মিউচুয়াল ফান্ড
সুবিধার সাত-সতেরো
শুধু ব্যাঙ্ক, বিমা আর ডাকঘর প্রকল্পের চৌহদ্দি ছেড়ে একটু অন্য কোথাও টাকা খাটাতে চান অনেকেই। চেষ্টা করেন এই আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির বাজারে কষ্টের রোজগার দু’পয়সা বেশি বাঁচানোর। কিন্তু তাতে প্রায়ই বাধা হয়ে দাঁড়ায় শেয়ার বাজারের ঝুঁকি। তাই যাঁরা বাজারের ঝুঁকি যথাসম্ভব এড়িয়েও সেখানকার সুফল কুড়োতে চান, মিউচুয়াল ফান্ডই তাঁদের সেরা বাজি।
আজ এই ফান্ডের সাত-সতেরো নিয়েই আলোচনা করব আমরা। খতিয়ে দেখব এখানে টাকা রাখার সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু তার আগে আনকোরা লগ্নিকারীদের স্বার্থে বরং এক্কেবারে গোড়াতেই একটা আলোচনা সেরে ফেলি। তা হল, আদপে এই ফান্ড বিষয়টি কী?

মিউচুয়াল ফান্ড কী?
এই ফান্ড আসলে আমার-আপনার মতো অনেকের টাকা নিয়ে তৈরি একটি তহবিল (‘পুল’ বা সমষ্টি)। যা পরিচালনার দায়িত্বে থাকে কোনও সংস্থার তৈরি একটি ট্রাস্ট। অনেক লগ্নিকারীর টাকা একত্রিত করে তৈরি ওই তহবিল সাধারণত বিনিয়োগ করা হয় বিভিন্ন শেয়ার কিংবা ঋণপত্রে। তার বদলে আপনি পান কিছু ‘ইউনিট’। বাজারে (শেয়ার, বন্ড ইত্যাদিতে) ওই টাকা খাটানোর দায়িত্ব বর্তায় অভিজ্ঞ ও পেশাদার ফান্ড পরিচালকের উপর। তাঁর মূল লক্ষ্য, মাথা খাটিয়ে শেয়ার-বন্ড কেনাবেচার মাধ্যমে তহবিলের মূল্যবৃদ্ধি। যাতে পরে ইউনিট বেচে প্রকল্প থেকে বেরিয়ে এলে অনেকখানি লাভ করতে পারেন আপনি। কিংবা তা ধরে রাখলেও ডিভিডেন্ডের অর্থ আসে আপনার ঝুলিতে।

জনপ্রিয়তার রহস্য
লগ্নির পছন্দসই গন্তব্য হিসেবে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট জনপ্রিয় মিউচুয়াল ফান্ড। বিশেষত নতুন প্রজন্মের কাছে তার কদর বাড়ছে দ্রুত। এর কারণ আন্দাজ করা অবশ্য কঠিন নয়। কারণ, এমন অনেকেই আছেন, যাঁদের হাতে খাটানোর মতো টাকা রয়েছে। ইচ্ছেও আছে শেয়ার কিংবা বন্ডে লগ্নি করার। কিন্তু বাজার সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা না-থাকায় সেখানে লগ্নির ঝুঁকি নিতে চান না তাঁরা। অনেকের আবার হয়তো টাকা, ইচ্ছে ও দক্ষতা রয়েছে, কিন্তু সময় বাড়ন্ত। যা বাজারের ওঠা-পড়া সম্পর্কে নিয়মিত খবর রাখার জন্য একান্ত জরুরি। এই দু’ধরনের মানুষই স্বচ্ছন্দে বিনিয়োগের পছন্দসই মাধ্যম হিসেবে বেছে নিতে পারেন মিউচুয়াল ফান্ডকে। যাতে অযথা ঝুঁকি না-বাড়িয়েও ভারী রাখা যায়
‘রিটার্ন’-এর পাল্লা।

ফান্ডেই লগ্নি কেন?
মিউচুয়াল ফান্ড কী আর কেনই বা তার কদর, কিছুটা হলেও এখন তা আমাদের কাছে স্পষ্ট। এ বার খতিয়ে দেখা যেতে পারে যে, এই ফান্ডে লগ্নির মূল সুবিধাগুলি কী কী—

(১) কম খরচে বাজারে পা। বাজারে পছন্দসই শেয়ার বা বন্ড কিনতে পকেটের জোর থাকতে হবে যথেষ্ট। বিশেষত যদি ঝুঁকি এড়াতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বেশ কয়েকটি সংস্থার শেয়ার কেনার ইচ্ছে থাকে, তা হলে তো মাঠে নামতে হবে রীতিমতো বড় অঙ্ক হাতে নিয়ে। কিন্তু অনেকের পক্ষেই অতটা টাকা জোগাড় করা বেশ অসুবিধাজনক। আর ঠিক এখানেই মুশকিল আসান মিউচুয়াল ফান্ড।
এখানে সকলের টাকা এক জায়গায় করে তা দিয়ে বিভিন্ন সংস্থার শেয়ার বা বন্ড কিনছেন ফান্ড ম্যানেজার। তাই তার সুফল হিসেবে বহু সংস্থার শেয়ারে নিজের লগ্নি ছড়িয়ে দিতে পারছেন আপনিও। এখন তো মাত্র এক হাজার টাকা খরচ করেই ফান্ডে লগ্নি করার সুযোগ রয়েছে। এত কম টাকার বিনিময়ে অনেক সংস্থার শেয়ার বা বন্ডে লগ্নি করার সুযোগ আর কে দিতে পারে আপনাকে?

(২) লগ্নি ছড়িয়ে ঝুঁকিতে রাশ। ধরা যাক, সরাসরি শেয়ার কেনার মাধ্যমে কোনও একটি বা দু’টি সংস্থায় লগ্নি করলেন আপনি। দর উঠলে ভাল কথা। কিন্তু তা না হলে? তখন তো পুরো লগ্নিই জলে। এই ঝুঁকি এড়াতেই ফান্ডে লগ্নি করেন অনেকে। কারণ, রীতিমতো হিসাব কষে বিভিন্ন ক্ষেত্রের (যেমন, তথ্যপ্রযুক্তি, তেল ও গ্যাস, ইস্পাত, বিদ্যুৎ, গাড়ি ইত্যাদি) বিভিন্ন সংস্থার শেয়ার এবং বন্ডে লগ্নি ছড়িয়ে দেন ফান্ড ম্যানেজার। দেখা যাবে হয়তো ৫০ থেকে ৭০টি সংস্থার শেয়ারে টাকা ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। যাতে কিছু সংস্থা আশানুরূপ ফল না-করলেও, তাকে টেনে তোলার ক্ষমতা রাখে বাকি সংস্থাগুলি। অনেক ক্ষেত্রে আবার শুধু বাজারে বিনিয়োগের ঝুঁকি এড়াতে তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ বন্ডেও টাকার একটা বড় অংশ খাটান তাঁরা। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ঝুঁকি কমে। সুরক্ষিত হয় লগ্নি। তা ছাড়া, সুবিধা রয়েছে প্রয়োজন হলে প্রকল্প ছেড়ে বেরিয়ে আসারও।

(৩) ফান্ড ম্যানেজারের দক্ষতা। এ কথা ঠিকই যে, আখেরে এক জন সাধারণ লগ্নিকারীর তুলনায় কোনও ফান্ড ম্যানেজার বাজার থেকে কতটা বেশি ‘রিটার্ন’ আদায় করতে পারেন, তা নিয়ে বিতর্ক আছে বিস্তর। কিন্তু তা বলে এ কথা অস্বীকার করারও উপায় নেই যে, এই বিষয়ে আর পাঁচ জনের তুলনায় তাঁর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অনেকটাই বেশি। বাজারটাকে তিনি চেনেন প্রায় হাতের তালুর মতো। শুধু তা-ই নয়।
শেয়ার বাজারের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণের অনেক সফটওয়্যারই তাঁর নখদর্পণে। আর সব থেকে বড় কথা, প্রতিদিন অফিসে এসে শুধু এই বিষয়টি নিয়েই ক্রমাগত মাথা ঘামিয়ে চলেছেন তিনি। ফলে সব মিলিয়ে, তাঁর হেফাজতেই লগ্নি বেশি সুরক্ষিত থাকার কথা। তুলনায় ভাল হওয়া উচিত রিটার্ন-ও। অন্তত সাধারণ বুদ্ধি তা-ই বলে।

(৪) ‘বটগাছ’ সেবি। যে কোনও মিউচুয়াল ফান্ড প্রকল্প চালু করার জন্যই শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সেবি-র অনুমোদন জরুরি। প্রকল্পের প্রতিটি স্তরে বাজার নিয়ন্ত্রকের নিয়ম-কানুনও মেনে চলতে হয় সংস্থাগুলিকে। তহবিল সংগ্রহ থেকে শুরু করে লগ্নি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই বাধ্যতামূলক ভাবে জমা দিতে হয় বিভিন্ন তথ্য এবং নথি। ফলে পুরো বিষয়টিতে স্বচ্ছতা বজায় থাকে। লগ্নি সুরক্ষিত হয়।

যাঁর যেমন, তাঁর তেমন
মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা লাগানোর যে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা আছে, এতক্ষণে তা আমাদের কাছে পরিষ্কার। তবে আর একটি বিষয় উল্লেখ না-করলে, তা একেবারেই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সেটি হল, ফান্ডের রকমফের।
এত রকম ফান্ড এখন বাজারে রয়েছে, যে তাদের মধ্যে থেকে একেবারে নিজের মনের মতোটি বেছে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে আপনার সামনে। নিজের লগ্নি করার সামর্থ্য, ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছা, পছন্দসই মেয়াদ, টাকা দেওয়ার পদ্ধতি (থোক বা মাসিক কিস্তি) ইত্যাদি খতিয়ে দেখে প্রকল্প বাছাই করতে পারেন আপনি।

ঝুঁকির দাঁড়িপাল্লা আপনার হাতেই
পছন্দসই ফান্ড বাছার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে একটি উদাহরণ দিলে। সহজ ভাবে বোঝার খাতিরে ধরা যাক, দু’ধরনের লগ্নিকারী আছেন। এক, যাঁরা বেশি রিটার্ন পেতে অতিরিক্ত ঝুঁকি নিতে তৈরি। আর দুই, যাঁদের অতখানি ঝুঁকি নিতে প্রবল আপত্তি রয়েছে। অর্থাৎ, লগ্নির সুরক্ষাই যাঁঁদের প্রধান মাথাব্যথা।
দু’ধরনের লগ্নিকারীই শুরুতে স্পষ্ট জানিয়ে দিতে পারেন যে, আদপে কতটা ঝুঁকি নিতে চান তাঁরা। বা বলা ভাল, সেই অনুযায়ীই বেছে নিতে পারেন প্রকল্প।
দেখা যাবে হয়তো দ্বিতীয় ধরনের বিনিয়োগকারীকে ‘ইক্যুইটি ফান্ড’-এ টাকা ঢালতে সে ভাবে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে না। বরং তাঁদের টাকার বেশির ভাগ অংশটাই খাটছে বিভিন্ন বন্ডে। আর যদিও বা সেই টাকা শেয়ারে লাগানো হয়, বেছে বেছে তা করা হচ্ছে শুধু কিছু নামী সংস্থার নির্ভরযোগ্য শেয়ারে। সাধারণত, শুধুমাত্র কোনও একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের (ধরা যাক, তথ্যপ্রযুক্তি) বিভিন্ন সংস্থার শেয়ারে এঁদের টাকা লগ্নি করা হয় না। যেহেতু এই ধরনের ‘সেক্টর ফান্ড’-এ হঠাৎ কোনও কারণে সমস্ত সংস্থার শেয়ার দর এক সঙ্গে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
আবার যাঁরা রিটার্ন বেশি পেতে অতিরিক্ত ঝুঁকি নিতে পিছপা নন, অনেক সময়েই সেক্টর ফান্ড কিংবা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফান্ডে লগ্নি করেন তাঁরা। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের টাকা লগ্নি করা হয় তুলনায় কম পরিচিত শেয়ারে। বেশি মুনাফার আশায় বাছা হয় এমন বন্ড, যার রেটিং তেমন উঁচু দরের নয়।

সুতরাং...
নিজের জন্য মিউচুয়াল ফান্ড প্রকল্প বাছাইয়ের কোনও বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই। যেমন নেই কতটা ঝুঁকি আমার পক্ষে ঠিক, তা নির্ধারণের ব্যাকরণও। তাই নিজের আর্থিক সামর্থ্য, অন্যান্য বিনিয়োগ, পারিবারিক দায়, প্রকল্পের মেয়াদ ইত্যাদি সমস্ত বিষয় মাথায় রেখে প্রকল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকে।

খেয়াল রাখুন
গোড়াতেই ঠিক করুন সত্যিই কতটা ঝুঁকি নিতে চান। সেই অনুসারে বাছাই করুন প্রকল্প।
যাচাই করুন ফান্ডের প্রোমোটারের ধারাবাহিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা।
শুধু আগের সাফল্য দেখে লগ্নি করবেন না। পুনরাবৃত্তি না-ই হতে পারে।
অন্যের কথায় বিশ্বাস করে অন্ধ ভাবে ফান্ড বাছবেন না। দেখুন, সেই ফান্ড আপনার চাহিদা আদৌ পূরণ করে কিনা।
প্রকল্পে লগ্নি থেকে করছাড়ের সুবিধা পাবেন তো?
নেট অ্যাসেট ভ্যালু (ন্যাভ) গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই, কিন্তু শেষ কথা নয়।
কম বয়স থেকে নিয়মিত লগ্নি করা অভ্যাস করুন। সুযোগ বুঝে মুনাফা তুলতে ভুলবেন না।
শুধু ডিস্ট্রিবিউটরের উপর নির্ভর না-করে প্রকল্প বাছাইয়ের জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.