|
|
|
|
বন্দর-বৈঠকে নেই শুভেন্দু, গোল দিলেন লক্ষ্মণ |
হলদিয়ায় এবিজি-কেই বেশি বরাত দিতে সওয়াল |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
আদালতের নির্দেশে নিজের জেলা পূর্ব মেদিনীপুরে তাঁর ঢোকা বারণ। এখন তাঁর অস্থায়ী ঠিকানা কলকাতা। সেখান থেকে তিনি যে হলদিয়া বন্দরের অচলাবস্থা কাটানোর বৈঠকে সিটুর তরফে হাজির হয়ে যাবেন, সেটা ভেবে উঠতে পারেননি তাঁর মূল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী তমলুকের তৃণমূল সাংসদ। মূল প্রতিদ্বন্দ্বীর অনুপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার কলকাতা বন্দরের সদর দফতরে ওই বৈঠকে হাজির হয়ে রাশ পুরোপুরি নিজের হাতে নিয়ে নিলেন তমলুকের সিপিএম নেতা ও প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ।
লক্ষ্মণবাবুর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ ওঠার পরে এটাই সম্ভবত প্রথম প্রকাশ্য বৈঠক (দলীয় বৈঠক ছাড়া), যেখানে তিনি হাজির। শুধু উপস্থিত থাকাই নয়, কী ভাবে হলদিয়া বন্দরের শান্তি ফিরবে, সেই পরামর্শও দিলেন তিনি। আর পণ্য খালাসকারী যে-সংস্থার বিরুদ্ধে তমলুকের তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর আন্দোলন, সেই এবিজি-র হয়েই এ দিনের বৈঠকে সওয়াল করলেন লক্ষ্মণবাবু। তাঁর দাবি, হলদিয়া বন্দরে এবিজি-কে আরও বেশি করে কাজে লাগানো হোক। আরও বেশি জাহাজের পণ্য খালাসের বরাত দেওয়া হোক তাদের। |
|
বৈঠকে লক্ষ্মণ শেঠ। ছবি এবিপি আনন্দের সৌজন্যে। |
পক্ষকাল ধরে এবিজি-র বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করছেন শুভেন্দুবাবু। আন্দোলন জঙ্গি হয়ে ওঠায় এবিজি পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। কাজ না-থাকায় এবিজি ২৭৫ জন শ্রমিককে ছাঁটাই করেছে। তার জেরে ওই বন্দরে অশান্তি আরও বেড়েছে। এবিজি-কে হুমকিও দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। হলদিয়া বন্দরের পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। হলদিয়ায় নোঙর করার কথা থাকলেও সেখানে না-ঢুকে জাহাজ পণ্য খালাস করেছে বিশাখাপত্তনমে। এই অবস্থায় এ দিন হলদিয়া বন্দরের নানা কাজে যুক্ত বিভিন্ন সংস্থা এবং শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের ডাকা বৈঠকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সিপিএম-সমর্থক শ্রমিক সংগঠন সিটুর প্রতিনিধি হয়ে সেই বৈঠকে যোগ দেন লক্ষ্মণবাবু। তাঁকে বৈঠকে দেখে তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের নেতারাও কিছুটা হকচকিয়ে যান। লক্ষ্মণবাবুকে যে সেখানে দেখা যাবে, ভাবেননি তাঁরা। ভাবেননি বন্দরের চেয়ারম্যানও।
বৈঠকের পরে লক্ষ্মণবাবু বলেন, “যাদের বেশি পণ্য ওঠানো-নামানোর ক্ষমতা রয়েছে, তাদের সেই কাজ দিতে হবে। যে-সংস্থা ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বন্দরে এসেছে, তাদের যাতে বন্দর ছেড়ে যেতে না-হয়, সেটা দেখা বন্দর-কর্তৃপক্ষের কাজ।” তাঁদের দাবি, যে-সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে বেশি লাভ করছে, তাদের লাভ কমাতে হবে আর যে-সংস্থা লোকসানে চলছে, তাদের অতিরিক্ত আয়ের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। “এটাই বৈঠকে পরিষ্কার করে দিয়েছি,” বললেন লক্ষ্মণবাবু।
আর শ্রমিক ছাঁটাই?
কোনও ভাবেই যাতে শ্রমিক ছাঁটাই না-হয়, সেটা বন্দর-কর্তৃপক্ষকেই দেখতে হবে বলে মন্তব্য করেন লক্ষ্মণবাবু। এ দিন ফাঁকা মাঠে হলদিয়া বন্দরের সিটু শ্রমিক সংগঠনের কার্যনির্বাহী সভাপতি লক্ষ্মণবাবু যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখন শুভেন্দুবাবুর পাঠানো প্রতিনিধির চুপ করে বসে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। লক্ষ্মণবাবু কী বলেন, তা শোনার জন্যই আগ্রহ ছিল সকলেরই। কলকাতা বন্দরের এক কর্তা বলেন, “প্রথমে ভাবা হয়েছিল, চেয়ারম্যানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এসেছেন লক্ষ্মণবাবু। কিন্তু ওই সিপিএম নেতা বন্দরের চেয়ারম্যানকে জানিয়ে দেন, এ দিনের বৈঠকে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের সভাপতিদের ডাকা হয়েছে। তিনি এসেছেন সিটু সংগঠনের কার্যনির্বাহী সভাপতি হিসেবেই।”
লক্ষ্মণবাবু এ দিন হলদিয়া বন্দর নিয়ে মুখ খোলায় পরিস্থিতি আরও জটিল হবে বলেই আশঙ্কা করছেন বন্দর-কর্তৃপক্ষ। তাঁদের মতে, এ দিনের বৈঠক লক্ষ্মণবাবুকে সামান্য হলেও পায়ের তলায় কিছুটা মাটি ফিরিয়ে দিল। হলদিয়া বন্দর নিয়ে লক্ষ্মণ-শুভেন্দু দ্বৈরথ ফের চলে এল সামনে। তবে এ দিনের বৈঠকে নিজের গরহাজিরা এবং লক্ষ্মণবাবুর বক্তব্য নিয়ে কোনও মন্তব্যই করতে চাননি শুভেন্দুবাবু।
লক্ষ্মণবাবুর উপস্থিতি ছাড়া বন্দরের চেয়ারম্যানের ডাকা এ দিনের বৈঠক কার্যত নিষ্ফলাই ছিল। ২৭ সেপ্টেম্বর হলদিয়ায় ডাকা প্রথম বৈঠকে এবিজি-র প্রতিনিধি বা শুভেন্দুবাবু, দু’জনের কেউই ছিলেন না। ফলে সেই বৈঠকে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। এ দিন চার ঘণ্টার বৈঠকে এবিজি থাকলেও কোনও সিদ্ধান্ত হল না। শুধু একটি কমিটি গড়ে বিবদমান সব পক্ষকে এক টেবিলে বসানোর চেষ্টা করেছেন বন্দরের চেয়ারম্যান মণীশ জৈন।
বন্দর সূত্রের খবর, এ দিন বিবদমান দু’পক্ষই কিছুটা নরম সুরে বক্তব্য পেশ করেছে। এবিজি তাদের বছরে ৯০ লক্ষ টন পণ্য পাওয়ার দাবি ছেড়ে দিয়েছে। বছরে ৬০-৭০ লক্ষ টন পণ্য পেলেই হলদিয়ায় থেকে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে তারা। এবিজি-র মূল দাবি, তারা যে-সব মোবাইল হারবার ক্রেন কিনেছে, সেগুলির যেন পূর্ণ ব্যবহার হয়। নইলে ক্রেনগুলির দাম উঠবে না। সে-ক্ষেত্রে দুই ও আট নম্বর বার্থের বাইরে ৪বি বার্থে যাতে একাধিক ক্রেন দেওয়া যায়, সেই ব্যাপারে বন্দর-কর্তৃপক্ষকে সক্রিয় হতে অনুরোধ করেছে তারা। বন্দর সূত্রে জানা গিয়েছে, কমিটি বিষয়টি বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছে। সে-ক্ষেত্রে ছাঁটাই করা শ্রমিকদের ফিরিয়ে নিতেও তাদের বিশেষ আপত্তি নেই বলে জানিয়েছে এবিজি। তবে কমিটিতে প্রতিনিধি পাঠানোর ব্যাপারে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি ওই সংস্থা।
বন্দরের চেয়ারম্যানের ওই কমিটিতে থাকার ব্যাপারে কেন সবুজ সঙ্কেত দিল না এবিজি? তারা কি হলদিয়া বন্দরের সমস্যা মেটাতে উদ্যোগী নয়?
এবিজি-র সিইও বা চিফ এগ্জিকিউটিভ অফিসার গুরপ্রীত মালহি বলেন, “দুই ও আট নম্বর বার্থে বাড়তি পণ্য নামানোর সুযোগ করে না-দিলে আমরা হলদিয়ায় থাকব না। কোনও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানই লোকসানে চলতে পারে না।” আর এবিজি-র প্রতিযোগী একটি সংস্থার ডিরেক্টর সৌমিক বসু বলেন, “লোকসান করে তো আমরাও ব্যাবসা চালাতে পারব না। তবে উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানসূত্র নিশ্চয়ই বেরোবে। বন্দরের স্বার্থে সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছি আমরা।”
বন্দরের চেয়ারম্যান বলেন, “সব পক্ষকেই কিছু না কিছু ছাড়তে হবে। তা হলেই সমাধানসূত্র মিলবে। নতুন কমিটি এক সপ্তাহের মধ্যেই গ্রহণযোগ্য সমাধানসূত্র দিতে পারবে বলে আশা করছি।” |
|
|
|
|
|