এই অপরূপ রূপে
৯০৫ সাল। স্বদেশি আন্দোলনে বাংলা উত্তাল। সেই পরিবেশের মধ্যেই অবনীন্দ্রনাথ আঁকলেন ‘বঙ্গমাতা’। কিন্তু সিস্টার নিবেদিতা এই ছবিটিকে ‘ভারতমাতা’ বলে সম্বোধন করেন। এই ‘আইকনিক’ ছবিটি সম্ভবত সারা ভারতে অবনীন্দ্রনাথের সর্বাধিক পরিচিত ছবি। অতি সম্প্রতি রামন শিবকুমারের লেখা ‘অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকলা’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ভারতের নানা প্রান্তের উৎসাহী শিল্পপ্রেমিকরা তাঁর ছবি সম্পর্কে বিশেষ ভাবে জানতে পারছেন। ‘ভারতমাতা’ ছবিটি স্বদেশি আন্দোলনকে উদ্দীপ্ত করতে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। এই ছবিটিতে দেখি গেরুয়া বসনধারী ভারতমাতা। তাঁর চারটি হাতে রয়েছে শস্য, তালপাতার পুঁথি, সুতিবস্ত্র এবং জপের মালা। ভারতমাতা যেন দেশবাসীকে খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা এবং ধর্ম (আধ্যাত্মিকতা) শিক্ষা দেওয়ার জন্য চিত্রিত মাতৃমূর্তি। ছবিটি অবনীন্দ্রনাথের ওয়াশ পদ্ধতিতে আঁকা প্রথম দিকের ছবি। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে ছবিটি সারা দেশে প্রচারিত। ফলে এই ছবিটিকে নির্ভর করেই কোনও কোনও শিল্প-সমালোচক অবনীন্দ্রনাথের ছবির গুণাগুণ বিচার করেন। তাঁদের অনেকেই খবর রাখেন না অবনীন্দ্রনাথের সৃষ্টির বিপুল সম্ভারের বিষয়ে এবং জানেন না তিনি যে কত বড় মাপের সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন।
পটুয়াদের চিত্রকলা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শিল্পী যামিনী রায় তাঁর নিজস্ব চিত্রশৈলী গড়ে তোলেন। যার ফলে চল্লিশের দশক থেকে বঙ্গীয় শিল্পকলা তথা ভারতীয় চিত্রকলা জগতে তাঁর নামডাক বিশেষ ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। মনে পড়ল, এ বছরটি যামিনী রায়ের ১২৫তম জন্মবর্ষ। তাঁকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।

যামিনী রায়ের গণেশজননী

বিকাশ ভট্টাচার্যের ‘দুর্গা’ সিরিজ থেকে
‘গণেশ জননী’ ছবিটি যামিনী রায়ের অতি পরিচিত চিত্রশৈলীরই একটি উদাহরণ। শিল্পী রাধাকৃষ্ণ, মা ও শিশু, নারী কিংবা নৃত্যরতা নারী, কৃষ্ণ ও গোপিনী, যিশুখ্রিস্ট এই সব ধর্মীয় বিষয় ও কাহিনি কিংবা লোকাচার ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত বিষয় নিয়ে ছবি এঁকেছেন। পটুয়াদের মতো তিনি মেটে রঙে ছবি আঁকতেন। সর্বাঙ্গীণ ভাবে দেশজ রীতিনীতিকে তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। পটুয়াদের মতো একই বিষয়বস্তুকে তিনি বহু বার নানা ভাবে-ভঙ্গিতে, রঙে এঁকেছেন। ‘গণেশ জননী’ও তিনি অনেক বার এঁকেছেন। পটুয়াদের আঁকা ছবির মতো হলেও তাঁর ছবিতে শিক্ষিত আধুনিক চিত্রীর সুপটু রেখা, সুনির্বাচিত বস্তু, মুখাকৃতি ও চোখের আকার দেখতে পাই। তা ছাড়া অলংকরণে, জমিতে মূর্তি ও আকারের সংস্থাপনে বিশেষ স্থিরতা, পরীক্ষানিরীক্ষামূলক রূপারোপ এবং সতর্কতা এ সব কিছু চোখে পড়ার মতো। পটুয়াদের মতো আঁকা দ্বিমাত্রিক ছবিতে চিত্রিত ছবিগুলির মধ্যে মানবিক শারীরিক অনুভব কখনওই স্পষ্ট হয়ে দেখা দেবে না। বরং এখানে রং, রেখা, জমি (স্পেস) এবং তাতে আকারের সংস্থাপন ও তাদের মধ্যেকার টানাপোড়েনই আমাদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। গণেশ জননী এখানে প্রায় নিমিত্তমাত্র। আসলে এটি একটি ছবি, অবশ্যই বিষয়বস্তুভিত্তিক এবং অর্থবাহক। যামিনী রায় শিল্পী হিসেবে তথাকথিত বেঙ্গল স্কুল ঘরানা থেকে দূরে গিয়ে একটি নিজস্ব ঘরানা এ দেশীয় চিত্রকলার ক্ষেত্রে সৃষ্টি করে গেছেন, যেমন করেছেন রবীন্দ্রনাথ, অব্যশই যাঁর কাজের গভীরতা আরও তাৎপর্যপূণর্।
অবনীন্দ্রনাথের ভারতমাতা
বিকাশ ভট্টাচার্য ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের এক জন অত্যন্ত কৃতী ছাত্র হিসেবে অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে বাস্তব ঘরানার ছবি আঁকায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনি মুখাকৃতি এবং মানুষের শরীর, তার ভাবভঙ্গিমা, জটিল অভিব্যক্তি অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে তাঁর ছবিতে প্রকাশ করতে পারতেন। দেশভাগের পর উদ্বাস্তু হিসেবে তাঁর পরিবার পশ্চিমবঙ্গে বসবাস শুরু করেন। সে কারণে জীবনের নিদারুণ অভিজ্ঞতা তাঁকে এই জীবন, মানুষজন ও পরিবেশ সম্পর্কে অত্যন্ত স্পর্শকাতর করে তুলেছিল। কলকাতার নাগরিক জীবনের সঙ্গে, এবং তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে বিকাশ প্রবল ভাবে যুক্ত করে ফেলেছিলেন। সে কারণেই কলকাতার মানুষজন, চেনা-অচেনা, এখানকার রাস্তাঘাট, পরিবেশ সব কিছু তাঁর ছবির বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। অত্যন্ত সংবেদনশীল মন নিয়ে তিনি সে সব কিছুকে চিত্রায়িত করেছেন। বিকাশের ছবিতে প্রায়ই বাস্তবতার সঙ্গে অতিবাস্তবতার স্পর্শ খুঁজে পাই। সঙ্গে থাকে কখনও বিদ্রুপ, কখনও ফ্যান্টাসি, কখনও জটিল মানবিক সম্পর্ক।
যখন বাঙালির প্রিয় দুর্গাপ্রতিমাকে নিয়ে তিনি ছবি আঁকেন, তখনও দেখতে পাই সে দুর্গা যেন নাগরিক কলকাতার নারী। বিকাশ কখনওই সোজা অর্থে ঈশ্বরবিশ্বাসী নন। তাঁর কোনও দুর্গাপ্রতিমার মুখ বা শরীরে ঈশ্বর-ভাব নেই। তারা জলজ্যান্ত কলকাতার নাগরিক। হতে পারে রাস্তা থেকে উঠে আসা দীন-দুঃখী বা মধ্যবিত্ত পরিবারের রোজকার চেনাজানা নারী মূর্তি। একই সঙ্গে বিকাশের কল্পনার ছোঁয়া সে সব দুর্গাপ্রতিমায়। তাদের অভিব্যক্তি, ভাব, পোশাক-পরিচ্ছদ, শারীরিক গড়নে রয়েছে অতিপ্রাকৃত অথচ বাস্তবিক গড়ন। কখনও কলকাতার রাস্তায় সে ভবঘুরের মতো পথ চলেছে, কখনও সে যেন এলোচুল যৌবনবতী নারী, মেঘলা আকাশের সঙ্গে এক হয়ে আছে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.