একের পর এক লড়াইয়ে হারতে হারতে এখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। তবুও ওরা ময়দান ছাড়তে নারাজ। করবেনই বা কী? স্টিল কিংবা পিতল কাঁসার গ্লাস, থালা তাদের মাটির তৈরি গৃহস্থালি জিনিসপত্রের বাজার কেড়ে নিয়েছে কবেই। প্রদীপও বেহাত হয়ে গিয়েছে। বাজার ছেয়ে গিয়েছে চিনা বৈদ্যুতিন প্রদীপে। তা বলে সাত পুরুষের পেশা তো তাঁরা ছাড়েননি। বরং পুজোর মুখে ধুনুচি, ঘট তৈরির কাজ বুকে আঁকড়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁরা।
রাঢ় বাংলার বিভিন্ন গ্রামগঞ্জের মতোই কুমোর পাড়ার এই অস্তিতের লড়াই দেখা গেল বাঁকুড়া শহর লাগোয়া সেন্দড়ার কুমোরপাড়ায়। মাটির চাকে ধুনুচি তৈরি করছিলেন প্রৌঢ় অজিত কুম্ভকার। তাঁর চারপাশে রোদে শুকতে দেওয়া অসংখ্য ধুনুচি। সেগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রোদ খাওয়াচ্ছিলেন বাড়ির বাকি লোকেরা। অজিতবাবু বলেন, “জন্ম থেকেই বাপ-ঠাকুরদাদের মাটির কাজ করতে দেখেছি। তখন সারা বছর ভর মাটির হাঁড়ি, কলসি, গ্লাস, থালা থেকে পুজোর উপকরণ তৈরি হত। হাটে গিয়ে বিক্রি করে গেরস্থালি জিনিসপত্র কিনে আনা হত। কোথায় আর সে সব দিন।” তবে আক্ষেপের মধ্যেও প্রৌঢ়ের গলায় কিছুটা উচ্ছ্বাস দেখা গেল। তিনি জানান, এখন মনসা পুজো, সরস্বতী পুজোর মতো কয়েকটি পুজোতে কিছু কাজ পান। তবে সবচেয়ে বড় ব্যবসা হয় দুর্গাপুজোয়। ধুনুচি, ঘট, ভোগের মালসার বিক্রিবাটা মন্দ হয় না। শহরের দোকানদারেরাও কাজের বরাত দিয়েছেন।
কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় সাহায্য করার জন্য দুই মেয়েকে তিনি শ্বশুরবাড়ি থেকে ডেকে এনেছেন অজিতবাবু। জিনিসপত্র রোদে দেওয়া, পোড়ানো, রঙ করার জন্য মেয়েদের দরকার। তিনি বলেন, “স্ত্রী তো হাতে হাতে অনেক কাজ করছেন। কিন্তু কাজের চাপ এ বার বেশি থাকায় মেয়েদের ডেকে পাঠিয়েছি। মালপত্র দোকানে বিক্রি করে, সেই টাকায় ওদের শাড়ি কিনে দেব বলেছি।”
আর এক শিল্পী গুঁইরাম কুম্ভকারে বাড়িতে গিয়েও দেখা গেল তাঁর এখন কথা বলার সময় নেই। শাল ঘরে বসে এক মনে চাকা ঘোরাচ্ছেন তিনি। পাশে তাঁর ১০ বছর বয়সের মেয়ে বৃষ্টি। বাবার হাতে মাটির ডেলা এগিয়ে দিচ্ছিল সে। গুঁইরামবাবু বলেন, “বেশ কয়েক হাজার টাকার অর্ডার পেয়েছি। কাজ শেষ না করা পর্যন্ত কেনেকাটা করতে পারছি না। এ দিকে মেয়ে রোজ নতুন জামা কিনে দেওয়ার জন্য বায়না ধরছে।” ওই গ্রামেরই শিল্পী স্বপন কুম্ভকার, দেবীপ্রসাদ কুম্ভকার, অজয় পালরাও এ বার পুজোয় বেশি বরাত পেয়েছেন বলে জানালেন। তবে পুজোর দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই তাঁদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। আক্ষেপের সুরে বললেন, “দিন-রাত এক করে কাজ শেষ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিক জুটছে না। সব কিছুর দাম বাড়ছে, কিন্তু আজও ধুনুচির দাম সেই ৩-৫ টাকায় থমকে রয়েছে।” |