সরকার নয়। সিন্ডিকেট নয়। ইউনিয়নও নয়। বাসভাড়া বাড়াল আমজনতাই। সরকারি নীতির তোয়াক্কা না-করে জনতাই শেষ পর্যন্ত সুরাহার রাস্তা খুঁজল। যার জেরে সরকারের সামনেও মুখরক্ষার একটা পথ খুলে গেল বলে মনে করছে প্রশাসনের একাংশ।
রাজ্য সরকারের দাবি, সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা ভেবেই বাসভাড়া বাড়ানো হচ্ছে না। অথচ এই নীতি অবাস্তব বলে অভিযোগ তুলেছে সাধারণ মানুষের একাংশই। তাদের আরও অভিযোগ, এর মাসুল সাধারণ মানুষকেই পোহাতে হচ্ছে। বিশেষত ডিজেলের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির পরেও যাত্রিভাড়া না-বাড়ায় বাড়তি খরচের ধাক্কায় একের পর এক বেসরকারি বাস রাস্তা থেকে উঠে যাচ্ছে। কখনও অটোরিকশায় বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে, কখনও বা দশগুণ টাকা দিয়ে নিরুপায় যাত্রীকে চড়তে হচ্ছে ট্যাক্সিতে। কখনও আবার অটো-ট্যাক্সিও না-পেয়ে প্রাইভেট গাড়ির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হচ্ছে।
সব মিলিয়ে আমজনতারই ভোগান্তির একশেষ। তাই তিতিবিরক্ত হয়ে বেসরকারি বাসের ভাড়া বাড়াতে রীতিমতো সংগঠন গড়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন দক্ষিণ শহরতলির দু’টি বাসরুটের নিত্যযাত্রীরা। তাঁদের চাপে শেষমেশ সরকারি নীতির উল্টো পথে গিয়ে বেসরকারি বাসের বাড়তি ভাড়া অনুমোদন করেছে খোদ দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিবহণ দফতর। আপাতত পরিবহণ দফতরের সিলমোহর লাগানো সেই বর্ধিত ভাড়া-তালিকা টাঙিয়ে নিয়মিত বাস চলছে দুই রুটে। এতে বাস-মালিকরা সন্তুষ্ট, যাত্রীরাও খুশি। আর তাঁদের দেখে এলাকার আরও কয়েকটি রুটের বাসযাত্রীরা একই পথে চলতে চাইছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে।
রাজ্য পরিবহণের কর্তারা জানিয়েছেন, নিত্যযাত্রীদের চাপে পড়ে আমতলা-বজবজ রুটে দু’টি বেসরকারি বাসের ভাড়া বাড়াতে জেলা পরিবহণ দফতর বাধ্য হয়েছে। ৭৬/১ এবং এসডি ৩০/১ এই দুই রুটে নতুন ভাড়ার তালিকাও অনুমোদন করা হয়েছে। এ হেন বেনজির কাণ্ড হল কী ভাবে? |
দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর: একের পর এক বাস উঠে যাওয়ায় নিত্যযাত্রীরা ঘোর বিপাকে পড়েছিলেন। আমতলার বহু লোক বজবজের বিভিন্ন কারখানায় কাজ করেন। যাঁদের এক জন হলেন নিমাই মণ্ডল। ওঁর মুখেই শোনা গেল সেই ভোগান্তির বিবরণ “ভাড়া বাড়েনি বলে বাস দিন দিন কমছিল। তখন অটোই ভরসা। প্রথমে আমতলা থেকে বাখড়াহাট যেতাম আট টাকায়। ওখান থেকে দশ টাকা ভাড়া দিয়ে অটোয় চড়িয়াল। তার পরে বজবজের অটো, ভাড়া সাড়ে চার টাকা।” এ ভাবে একুশ কিলোমিটার যেতে ওঁদের রোজ সাড়ে বাইশ টাকা লাগছিল। উপরন্তু ছিল কিছু অটোচালকের জুলুম। “রাত-বিরেতে ওরা মর্জিমাফিক ভাড়া হাঁকে। চলেও ইচ্ছেমতো। আমাদের সময়ের যেন কোনও দামই নেই! ব্যাপারটা সহ্যের বাইরে চলে যাওয়ায় আমরা সকলে মিলে ঠিক করলাম, বাস-মালিকদের সঙ্গে কথা বলব। আমরাই বেশি ভাড়া দেব।” জানান নিমাইবাবু।
স্থানীয় সূত্রের খবর: নিজেদের নিত্য দুর্ভোগ অবসানের এই তাগিদেই আমতলা-বজবজ রুটের যাত্রীরা একটি সংগঠন তৈরি করেন, যেটি অরাজনৈতিক বলেই দাবি। শুরু হয় ভাড়া বাড়িয়ে বাস চালানোর আন্দোলন। দফায় দফায় প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে চিঠি দেওয়া হয়। সংগঠনের সভাপতি, সাতগাছিয়া-চাউলখোলার বাসিন্দা প্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “বাস-মালিকরা জানিয়েছিলেন, বাড়তি ভাড়া পেলে ওঁরা বাস চালাতে রাজি। কিন্তু প্রশাসনের কর্তারা অনুমতি দিতে চাননি। বাধ্য হয়ে আমরা পথ অবরোধের সিদ্ধান্ত নিই।” এতে প্রশাসন চাপে পড়ে যায়।
প্রদীপবাবুদের বাসভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলনে সামিল হয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারাও। তৃণমূলের বজবজ ব্লক সভাপতি স্বপন রায় বলেন, “গত দু’-তিন মাসে আমরা বেশ কয়েকটা বৈঠক করেছি। বাসভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছি আরটিও-কে। যাত্রীদের চাপে শেষে ওঁরা নতুন ভাড়ার তালিকা প্রকাশ করেছেন।” স্থানীয় বিডিও অমর বিশ্বাসও সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। “আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল জনসাধারণকে বাস-পরিষেবা দেওয়া। এখন বাস চলছে। এতে আমরা খুশি। ভাড়া কম না বেশি, এ সব ঠিক করার এক্তিয়ার আমার নেই।” বলেন অমরবাবু। দুই রুটের নতুন ভাড়া-তালিকায় যাঁর অনুমোদন রয়েছে, জেলার সেই আরটিও (আঞ্চলিক পরিবহণ অফিসার) চপল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “বিডিও, ব্লক সভাপতি ভাড়ার ব্যাপারে একটা খসড়া-প্রস্তাব পাঠান। নতুন চার্ট হয়েছে তারই ভিত্তিতে।”
কিন্তু রাজ্য সরকারের নীতির বিপরীতে হেঁটে জেলা পরিবহণ দফতর এই যে বেসরকারি বাসের ভাড়াবৃদ্ধিতে সম্মতি দিল, সরকারি কর্তারা একে কী চোখে দেখছেন? |
|
রুট ৭৬/এ |
রুট এসডি-৩০/১ |
ভাড়া* |
ছিল |
হল |
ছিল |
হল |
ন্যূনতম |
৪ |
৪ |
৪ |
৪ |
সর্বোচ্চ |
৮ |
১২ |
৮ |
১৩.৫০ |
স্তর |
৪টি |
১৮টি |
৫টি |
২২টি |
* অঙ্ক টাকায় |
|
রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “এমন কিছু হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। সরকার ভাড়াবৃদ্ধির অনুমতি দেয়নি। তবে আমি চাই, মানুষ বাস-পরিষেবা পান।” রাজ্যের পরিবহণ দফতরের কর্তাদের একাংশের মতে, দক্ষিণ শহরতলির দু’টো রুটে যা হল, তাতে আখেরে রাজ্য সরকারেরই সুবিধা হয়ে যাবে। এক কর্তার কথায়, “এ বার সরকার বলতে পারবে, জনতার ইচ্ছেতেই বাসভাড়া বেড়েছে। ভাড়াবৃদ্ধির দায় সরকারকে নিতে হবে না।” এ প্রসঙ্গে নতুন ‘ব্র্যান্ডের’ দৌলতে ঘুরপথে সরকারি দুধের দাম বাড়ানো বা ট্যাক্সির নৈশ-ভাড়াবৃদ্ধির ঘটনাও টেনে এনেছেন কিছু সরকারি অফিসার। তাঁদের বক্তব্য, “আমতলা-বজবজের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্য রুটের যাত্রীরাও যদি বাড়তি ভাড়া দিতে চান, তা হলে পরিবহণ দফতরের কিছু বলার থাকবে না। বরং লাভই হবে। এক দিকে পথে বাস বাড়বে, অথচ সরকারকে নীতিভ্রষ্ট হতে হবে না!”
বস্তুত, যাত্রীদের তরফে তেমন দাবির ইঙ্গিত ইতিমধ্যে মিলতেও শুরু করেছে। ৭৬/এ রুটের বাস-মালিক সংগঠনের প্রাক্তন সম্পাদক সৌমেন তালুকদার বলেন, “আরও পাঁচটা রুটে বেসরকারি বাসের যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া দিয়ে পরিষেবা চালু রাখতে চাইছেন। রুটগুলো হল ১২সি, এসডি-৫, এসডি-১৯, এসডি-১৬ ও ২৩৫।” জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটসের যুগ্ম সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “যাত্রীরাও বুঝে গেছেন, ভাড়া না-বাড়ালে বাস বসে যাবে।”
আন্দোলন সফল হওয়ার পরে আমতলা-বজবজের যাত্রীদের কী প্রতিক্রিয়া? স্বপনবাবু বলেন, “এখন অটোর খরচ অর্ধেক হয়ে গেছে। বর্ধিত ভাড়া কমাতে বাধ্য হয়েছে তারা। এতে সবাই খুশি।” কিছু যাত্রী জানিয়েছেন, আরও ভাল বাস-পরিষেবার জন্য যদি আরও বেশি ভাড়া লাগে, তাঁরা তা-ও দিতে তৈরি। |