ছিলেন নাসা-র বিজ্ঞানী, হয়ে গেলেন বলিউডের চিত্রপরিচালক।
ছিলেন ডিজিটাল ফিল্মের মানচিত্র বদলে দেওয়া রেড ক্যামেরার জনক। লেগে পড়লেন সেই রেড ক্যামেরাতেই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের গল্প বলতে।
ছিলেন লস এঞ্জেলসে। সাজানো দোতলা বাড়ি, সুইমিং পুল। এসে পড়লেন বান্দ্রায় পেয়িং গেস্ট হয়ে। একটা খাট, দু’টো স্যুটকেস, কম্পিউটার আর কয়েকটা হার্ড ড্রাইভ। “ঠিক যেন শিয়ালদহের প্ল্যাটফর্ম,” নিজের মুখেই বলছেন বেদব্রত পাইন।
বেদব্রত...চিটাগঙের এই বাঙালি পরিচালককে নিয়েই বলিউড এখন উচ্ছ্বাসে ভাসছে। বুধবার মুম্বইয়ে ছবিটির বিশেষ প্রদর্শনীর পরে পরপর আটটা টুইট করেছেন অমিতাভ বচ্চন। লিখেছেন, “বেদব্রত পাইন, নতুন পরিচালক, নাসায় কাজ করছিলেন, রেড ক্যামেরা আবিষ্কার করেছেন, তার পর মুম্বইয়ে ছবি বানাবেন বলে সব ছেড়ে দিয়েছেন।” শাহরুখ খান বলছেন, “ছবিটা ডিলাইটফুলি ইনটেন্স। এই অভিজ্ঞতার জন্য ধন্যবাদ বেদ...।”
৪৫ বছর বয়সে ছবি তৈরিতে হাতেখড়ি! যে বয়সে আর পাঁচ জন বাঙালি থিতু হতে চান, সেই বয়সে বেদব্রত সব ছেড়েছুড়ে মুম্বইয়ে হাজির স্বপ্ন ধাওয়া করতে। নাসা-য় নিজের আবিষ্কারের রয়্যালটিই মূলধন। পাঁচ কোটি টাকা হাতে নিয়ে বেদব্রত নেমে পড়লেন রীতিমতো পিরিয়ড পিস তৈরির কাজে। “আগে কোনও দিন তো ফিল্মের সেটে যাইনি। সব কিছুই নতুন লাগত।” সে সময় অনেকেই ভাবতেন, নাসার বিজ্ঞানী আবার ছবি কী বানাবে? “আমি যে কাজটা নিয়ে সিরিয়াস, সেটা সকলকে বোঝাতেই অনেক সময় লেগেছে। তবে আমি ভাগ্যবান যে মনোজ বাজপেয়ী, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি আর ব্যারি জন আমার উপরে আস্থা রেখেছিলেন।” |
চিন্তায় ছিলেন কলকাতায় বেদব্রতর বাবা-মাও। সেন্ট লরেন্স স্কুল আর খড়গপুর আইআইটি-র প্রাক্তন ছাত্রটি একটু বেশিই ঝুঁকি নিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছিল ওঁদেরও। ঢাকুরিয়ায় ছোট্ট ফ্ল্যাটে শুয়ে আর্থ্রাইটিসের রোগী, বেদব্রতের বাবা নির্মল পাইন বলেন, “আইআইটি-ফেরত ছেলে সব ছেড়েছুড়ে ছবি করবে শুনে সত্যিই প্রথমে খুশি হইনি। তা-ও আবার নিজের টাকায়!” সায় দেন মা বিজয়াদেবীও, “আত্মীয়স্বজনেরা সবাই বলেছিলেন, মিঠুকে (বেদব্রত) আটকাতে। আমি বলেছিলাম, কোনও দিন যা করিনি, আজ কেন করব?”
বেদব্রতর ছবি করার স্বপ্ন ভাগ করে নেওয়ার প্রধান সঙ্গী তখন বেদব্রতর বড় ছেলে, ঈশান। “ছবিটা তো ঈশানেরও স্বপ্ন। বিশ্বব্যাপী মন্দার পরেও আমি যখন নিজের সব দিয়ে ছবি বানাব ভাবলাম, ঈশান ভীষণ ভরসা দিত।” দু’বছর আগে সেই ঈশানই ১৬ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছে। “ট্রিমার দিয়ে শেভ করতে গিয়ে পুড়ে যায় ও। আমাদের ধারণা ট্রিমারে খুঁত ছিল। আদালতে গিয়েছিলাম ওই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বিরুদ্ধে। হেরে গেলাম। শুনতে হল যে, ঈশান না থাকায় আমরা নাকি ওর খরচ বাবদ দু’বছরে ৫৮,০০০ ডলার বাঁচিয়েছি!”
প্রায় বেরিয়ে পড়া কান্নাটা গিলে ফেলেন বেদব্রত। ছবি করতে করতেই আদালতে শুনানির তারিখ পড়ত। বেদব্রত মুম্বই থেকে লস এঞ্জেলেস চলে যেতেন। আবার ফিরে এসে ছবির কাজে হাত দিতেন। এ ছবিতে ঈশান বলে একটা গানও আছে, বেদব্রত নিজেই গেয়েছেন সেটা।
১২ অক্টোবর মুক্তি পাচ্ছে চিটাগং। বেদব্রত এখন ভীষণ ব্যস্ত প্রিমিয়ারের তোড়জোড় নিয়ে। তারই মধ্যে শুক্রবার কলকাতা আসার কথা। বাবা বলছিলেন, “দেখা হলে প্রথমেই বলব, কনগ্রাচুলেশন্স।”
ছেলের প্রিয় মাছের ল্যাজা আর ট্যাংরা মাছ কিনে রেখেছেন মা। কলকাতাকে ঘিরেও এখন অনেক পরিকল্পনা বেদব্রতের। একটা ভাল টিম জোগাড় করে সমসাময়িক সাহিত্যনির্ভর বাংলা ছবি করতে চান। যেখানে স্ক্রিপ্টই হবে তারকা। “আমার প্রেরণা ঋত্বিক, সত্যজিৎ, মৃণাল। তবে আমি সব ছবিই দেখি।”
অমিতাভ বচ্চনের ‘জঞ্জির’ যেমন ২০ বার দেখেছেন। সেই অমিতাভ, সেই জয়া আজ বেদব্রতর ছবি দেখে উচ্ছ্বসিত। বচ্চন-তনয় অভিষেকও তো কিছু দিন আগে এই চট্টগ্রাম-কাহিনি নিয়েই খেলে হম জি জানসে নামে একটি ছবি করেছিলেন! বেদব্রত বলছেন, “জয়াজির এসে আমাকে জড়িয়ে ধরা, আমাকে নিয়ে অমিতাভের নাগাড়ে টুইট সব যেন একটা রূপকথা।” টুইটে অমিতাভ লিখেছেন, উনি বেদব্রতর শাশুড়ি জুনি বসুর সঙ্গে থিয়েটার করতেন কলকাতায়। “মারা যাওয়ার আগে যখন শাশুড়ি অসুস্থ ছিলেন, তখন অমিতাভ হাসপাতালে গিয়েছিলেন। এত বছর পেরিয়েও উনি এটা মনে রেখেছেন।”
অমিতাভ একা নন। গোটা বলিউডই বেদব্রতকে ডেকে বলছে, এত দিন কোথায় ছিলেন? অনিল কপূর, বিশাল ভরদ্বাজ, সুধীর মিশ্র, শাবানা আজমি, কঙ্কনা সেনশর্মা ছবি দেখতে এসেছিলেন সবাই। ছবিটির পরিবেশনা-পর্ব থেকেই বেদব্রতকে সর্বতো ভাবে সাহায্য করে গিয়েছেন অনুরাগ কাশ্যপ। “ফোটোগ্রাফাররা শাহরুখকে ছবি তুলতে অনুরোধ করছিলেন। শাহরুখ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ওকে ফ্রেমে থাকতেই হবে।”
রাতে অটো ধরে পেয়িং গেস্ট-এর খুপরিতে ফিরতে ফিরতে বুধবার কত কথাই মনে পড়ছিল বেদব্রতর। “যখন চাকরি ছেড়েছিলাম, বাবা বলেছিলেন একটা ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট নিয়ে রেখো নাসা থেকে। তাতে যেন বলা থাকে, তুমি ভাল কাজ কর। আর, তোমাকে নাসা ছাড়িয়ে দেয়নি।” সেই চিঠিটা নিয়ে রাখা হয়নি। তবে অন্য একটা চিঠি আজও সঙ্গে সঙ্গে থাকে। ঈশানের চিঠি। “ওদের স্কুলে একটা নিয়ম ছিল, সবাইকে একটা চিঠি লিখতে হয়। নিজেকে। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে সেই চিঠি থাকে। স্কুল শেষে তা তাঁরা ফিরিয়ে দেন।” ঈশানের মৃত্যুর পর বেদব্রত চিঠিটা পান। তাতে লেখা ছিল, “চিটাগঙকে নিয়ে আমার একটু চিন্তা আছে। তবে আমার মনে হয় সব ঠিক হয়ে যাবে।’
ঈশানকে এখন একটাই কথা প্রাণপণে বলতে চাইছেন বেদব্রত। “চিটাগঙের জন্য হয়তো সত্যিই সব ঠিক
হয়ে আসছে।”
|