ম্যাজিক দেখাল মথুরাপুর
চাহিদা আছে, সাহায্যের হাতও বাড়ানো, তবু সেতুবন্ধন হয় না
কটা মৃত্যু থেকে শুরু হয়েছিল লড়াইটা।
বছর তিনেক আগের ঘটনা। অষ্টম শ্রেণির সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রীটির হঠাৎই স্কুলে আসা বন্ধ। ক’দিন দেখে হেড মাস্টারমশাই বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিলেন। জানা গেল, সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া মেয়েটি হাসপাতালে ভর্তি। ঋতুকালীন অবস্থায় সংক্রমণের জেরে গুরুতর অসুস্থ। বাঁচল না সে।
প্রিয় ছাত্রীকে চিরতরে হারিয়ে খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন মথুরাপুরের কৃষ্ণচন্দ্র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দনকুমার মাইতি। তার পরই এক নতুন যুদ্ধে নামলেন তিনি। ঠিক করলেন, স্কুলের পরিকাঠামো ঢেলে সাজবেন। বিশেষ করে শৌচাগার সংস্কার হবে তাঁর পাখির চোখ। তখন গোটা স্কুলে দেড় হাজার ছাত্রছাত্রীর জন্য মাত্র একটি শৌচাগার ছিল। একে তো ক্লাসরুম থেকে বেশ দূরে, তায় জলের ব্যবস্থাও নেই। ফলে অধিকাংশ সময়েই শৌচাগার ব্যবহার এড়িয়ে যেত পড়ুয়ারা, বিশেষ করে ছাত্রীরা।
এই ছবিটাই পাল্টে দেওয়ার সংকল্প করলেন চন্দনবাবু। আর তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল কর্পোরেট দুনিয়া।
ফলাফল? কলকাতা থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরের মথুরাপুর এ রাজ্যের আর পাঁচটা গ্রামের মতোই। আলাদা শুধু এখানকার স্কুলটা। বাড়িটা জরাজীর্ণ নয়। একতলা-দোতলা মিলিয়ে ২৮টা ক্লাস রুম। রয়েছে নিজস্ব অডিটোরিয়াম, মিড ডে মিলের ঝাঁ-চকচকে রান্নাঘর, ছাত্রাবাস। এবং অবশ্যই আধুনিক শৌচাগার, যেখানে রয়েছে স্যানিটারি ন্যাপকিন। শৌচাগারের সংখ্যা ১২। ছ’টি মেয়েদের। ছ’টি ছেলেদের। স্কুল চত্বরেই গভীর নলকূপ থেকে শৌচাগারে জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া আছে বৃষ্টির জল ধরার জন্য ৬ হাজার লিটারের ট্যাঙ্ক।
প্রত্যন্ত গ্রামের একটা স্কুলে এমন ম্যাজিক কী করে সম্ভব হল? ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’ (সিএসআর) বা শিল্পসংস্থাগুলির সামাজিক দায়বদ্ধতার কর্মসূচিতে ইদানীং শিক্ষা একটা বড় জায়গা। ব্যবসার লাভের অংশ থেকে সামাজিক কাজকর্মের জন্য টাকা বরাদ্দ করাটা আইনি দায়ও বটে। হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়াম, এনটিপিসি-র মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় বরাদ্দের পরিমাণ লাভের অঙ্কের ২%। কোকা কোলা, মাইক্রোসফ্ট, সিআরআই পাম্পস-এর মতো বেসরকারি সংস্থাও সমপরিমাণ লভ্যাংশ এই খাতে খরচ করে। চন্দনবাবু এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছেন।
কী ভাবে? চন্দনবাবুর বক্তব্য একটাই ‘ম্যাজিক’ ঘটাতে চাই সদিচ্ছা আর কর্পোরেট মহলের কাছে পৌঁছে যাওয়ার উদ্যোগ। গ্রামাঞ্চল তো ছেড়েই দেওয়া গেল, বিশেষ করে শহরের কাছের স্কুলগুলিও অধিকাংশই অর্থের অভাবে ধুঁকছে! সরকারি হিসেবই বলছে, এ ধরনের স্কুলে শিক্ষকদের বেতন ছাড়া ছাত্রপিছু দেওয়া হয় ২৭ টাকা।
নব কলেবরে কৃষ্ণচন্দ্র হাইস্কুল। —নিজস্ব চিত্র
কম্পিউটার শিক্ষার জন্য মেলে বার্ষিক ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু স্কুল চালাতে বছরে খরচ হয় দু’ থেকে আড়াই লক্ষ টাকা। বেসরকারি স্কুলের মতো পড়ুয়াদের থেকে মোটা ‘ফি’ নিয়ে তহবিল ভরার উপায় নেই। এইখানেই কর্পোরেট সহায়তার একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। চন্দনবাবুর কথায়, “স্থানীয় বাসিন্দা ও শুভানুধ্যায়ীদের আর্থিক সহায়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে বড় মাপের পরিকাঠামো গড়ে তুলতে কর্পোরেট মহলের সাহায্য জরুরি।” পরিকল্পিত ভাবে এগোলে সেই সাহায্য পাওয়াটা মোটেই কঠিন নয় বলেই দাবি চন্দনবাবুর। এবং কাজ করে দেখাতে পারলে পরবর্তী পর্যায়ের টাকা দিতেও পিছপা হয় না সংস্থাগুলি।
কৃষ্ণচন্দ্র হাইস্কুলের অভিজ্ঞতা তো সেই কথাই বলছে। স্কুলের রিডিং রুম ও মিড ডে মিলের খাওয়ার ঘর তৈরি হয়েছে স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার অনুদানে। পানীয় জলের ব্যবস্থা ও শৌচাগার তৈরির পিছনে রয়েছে কোকা কোলার আর্থিক সহায়তা। কম্পিউটার দিয়েছে লেনোভো, এইচসিএল, জেনিথ, উইপ্রোর মতো দেশি ও বিদেশি সংস্থা। কর্পোরেট দুনিয়াও বলছে, সঠিক পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়িত করার ইচ্ছা থাকলে অর্থ বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
তা হলে সব স্কুল কৃষ্ণচন্দ্র হাইস্কুল হয়ে ওঠে না কেন? কর্পোরেট সংস্থাগুলো টাকা দেওয়ার জন্য বসে থাকলেও তার নাগাল পায় না কেন স্কুলগুলো? বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার হয়ে সিএসআর প্রকল্পের পরিকল্পনা করে দেয় ওয়েবকন। ওয়েবকনের প্রধান দেবাঞ্জন দত্তের মতে, যাঁরা দেবেন আর যাঁরা নেবেন, এই দুই পক্ষের মধ্যে সেতুবন্ধনটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ে ওঠে না। তাঁর কথায়, “সাহায্য পেতে গেলে সঠিক পরিকল্পনা করাটা জরুরি। অধিকাংশ স্কুল উদ্যোগী হয়ে সেটিই করে উঠতে পারে না।” তা ছাড়া এক বার এক গাদা টাকা খরচ করলেই হবে না। “চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।”
দেবাঞ্জনবাবুর মতে, মূলত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির মাধ্যমেই এই সব প্রকল্প রূপায়ণ করা হয়। এই সব সংস্থার দায়বদ্ধতাও এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নেয়। আর প্রকল্প কার্যকর করেই থেমে থাকা নয়। প্রকল্পকে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এবং প্রকল্পকে স্বনির্ভর করে তোলাও জরুরি। যেমন কৃষ্ণচন্দ্র হাইস্কুলের পড়ুয়ারা নিজেরাই মাসে এক টাকা করে চাঁদা দিয়ে তৈরি করেছে একটি তহবিল। গ্রামবাসীদের থেকেও মাসিক চাঁদা নেওয়া হয়। এই টাকায় গ্রামের জল সরবরাহ ও শৌচাগারের ব্যবস্থা তৈরি ও দেখাশোনা করা হচ্ছে। কোকা কোলা-র অন্যতম কর্তা দীপক জোলি-ও তাঁর অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, এলাকার স্কুলের সঙ্গে স্থানীয় প্রতিটি পরিবারেরই নিবিড় যোগ। স্কুলের উন্নয়ন সবাইকে ছুঁয়ে যায়। তাই সেই উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে সাগ্রহে যুক্ত হয়ে যান গ্রামবাসীরা। ফলে সংস্থার পক্ষেও প্রকল্প চালিয়ে নিয়ে যেতে সুবিধা হয়।
এ দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিকাঠামোর অভাব যে কতটা, ২০১১ সালের ‘অ্যানুয়াল স্টেটাস অফ এডুকেশন’ শীর্ষক রিপোর্টেই তা স্পষ্ট। দেশ জুড়ে ৫০ শতাংশের কম স্কুলে ব্যবহারযোগ্য শৌচাগার রয়েছে। মাত্র ৪৩.৮ শতাংশ স্কুলে মেয়েদের পৃথক শৌচাগার রয়েছে। ৫৪.১ শতাংশ স্কুলের চারপাশে পাঁচিল রয়েছে। প্রায় ৪০ শতাংশ স্কুলে খেলার মাঠ নেই। এর মধ্যে অধিকাংশ স্কুল সরকারি বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত। সুপ্রিম কোর্ট গত বছরেই নির্দেশ দিয়েছিল, প্রতিটি স্কুলে ছেলে ও মেয়েদের জন্য পৃথক শৌচাগারের ব্যবস্থা করতে। প্রথমে ২০১১-র ডিসেম্বরের মধ্যে এই কাজ সারতে বলা হয়। পরে সময়সীমা বাড়ানো হয় ২০১২-র মার্চ পর্যন্ত। কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা এখনও সেই তিমিরেই এবং তার পিছনে অর্থাভাবই অন্যতম কারণ।
চাহিদা ও জোগানের এই বিশাল ফারাক শুধু সরকারি দাক্ষিণ্যে মেটানো যে সম্ভব নয়, স্বীকার করে নিয়েছে সরকারও। রাস্তাঘাট, হাসপাতালের মতো পরিকাঠামো গড়তে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপি মডেল এখন আর নতুন কিছু নয়। স্কুলের ক্ষেত্রে সে ভাবে ঘোষিত পিপিপি নীতি নেই। কিন্তু মথুরাপুরের কৃষ্ণচন্দ্র হাইস্কুল যে নজির গড়েছে, সেটা আরও অনেককেই দিশা দেখাতে পারে বলে মনে করছে শিক্ষাজগৎ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.