প্রবন্ধ ২...
এই অধিগ্রহণ আইন চালু হলে উন্নয়ন বিপাকে পড়বে
মি অধিগ্রহণের প্রশ্নটি ফের সংবাদ শিরোনামে এসেছে। গত বছর কেন্দ্রীয় সরকার যে জমি অধিগ্রহণ আইনটির প্রস্তাব পেশ করেছিল, তার বিরোধিতা করলেন সরকারেরই বেশ কয়েক জন মন্ত্রী। তাঁদের বিরোধিতার মূল কারণ, এই আইনটি পাশ হয়ে কার্যকর হলে জমির দাম এত বেড়ে যাবে যে দেশে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ বাধা পাবে। শিল্প ও বাণিজ্যমহল দীর্ঘ দিন ধরে এই কথাটাই বলছে, কাজেই মন্ত্রীদের আপত্তিতে আশ্চর্য হওয়ার কারণ নেই। সরকারের কথাটা বুঝতে এত সময় লাগল, তাতেই অবাক লাগছে।
দেশের প্রায় সব প্রান্তেই জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে কোথাও সড়ক প্রকল্পের বিরুদ্ধে, কোথাও বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে, এবং বহু জায়গাতেই বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির বিরুদ্ধে। জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে অসন্তোষ কিছু নতুন নয় নতুন হল ২০০৭ সাল থেকে আরম্ভ হওয়া প্রতিরোধের বিস্ফোরণ।
প্রতিবাদের নানান কারণ রয়েছে এবং দেখানো হয়। তবে, নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল জমির দাম। স্বাধীন ভারতের সরকার ষাট বছরে প্রচুর জমি অধিগ্রহণ করেছে। ভাকরানাঙ্গাল থেকে ডি ভি সি, রৌরকেল্লা থেকে দুর্গাপুর, সেচ থেকে প্রতিরক্ষা, বিজলি, সড়ক, পানি সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে ছ’কোটি একর জমি অধিগ্রহণ বা বা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ, যাঁদের মধ্যে অনেকে হয়ে গিয়েছেন ‘ডেভেলপমেন্ট রিফিউজি’ বা উন্নয়নের উদ্বাস্তু। আর, ক্ষতির প্রধান কারণ সরকার জমি নিয়েছে জলের দরে। ২০০০ সাল অবধি শয়ে শয়ে একর অধিগ্রহণ করা হয়েছে এক লক্ষ বা তারও কম টাকায়। সরকার দাবি করত, এটাই বাজার দর। বাজার দর দিচ্ছি, তার ওপর ৩০ শতাংশ ক্ষতিপূরণ। এটাই আইন এবং ন্যায্য।
কিন্তু চাষজমির লিখিত ও সত্য বাজার দরের মধ্যে অল্প থেকে অনেক ফারাক থাকে। আদৌ পার্থক্য আছে কি না, থাকলে সেটা কতটা, তার হেরফের আছে রাজ্য থেকে রাজ্যে, অঞ্চল থেকে অঞ্চলে। সরকার আগে স্বীকার করত না, এখন বাধ্য হয়ে করছে।
এখন অধিগ্রহণের দাবানল জ্বলে ওঠার পর, অধিগ্রহণ করতে গিয়ে পদে পদে ঠোক্কর খাওয়ার পর, গত বছর এই সময় নাগাদ কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক জমি অধিগ্রহণ নিয়ে একটি বিল প্রস্তাব করে। নাম ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসেটেলমেন্ট বিল, ২০১১ (সংক্ষেপে, এল এ আর আর)। প্রথম ইউ পি এ সরকার আলাদা বিল তৈরি করেছিল অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন নিয়ে, কিন্তু সেই বিল দুটিকে আইন বানাতে পারেনি। সেই বিল দুটি জোড়া দিয়েই তৈরি হয়েছে এই নতুন বিল। বিলটি এক বার মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়ে, পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটি ঘুরে ফের মন্ত্রিসভায় এসে আটকে গিয়েছে।
নতুন জমি অধিগ্রহণ আইন চালু হলে সিঙ্গুরে জমির দাম হবে একরপ্রতি ৭৫ লক্ষ টাকা।
বিলটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দুটো এক, বেসরকারি স্বার্থে সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে কি না; দুই, অধিগৃহীত জমির দাম কী হবে? দ্বিতীয় প্রশ্নটি নিয়ে কিছু কথা বলি। এল এ আর আর অনুযায়ী, যে জমি অধিগ্রহণ করা হবে, প্রথমে তার ‘বাজার মূল্য’ নির্ধারণ করা হবে। গ্রামাঞ্চলে জমির দাম বাবদ দেওয়া হবে বাজার দরের চার গুণ, আর শহরাঞ্চলে দেওয়া হবে দ্বিগুণ। জমির কাগুজে দাম আর প্রকৃত দামের যে ফারাকের কথা একটু আগে বলেছিলাম, এই ব্যবস্থায় তার একটা সমাধান হওয়া সম্ভব। এ ছাড়াও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। যাঁরা জমির মালিক নন, কিন্তু জীবিকার জন্য অধিগৃহীত জমির ওপর নির্ভরশীল, তাঁরাও পুনর্বাসনের সুবিধা পাবেন, কিছু ক্ষতিপূরণ ও ভাতাও পাবেন। এ তো ভাল কথা। তা হলে সমস্যা কোথায়?

সমস্যাটি এই যে সরকার একটি বাজারি আইন বানাতে চায় জমি নিয়ে, কিন্তু জমির বাজার সম্বন্ধে কোনও খবর না রেখে। এই আইন একটা ভ্রান্ত পূর্বধারণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে গোটা দেশের জমির বাজারের একই হাল। এর চেয়ে ভ্রান্ত ধারণা আর হয় না। দেশে এখন মোটামুটি চার রকমের জমির বাজার রয়েছে। প্রথমটি হল ছোট থেকে বড়, সব শহর এবং অধিকাংশ শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকার বাজার। এই বাজারে জমির দাম চড়া বা খুব চড়া এবং কাগুজে আর প্রকৃত দামের মধ্যে কোনও ফারাক নেই। দ্বিতীয়টি হল ছোট শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম-এলাকার জমির বাজার। এখানে লিখিত আর প্রকৃত দামে সামান্য ফারাক আছে, তবে ক্রমশ সেই ফারাক মুছে যাচ্ছে। তৃতীয় হল সুদূর এবং প্রত্যন্ত গ্রামের জমির বাজার। এই বাজার সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান এখনও সীমিত। এখানে লিখিত ও প্রকৃত দামের মধ্যে সম্ভবত অনেকটাই ফারাক আছে কিন্তু কতটা, তা অজ্ঞাত। আমার অনুমান, এল এ আর আর মূলত এই বাজারের কথা মাথায় রেখেই তৈরি, এবং এই বাজারে আইনটি প্রযোজ্য হলেও হতে পারে। চতুর্থ বাজারটি আসলে বাজার নয়, তা বাজার ব্যবস্থার বাইরে থাকা জমি। এই জমির দাম জানা সম্ভব নয়, কারণ এই জমি বেচা-কেনা হয় না। ওড়িশার নিয়মগিরি পাহাড় এলাকা, যেখানে বেদান্তের প্রকল্প তৈরি নিয়ে বিপুল আলোড়ন হয়েছে, তা এই ধরনের জমির একটা ভাল উদাহরণ।
গত দশ বছরে জমির দাম কী ভাবে বেড়েছে, সরকার তার হিসেব রাখেনি। শহরে জমির দাম বেড়েছে পাঁচ গুণ, গ্রামাঞ্চলে আরও বেশি। জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে জমির দাম ছাড়াও আরও খরচ আছে জমির মালিক এবং জমির ওপর নির্ভরশীল, এই দুই শ্রেণির জন্য পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণবাবদ খরচ। সব মিলিয়ে, এল এ আর আর-এর বিধান মেনে জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে এখন যে খরচ পড়বে, তা গ্রামাঞ্চলে ২০০১ সালের তুলনায় প্রায় পঁচিশ গুণ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশি। শহরাঞ্চলে দাম দাঁড়াবে ২০০১ সালের দামের দশ গুণের এ দিক-ও দিক।
ভারতে সবচেয়ে দামি জমি মুম্বই শহরে। দক্ষিণ মুম্বইয়ে এক একর জমির দাম ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা। শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে, যেখান থেকে কৃষিজমি আরম্ভ হচ্ছে, সেখানে এক একর জমির দাম ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা। দিল্লিতে একরপ্রতি ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা, কলকাতায় ২৫ কোটি টাকা থেকে ৫ কোটি টাকার মধ্যে। আর, কৃষিজমির দাম অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে। ২০০৮ সালে মোহালি বিমানবন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল একরপ্রতি সওয়া কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা দরে। একটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জলাজমি (যাতে চাষ করা যায় না) অধিগ্রহণ করা হয়েছে একরপ্রতি ২০ লক্ষ টাকায়। হরিয়ানাতে একরপ্রতি ৫০-৬০ লক্ষ টাকা দিয়েও জমি অধিগ্রহণ করতে অসুবিধা হচ্ছে নানা প্রকল্পে। গোটা দুনিয়ার মাপকাঠিতে ভারতে জমির দাম খুব ওপরের দিকে।

বামফ্রন্ট সরকার সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ করেছিল একরপ্রতি মোটামুটি নয় লক্ষ টাকায়। বিশেষজ্ঞদের মতে আরও দুই-তিন লক্ষ টাকা দিলে কোনও বিবাদই হত না। এল এ আর আর আইনের হিসাবে সিঙ্গুরের এই জমির দাম তখনই হত একরপ্রতি ৭৫ লক্ষ টাকার কাছাকাছি। আর, সিঙ্গুর থেকে সরানো ন্যানো কারখানা যেখানে গিয়েছে গুজরাতের সানন্দে জমির মালিকরা পেয়েছেন একরপ্রতি ৫০ লক্ষ টাকার ওপর। এ জমিতে চাষ করলে বেশি হলে ২০,০০০ টাকা লাভ বা উপার্জন হতে পারে বছরে দুই পুরুষের চাষে সর্বসাকুল্যে আজকের হিসেবে পাঁচ লক্ষ টাকা। সানন্দে বেশ কিছু জমির মালিক গুজরাতি সিনেমার প্রযোজক হয়ে গিয়েছেন।
গত পাঁচ দশ বছরে দেশের জমির বাজারে একটা আমূল পরিবর্তন হয়েছে। শুধু শহরে নয়, জমির দাম নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে শহরের লাগোয়া এবং শহর থেকে দূরের বর্ধিষ্ণু গ্রামাঞ্চলে। এই বাজারে এল এ আর আর একটি চলমান নিশানার দিকে অন্ধকারে ছোড়া ঢিল। এল এ আর আর যদি আইন হয়ে যায় তবে একরপ্রতি, অঞ্চল অনুযায়ী শহরপ্রান্তে জমি অধিগ্রহণের দাম পড়বে আট থেকে চল্লিশ কোটি টাকা; গ্রামাঞ্চলে ২৫ লক্ষ থেকে দেড়-দুই কোটি টাকা। থমকে যাবে বহু উন্নয়নমূলক কাজ, আর তার সঙ্গে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ। একটি বড় মাপের বাঁধ ও সেচ প্রকল্পের কথা ভাবুন। জমি লাগবে এক থেকে দুই লক্ষ একর। জমির দাম পড়বে পঁচিশ হাজার কোটি টাকা থেকে দুই লক্ষ কোটি টাকা। এত টাকা কোথায়?
সরকারকে একটা কথা বুঝতে হবে একটা ভুলের সংশোধন আর একটা ভুল দিয়ে করা যায় না। তা ছাড়া, অন্য উপায় আছে জমির মালিক এবং জমিহীনদের সুবিচার ও ন্যায় দিয়ে জমি অধিগ্রহণের রাস্তা খোলা রাখার কিন্তু সে জায়গায় পৌঁছতে ক্ষণস্থায়ী রাজনৈতিক লাভের ঊর্ধ্বে ভাবতে হবে। এই মুহূর্তে, আর কিছু না হোক, এল এ আর আর আইনটি আটকানো দরকার।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে নগরবিদ্যার শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.