ব্যাগ গুছিয়ে...
থ ভুলে বনে হারিয়ে যাওয়া নয়। তা নিয়ে অনেক রহস্য-রোমাঞ্চের গল্পগাথা আছে। বরং বনভ্রমণে গিয়ে নতুন জায়গা আবিষ্কারের রোমাঞ্চই আলাদা। ঠিক যেমনটি ঘটেছিল মাথানগুড়ির জঙ্গলে।
বহু বছর আগে কামরূপ এক্সপ্রেসে বরপেডা রোডে নেমে যখন সেই জঙ্গলে পা ফেলেছিলাম, বাতাসে তখনও বারুদের গন্ধ। আমাদের অজানা থাকলেও স্থানীয় মানুষজন বেশ অবাকই হয়েছিলেন রাতের বেলায় রক্ষীবিহীন সেই পদযাত্রার কথা শুনে। বরপেডা রোডের বাজার থেকে যাবতীয় রেশন নিয়ে রাতের নিঃশব্দ নিঝুম পথ-পরিক্রমায় ভয় যে হয়নি, এমনটা নয়। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলেন বাঁশবাড়ির রেঞ্জার। রক্ষীবিহীন সেই পথে বন দফতর কী ভাবে যাওয়ার অনুমতি দিল, তা ভেবে। যাই হোক, বাঁশবাড়ি থেকে সশস্ত্র প্রহরীর ব্যবস্থা করে আমাদের জঙ্গলে ঢোকার অনুমতি দিয়েছিলেন। চেক গেট দিয়ে জঙ্গলের কোর এলাকা হয়ে মাথানগুড়ি বাংলোর দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। যদিও বাকি পথটুকুতে কিছুই হয়নি। কেবল বনের ঝোপঝাড়ে ছোট ছোট আগুনের গোলার মতো, কখনও বা নীল গুলির মতো আলো নড়াচড়া করছিল। ভয়ে কে যেন বলেছিল, “ওগুলো হল আলেয়ার আলো! এই জঙ্গলে নিশ্চয়ই জিন আছে!” চালক হেসে পরিষ্কার বাংলায় বলেছিলেন, ‘‘বাবুমশাই, যা দেখছেন, তার বেশির ভাগই হরিণের চোখ। রাতে আবছা আলো পড়লেই অমন জ্বলজ্বল করে।”

তার পর অনেক বছর পার করে আবারও মানসে যাওয়ার সুযোগ হল। এ বারের যাত্রা রাতে হলেও ভয়ের কোনও কারণ ছিল না। কারণ, মানস এখন সুরক্ষিত। তবু রাতে পৌঁছনোর জন্য অন্ধকারে ভাল করে বুঝতে পারিনি। পর দিন ভোরের বেলায় মুগ্ধ করেছিল মাথানগুড়ির বনবাংলো। তার নিসর্গ। বাংলোর নীচ দিয়ে বয়ে চলা নদী। তার দু’ধারে নুড়ি বিছানো পথ। আর অদূরে ভুটানের নীল পাহাড়ের হাতছানি। অজস্র পাখির কলতান আর নদীর কলধ্বনি। অবাক হয়ে দেখছিলাম, এতটুকু কম পড়েনি বনবাংলোর পারিপার্শ্বিক পরিবেশে। কেবল নদীর ধারে কাচ-ঘেরা ডাইনিং হলটি আর নেই। অন্যত্র ক্যান্টিন তৈরি হয়েছে। এখন আর রেশন নিয়ে যেতে হয় না পর্যটকদের।
কেবল লক্ষণীয় ভাবে বেড়েছে ঘরভাড়া। আপার বাংলোর ঘর ২০০ থেকে এক লাফে বারোশো টাকা! বেড়েছে বেশ কয়েকটি বিট অফিস। বেড়েছে বন্যপ্রাণ। অজস্র হাতি, বাইসন, হরিণ। বাঘের দেখা না পাওয়া গেলেও সম্ভাবনা যে আছে, বেশ বোঝা যায়। অজস্র প্রজাপতি, পাখি তো আছেই। যেমন আছে বৈঁকি নদীর মিষ্টি মাছ। নদীর ও পারে ভুটানের জঙ্গলে গোল্ডেন লেঙ্গুর। তবে, এলিফ্যান্ট-রাইড করতে করতে বুনো মোষ বা বুনো কুকুরের সামনাসামনি হলে সাবধান। ২৮৭৩ বর্গ কিলোমিটারের এই অরণ্য কেবল অভয়ারণ্যই নয়, ‘ব্যাঘ্র প্রকল্প’, এমনকী ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’-এর স্বীকৃতি ও মর্যাদাপ্রাপ্ত। সুতরাং জীব ও উদ্ভিদ-বৈচিত্র যে এ-অরণ্যের সম্পদ, তা বলে বোঝাতে হয় না। কেবল নদীবক্ষে ভুটানের প্রাসাদ বা ‘রয়াল মানস’ দেখতে যাওয়ার জন্য বিশেষ অনুমতি নিতে হয় বন দফতর থেকে।

সে দিন বিকেলে জঙ্গলভ্রমণের কোনও পরিকল্পনাই ছিল না। দল বেঁধে বৈঁকি নদীর ধারে বসলাম। কী স্বচ্ছ জলের ধারা! নুড়িগুলো পর্যন্ত এক এক করে চেনা যায়। ভুটানের মানস নদী বাংলোর ডান দিক থেকে কত পথ, বনজঙ্গল পেরিয়ে ভারতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই নাম পাল্টে বৈঁকি হয়েছে। দিনের শেষ আলোটুকু তার শরীর জুড়ে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই পলাতকা ছায়া ফেলে হারিয়ে গেল সূর্য। ও পারে ভুটানের পাহাড়-সংলগ্ন বনাঞ্চলে শুরু হল অজস্র পাখির কলরব। সোনালি বাঁদরের দাঁত-কিড়মিড় করা চিৎকার।
তবে গোল বাঁধল ওই নদীকে নিয়েই। কী আছে ওই পথে! সে পথে কি যাওয়া নিষেধ! আরও কত প্রশ্ন। বাংলোয় ফিরে চৌকিদারকে জিজ্ঞেস করলাম। আমাদের চালকও সেখানে ছিলেন। বললেন, ওটা ভুটানে যাওয়ার রাস্তা। জায়গার নাম প্যান-ব্যাং। পাঁচ কিলোমিটার পথ। হেঁটে বা গাড়িতে যাওয়া যেতে পারে। কৌতূহল আর আবিষ্কারের আনন্দে সকলেই মশগুল। ঠিক হল, ব্রেকফাস্টের পরে রওনা দেওয়া যাবে।
এই নিয়ে মাথানগুড়ির বাংলোয় দ্বিতীয় বার আসা। আর কখনও আসা হবে কি না জানি না। কেবল এইটুকু হলফ করে বলতে পারি এ পথে না এলে অনেক কিছুই অজানা থেকে যেত। এ পথের অমোঘ আকর্ষণ তাই ভোলবার নয়। বাংলোর পিছনে কাঁচা পথ দিয়ে কিছুটা যাওয়ার পরই পরতে-পরতে তার রূপ-রস-গন্ধের পরিবর্তন। সে পথে নদীর বাঁক। পথের বাঁক। পাহাড়ের অবরোহে কত না গাছের আলিঙ্গন! বহু নীচে নদীর অববাহিকায় হলুদ বালিয়াড়ি। আরও দূরে নানা রঙের সুদৃশ্য বাড়িঘর। জনবিহীন চলতি পথের বাঁকে হঠাৎই ধরা দেয় কোনও লোকালয়। সামনের চেক-নাকার যুবক অফিসারটি নানা প্রশ্ন ও আলাপচারিতার পর সীমান্ত পেরিয়ে ভুটানে প্রবেশের অনুমতি দেন। পথ চলতে চলতে পাল্টে যায় প্রেক্ষাপট। ঘরবাড়ি। মানুষ। এ উপবনে আধুনিকতার ছোঁয়া। সরকারি দফতরের বাড়িগুলোর দেওয়ালে, গঠনশৈলীতে ভুটানের বর্ণবৈচিত্রের প্রভাব। মহিলা-পুরুষের পোশাক-পরিচ্ছদে সাবেক ভুটানের স্পষ্ট ছোঁয়া। জানি না, সে দিনটা ওদের কোনও বিশেষ দিন ছিল কি না। প্যান-ব্যাংয়ের পুরুষ, মহিলা ও শিশুরা নতুন বসনে সমবেত প্রার্থনা ও পূজাপাঠের মাধ্যমে নতুন মনাস্ট্রি প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত ছিল। যদিও ফেরার পথে প্রসাদস্বরূপ পানীয় আমাদের পরিবেশন করা হয়েছিল অত্যন্ত আন্তরিকতায়।
উৎসবের সে পথ পেরিয়ে আরও গভীরে গিয়ে বিস্মিত না হয়ে উপায় ছিল না। ভুটানের প্রত্যন্তে এই গ্রামের পথ থেমেছে তারের জাল-ঘেরা সেতুপথের সামনে। ওই সেতু পার হয়ে ভুটানের অন্দরে প্রবেশ করা যায়। সময়ের অভাব, ফেরার তাড়া। আর পাসপোর্ট বা ইনারলাইন পারমিট ছাড়া বিদেশভ্রমণ যে আইনত দণ্ডনীয়, সে কথা মাথায় রেখেই শেষ বারের মতো ওই ঝুলন্ত সেতুর সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আছি!
কেবল বলে রাখি, পাসপোর্ট বা ইনারলাইন পারমিটবিহীন বিদেশ ভ্রমণের ইচ্ছা থাকলে মাথানগুড়ির বাংলো থেকে সে পথে যাওয়ার সময় ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড বা অন্য কোনও পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখতে ভুলবেন না।
অধুনা ভারতের সমস্ত সংরক্ষিত অরণ্যে আমিষ বা অ্যালকোহল নিষিদ্ধ হয়েছে বা হতে চলেছে। মাথানগুড়ির বাংলো থেকে ভুটানের প্রত্যন্ত গ্রাম প্যান-ব্যাংয়ে পৌঁছলে কেবল পথের নিসর্গ বা বিদেশভ্রমণই নয় থুকপা থেকে মোমো, ছাম থেকে বিয়ার সবই পাবেন। আর কপাল ভাল থাকলে এ পথে কেবল অজস্র পাখিই নয়, গোল্ডেন লেঙ্গুরের সাক্ষাৎও পাওয়া যেতে পারে। মনে রাখবেন প্যান ব্যাং...আজও আছে গোপন!

কী ভাবে যাবেন
কামরূপ এক্সপ্রেস। নামতে হবে বরপেডা রোড।
রিকশায় বন দফতরের অফিস দশ-পনেরো মিনিটের পথ।
বুকিং করতে হলে লিখুন
ফিল্ড ডিরেক্টর ও ডেপুটি ডিরেক্টর, মানস টাইগার প্রজেক্ট,
বরপেডা রোড-৭৮১৩১৫, অসম
দূরভাষ
ফিল্ড ডিরেক্টর ৯১ ৩৬৬৬ ২৬১৪১৩,
ডেপুটি ডিরেক্টর ৯১ ৩৬৬৬ ২৬০৩৩৮




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.