|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
প্রবহমান জীবনে কখনও সংকট কখনও বা সংঘাত |
সম্প্রতি আকৃতি গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল গোবর্ধন আশ-এর একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
আকৃতি গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল গোবর্ধন আশ-এর (১৯০৭-১৯৯৬) ড্রয়িংয়ের প্রদর্শনী। ১৯৩০ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত কালপর্বে বিস্তৃত ছোট ও বড় মোট ৩৩টি ড্রয়িং ছিল এই প্রদর্শনীতে।
গোবর্ধন আশের সৃজনকর্মের সূচনা ১৯৩০-এর দশকে। ১৯৪০-এর দশকে তিনি নিজস্ব রূপরীতিতে পৌঁছান। চল্লিশের দশকে বাংলা তথা ভারতীয় চিত্ররীতির আধুনিকতায় যে নূতন আঙ্গিক-পদ্ধতির সূচনা হয়েছিল, তার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন তিনি। ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। কিন্তু এই দলে তিনি যোগ দিয়েছিলেন একেবারে শেষ পর্বে, ১৯৪৯ সালে। তা সত্ত্বেও যথেষ্ট অভিঘাত সৃষ্টি করেছিলেন। এই দলের প্রধান সংগঠক প্রদোষ দাশগুপ্ত তাঁর ‘স্মৃতিকথা শিল্পকথা’ বইতে তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন ‘গোবর্ধন আমাদের গ্রুপে যোগদান করেন ১৯৪৯ সনে।... গোবর্ধনের ধৈর্য এবং চেষ্টা আমাদের গোষ্ঠীর সভ্যদের এবং দর্শক ও সমালোচকদের মধ্যে সত্যিই এক বিস্ময়কর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। তাঁর অভিনব সব টেকনিকের মাধ্যমে নতুন নতুন সব ফর্মের সৃষ্টিতে, বিশেষ করে তাঁর বাংলার পটের নতুন রূপের সন্ধানে।’
‘এর আগে ১৯৩১ সালে তিনি কলকাতায় ‘ইয়ং আর্টিস্টস ইউনিয়ন’ নামে দল তৈরি করেন। সেই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অবনী সেন, কালীকিঙ্কর ঘোষদস্তিদার, রেণু রায় প্রমুখ শিল্পী। এই শিল্পীরাই ১৯৩৩-এ তৈরি করেছিলেন ‘আর্ট রেবেল সেন্টার’। গোবর্ধন আশ ছিলেন এর প্রথম সেক্রেটারি। সাংগঠনিক দিকে যেমন, তেমনি শিল্পসৃষ্টিতেও তাঁর মধ্যে প্রতিবাদী চেতনা কাজ করেছে। তাঁর জন্ম হুগলি জেলার বেগমপুর গ্রামে। প্রায় সারা জীবন এই গ্রামেই তিনি কাটিয়েছেন। ১৯২৬ সালে ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে। কিন্তু পাঠক্রম শেষ করেননি। চার বছর শিখে ছেড়ে দেন। ১৯৩২-এ মাদ্রাজের গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী তখন ওখানে অধ্যক্ষ। কিন্তু এক বছর পরে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছেড়েও চলে আসেন। তার পর নিজস্ব অনুশীলনের মধ্য দিয়ে লৌকিক ও নাগরিক রূপকল্পের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছেন স্বকীয় প্রকাশভঙ্গি। নব্য-ভারতীয় ঘরানার কিছু কিছু রেশও তাঁর ছবিতে কখনও কখনও এসেছে। |
|
শিল্পী: গোবর্ধন আশ |
কিন্তু চল্লিশের দশকের এক জন প্রতিবাদী শিল্পীর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তিনি এই দুই আঙ্গিককেই পরিহার করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন আধুনিকতার নতুন রূপরীতি। সেখানে পাশ্চাত্য আধুনিকতার ইম্প্রেশনিস্ট ও পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট আঙ্গিকের সঙ্গে বাংলার লৌকিক রূপরীতির সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। ছবির বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে চারপাশের প্রবহমান জীবন। এর সংকট, সংঘাত ও আনন্দের রূপ তিনি এঁকে গেছেন সারা জীবন।
আলোচ্য প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘অব মেনি বিগিনিংস অ্যান্ড নো এন্ড’। বাংলায় বলা যায় ‘সমাপ্তিহীন বহুমুখী সূচনা’। এই শিল্পী সারা জীবন অজস্র কাজ করেছেন। কিন্তু এই প্রদর্শনীতে সেই সামগ্রিকতা ধরা পড়েনি। মন্বন্তর নিয়ে অজস্র কাজ করেছেন তিনি। তার অল্প দু’একটিই মাত্র এখানে ছিল। আরও কিছু ছবি থাকলে শিল্পীর দায়বোধের দিকটি আরও বেশি উদ্ভাসিত হতে পারত।
১৯৩০ সালে করা ‘স্টাডি’ শিরোনামে অনুশীলনমূলক ড্রয়িংগুলিতে শিল্পীর স্বকীয়তা কিছু নেই। তবে স্বাভাবিকতার রীতিকে আয়ত্ত করার প্রচেষ্টা রয়েছে এর মধ্যে। নব্য-ভারতীয় আঙ্গিককে আয়ত্ত করার প্রয়াসও রয়েছে ১৯৩৯-এর দুর্গা ও ১৯৪০-এর কালীর রূপারোপে। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের একটি পেন্সিল ড্রয়িং বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই সময়ে মানুষের দুঃখ ও বিপন্নতার অবিস্মরণীয় দলিল এই ছবি। এ রকম আরও কিছু ছবি থাকলে ভাল হত। তাঁর স্বকীয় রূপরীতির পরিচয়ে ভাস্বর একটি ছবি ১৯৪৪-এর ‘রিটার্ন’। পরিমিত রেখা ও ছায়াতপে, দ্রুত সঞ্চালিত তুলির টানে এঁকেছেন একটি গরুর গাড়ির চলার দৃশ্য। ১৯৩৭ ও ১৯৬৯-এর পদ্মানদীর দু’টি ছবিতেও নদীমাতৃক বাংলার নিসর্গ ধরা পড়েছে সুন্দর ভাবে। লৌকিক নিয়ে তাঁর নিবিষ্ট চর্চার দৃষ্টান্ত ১৯৮৩-র কালি-কলমের কয়েকটি ড্রয়িং। একটিতে ছোট ছোট করে এঁকেছেন গ্রামীণ মানুষ, পশু, পাখি, মাছ, লতা-পাতা, আলপনা ইত্যাদির আলেখ্য।
১৯৮৩-র মাঠে চরে বেড়ানো কিছু মোষের ছবি, ১৯৯৩-এর ‘হাংরি’ শিরোনামে একটি কুকুরের জ্যামিতিক ভাবে বিশ্লিষ্ট রূপারোপ, ১৯৯৪-এর ‘প্লাকিং’ শিরোনামে গ্রামীণ মানবীর ফুল তোলার দৃশ্য। এ সব ছবিতে বাংলার প্রাণ যে ভাবে প্রতিফলিত হয়, তাতেই অনুভব করা যায় শিল্পীর প্রতিভার স্বাতন্ত্র্য। |
|
|
|
|
|