বাবার হাত ধরে রাস্তা পেরোচ্ছিল ছোট্ট বাবাই। বাসের ধাক্কায় মৃত্যু হয় তার। ক্ষতিপূরণের তদন্তে এসে বিমা সংস্থার ইনস্পেক্টর স্বপন চক্রবর্তী দায়ী করেছিলেন বাসটির বেহাল দশাকেই। কিন্তু আদালতে দেখা যায়, সেই রিপোর্ট বদলে গিয়েছে। এর পরেই শুরু হয় বাবাইয়ের বাবা অর্ক এবং স্বপনের লড়াই।
সত্যি মনে হলেও এটি আসলে গল্প। কিন্তু শহরে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু রোজকার ঘটনা। আর এই ধরনের মৃত্যুর পিছনেই অনেক সময়ে লুকিয়ে থাকে আরও একটি গল্প। ক্ষতিপূরণের গল্প। পুলিশ সূত্রের খবর, পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে তার ক্ষতিপূরণ পায় মৃতের পরিবার। কিন্তু কতটা ক্ষতিপূরণ মিলবে, তা দাঁড়িয়ে থাকে বিমা সংস্থার ইনস্পেক্টরের দেওয়া রিপোর্টের উপরে। দুর্ঘটনাটির জন্য কে দায়ী, অর্থাৎ ফৌজদারি রিপোর্ট অবশ্য দেয় ট্রাফিক পুলিশ। কী ভাবে?
দুর্ঘটনার পরে ফৌজদারি বিষয়ের কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সংশ্লিষ্ট গাড়িটির ‘মেকানিক্যাল টেস্ট’ করায়। তার ভিত্তিতেই নির্ধারণ হয় গাড়িটির ত্রুটি ছিল, না কি চালকই গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। অনেক ক্ষেত্রেই দোষী প্রমাণিত হন চালকেরা। অভিযোগ অবশ্য বারবারই উঠেছে, পুলিশ, বিমা সংস্থা আর মোটর ভেহিকল্স এই তিনের ‘আঁতাতে’ দুর্ঘটনার তদন্ত প্রায় প্রহসনের পর্যায়ে চলে যায়। একই সঙ্গে মৃতের পরিবার কতটা ক্ষতিপূরণ পাবে, তা বিচারের প্রক্রিয়া কতটা যৌক্তিক, প্রশ্ন ওঠে তা নিয়েও। যদিও বিমা সংস্থার সঙ্গে পুলিশের যোগসূত্র নিয়ে ওঠা অভিযোগ মানতে নারাজ ট্রাফিক-কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, কত টাকা ক্ষতিপূরণ মিলবে, তাতে পুলিশের হাত নেই। তবে দুর্ঘটনার জন্য কে দায়ী, তা চিহ্নিত করতে সাহায্য করে পুলিশের দেওয়া রিপোর্ট। |
দুর্ঘটনায় বাবাইয়ের মৃত্যু এবং ক্ষতিপূরণ পাওয়া নিয়ে অর্ক, স্বপনের লড়াইয়ের গল্পকে বাস্তব চেহারা দিতে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায় তৈরি করেছেন সিনেমা। নাম ‘অ্যাক্সিডেন্ট’। আগামী কাল যা মুক্তি পাবে শহরের বিভিন্ন হলে। বাস্তবের সঙ্গে এই ছবির যোগ কতটা? “সিনেমায় কী দেখানো হচ্ছে, তা নিয়ে এখনই কোনও মন্তব্য করব না,” বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ডিসি (ট্রাফিক) দিলীপকুমার আদক।
তবে পুলিশের একাংশ বলছে, বিমা সংস্থার ইনস্পেক্টরেরা মৃতের পরিবারের সামাজিক, মানসিক পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে ক্ষতিপূরণের বিচার করেন। ছোটদের ক্ষেত্রে দেখা হয় তার ভবিষ্যতের দায়িত্ব। বিমার টাকা বাঁচানোর জন্য অনেক সময়েই এই রিপোর্ট নিয়ে নানা টালবাহানা করা হয় বলেও অভিযোগ ওঠে। গাড়ির ক্ষতিপূরণের মামলার সঙ্গে জড়িত থাকা আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, দুর্ঘটনার পরেই মৃতের পরিবারের কাছে হাজির হন আইনজীবী ও বিমা ইনস্পক্টরেরা। মানসিক আঘাতের সুযোগ নিয়ে পুরো ঘটনাটিই লঘু করে দেওয়ার চেষ্টা হয়। পাশাপাশি, অনেক আইনজীবী বিমার টাকার একটি বড় অংশ নিজেদের পারিশ্রমিক হিসেবেও নিয়ে নেন বলে পুলিশ সূত্রে খবর।
পুলিশ সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, কলকাতার রাস্তায় এখনও বহু গাড়ির অবস্থাই যথাযথ নয়। কোনওটির তাপ্পি মারা চাকা, কোনওটির আবার ব্রেক ঠিক মতো কাজ করে না। তবু মোটর ভেহিকল্স দফতরের পরীক্ষায় ঠিক মতো পাশ করে যায় সেই গাড়িগুলি। এই ছবি অবশ্য বারবার উঠেও এসেছে সংবাদমাধ্যমে। বছর কয়েক আগে হাওড়ায় সেতুর উপর থেকে একটি বাস পড়ে গিয়েছিল তাপ্পি মারা চাকার কারণেই। পুলিশ বলছে, ওই চালক ব্রেক কষলেও গাড়িটি না থেমে উল্টে যায়। কেন চলছে এ ভাবে বাস-লরি?
শিবপ্রসাদ-নন্দিতার সিনেমায় সে উত্তর দিয়েছেন বাস মালিকরূপী খরাজ মুখোপাধ্যায়। তেলের দাম থেকে পুলিশ-ইউনিয়নের মাসোহারা সব বাড়লেও বাড়েনি বাসের ভাড়া। এ কথা উঠে এসেছে তাঁর সংলাপে। কোথা থেকে আসবে নিয়ম মেনে চলার খরচ? একই সুর মিলেছে বাস মালিকদের কথাতেও। ‘জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেট’-এর যুগ্ম সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “বাসের ভাড়া না বাড়ায় দিন দিন ক্ষতির মুখে পড়ছেন বাস-মালিকেরা।” বাস সংগঠনের অপর এক নেতা জানান, বাসের এক জোড়া টায়ারের দাম ৩৬,০০০ টাকা। আয় না থাকলে নতুন টায়ার কেনা সম্ভব নয়। তার বদলে টায়ার ভাড়া করেই কাজ চালাতে হচ্ছে।
কেন এমন বিষয় নিয়ে সিনেমা বানালেন শিবপ্রসাদ-নন্দিতা? শিবপ্রসাদ বলছেন, “২০০৮ সালে কেষ্টপুর খালে বাস পড়ে যাওয়ার ঘটনাটি খুব নাড়া দিয়েছিল। তার পরে কয়েক জন বন্ধু-পরিচিতের পথ দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতাও তাতে যোগ হয়েছে।” ‘অ্যাক্সিডেন্ট’-এ অর্ক-স্বপনের লড়াই নড়িয়ে দিয়েছে প্রশাসনকে। তবে সেই নড়ে যাওয়া ঘটনা পর্দাতেই আটকে থাকে কি না, সেটাই দেখার। |