয়ালা নেই। বালির সঙ্গে মাটি আছে। জোয়ারের জল ঢুকে পড়া ছোট ছোট নদী আছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে এ-দিক ও-দিক কিছু মানুষ। খুব আস্তে আস্তে তারা হাঁটছে। আবার কেউ কেউ একেবারে পাথরের মতো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বালিয়াড়ি থেকে নামতে নামতে খেয়াল হল, একেবারে নড়াচাড়া না করা মানুষগুলোর গায়ে একটা সুতোও নেই। এরা সকলেই তাকিয়ে আছে নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের দিকে।
এমন এক জনের কাছে পৌঁছলাম। আমার ছায়াটা পড়ল তার কাছে। সে ঘুরেও দেখল না। বছরের পর বছর রোদে, জলে, সমুদ্রের হাওয়ায় মরচে ধরে গিয়েছে তার সারা শরীরে। নানা ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী বাসা রেখে গিয়েছে চামড়ার ওপর। সবারই গোড়ালি থেকে হাঁটু ডুবে আছে বালির মধ্যে। গোল হয়ে জমে আছে পা-ধোয়া জল। সূর্য ঠিকরে আসছে জলের আয়না থেকে। শূন্য দৃষ্টি চোখে। কোনও চাওয়া নেই, পাওয়া নেই। স্রেফ দেখে যাওয়া, নির্বিকার ভাবে, আর ভেবে যাওয়া।
ইনস্টলেশন আর্টিস্ট অ্যান্টনি গর্মলি-র তৈরি লোহার মূর্তি এ সব। একশোটা আছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে। জোয়ার এলে ডুবে যায়। জল ফিরে এলে জেগে ওঠে। এই শেফটন অঞ্চলে নির্বিকার জলমানবরা অত্যন্ত গর্বের ব্যাপার। ইউরোপ মাত্রেই উদার, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। এক সময় প্রচুর সমালোচনা হয়েছে এদের নিয়ে। শেষ পর্যন্ত জিতে গেছে শিল্পপ্রেমীরা। থেকে গেছে আশা-আকাঙ্ক্ষার ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া উদাস, বাস্তুহীন এক দল নগ্ন মানুষ। আশ্চর্য ভাবে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে একটা জায়গা। এই ইনস্টলেশনের নাম আছে একটা। ‘আনাদার প্লেস’।
দূরে দূরে আরও এমন রয়েছে। অনেকেই কোমর-জলে। বাঁ দিকে লিভারপুল বন্দরের ক্রেন, বুট্ল-এর উইন্ডমিল-রা নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে। এদের চরিত্র এ দেশের মানুষেরই মতো। নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে কাউকে কিছু বলবে না। এক ধরনের স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী এরা। আর অবশ্যই আছে ব্রিটিশ প্রাইড।
হেঁটে হেঁটে অনেকের কাছে গেলাম। সবাই স্থির। সবাই নির্লিপ্ত। কারও চোখের পাতা পড়ে না। এ দেশে এসে আমিও আগ বাড়িয়ে অচেনা কাউকে কোনও কথা জিজ্ঞেস করিনি। করতে পারিনি, নিজের কথাও বলিনি। ইচ্ছে হল কথা বলি এদের সঙ্গে। উত্তর হয়তো দেবে না। কিন্তু শুনবে নিশ্চয়ই। আশেপাশে কেউ নেই। আকাশ আবার কালো হয়ে আসছে। দূরে আয়ার্ল্যান্ডের জাহাজ, চলে যাচ্ছে গভীর সমুদ্রে। আমি এ-দিক ও-দিক দেখলাম। তার পর হাতের ফুলের তোড়াটা এক জনের পায়ের পাতার ওপর জমা জলে আলতো করে ডুবিয়ে রাখলাম। মানুষটার কালো ছায়াটা শিউরে উঠল। স্পষ্ট দেখলাম।
লিভারপুলের বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত হেঁটেই এলাম। বৃষ্টিতে ভিজেও গেলাম কিছুটা। তার পর উঠে পড়লাম চারশো সাঁইত্রিশ নম্বর বাসে। সন্ধে নেমে গেছে। শপিং মলে, পাব-এ আলো ঝলমল, অফিসফেরত লোকজন, চিরবেকার ছোকরা-ছুকরিদের হাসি ঠান্ডা নিয়ন আলোর নীচে। দোতলার বাসের ওপর থেকে দেখতে দেখতে চলেছি আমি। এই বাস মার্সি নদীর তলার টানেল দিয়ে যাবে, উঠবে ও-পারে, তার পর চলে যাবে ওয়েস্ট কার্বির দিকে।
এক সঙ্গে দু’টো চিন্তা চলছিল মাথায়। এক হল আনাদার প্লেস, নির্বাক মানুষগুলো। আর মনে পড়ছিল জাহাজডুবির দৃশ্যটা। মুছে ফেলতে চাইছিলাম ছোট্ট মেয়েটার অকারণ হাসির আওয়াজ। দোতলা বাসের ওপরের প্রথম সিটে বসে দেখলাম বাসটা ঝাঁপ দিল মার্সি নদীর নীচে। ঢুকে পড়ল টানেলে। মাথার ওপর পর পর সরে যাচ্ছে আলো। শব্দ বদলে যাচ্ছে। চোখ বুজে ফেলেছি। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি জলে ভেজা লোহার মানুষগুলোকে। উদ্ভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে জাহাজের ডেকে। কথা বলছে না। হেলে পড়ছে তারা। জাহাজটা হেলে যাচ্ছে জলে ভরে যাচ্ছে সবার দেহ। মাথার ওপর পর পর নিভে যাচ্ছে জাহাজের সব ক’টা আলো। |
|
|
|
|
|