রবিবাসরীয় গল্প
কাঁকনের সংসার
ঠোনে দাঁড়িয়ে টিয়াপাখিকে কাঁচালঙ্কা খাওয়াচ্ছিল কাঁকন। খাওয়ানোর থেকে খেলাই করছিল বেশি। খাঁচার জালের ফাঁক দিয়ে এক বার করে লঙ্কাটাকে পাখির ঠোঁটের কাছে আনে, আবার সরিয়ে নেয়। পাখি কাঁকনের দুষ্টুমি বুঝতে পেরে হঠাৎ ঘাড় বাঁকিয়ে ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দে প্রবল বকুনি দেয় তাকে। কাঁকন হেসে ফেলে। বলে, ইস্, বুড়োর মেজাজ দেখো না এক বার।
টিউবওয়েলতলা থেকে শীতের রোদ এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে দাওয়ায় উঠে পড়ে। শানবাঁধানো জায়গাটুকুতে ওড়াউড়ি করে শুকনো পেয়ারাপাতা। কাঁকন আড় চোখে পড়ন্ত রোদ্দুরের দিকে চেয়ে বলে, আর খেলার সময় নেই, বুঝলি। চান করতে হবে। এই নে, দিয়েই দিলাম। লঙ্কাটাকে টিয়ার বাড়িয়ে দেওয়া ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দিয়ে সে আঁচলে হাত মুছে ঘরে ফেরার উদ্যোগ করে। ঠিক তখনই কে যেন সদর দরজায় দাঁড়িয়ে ভারী গলায় ডাক দেয়— সুবীর! সুবীর আছো নাকি?
এই অবেলায় কে তার বরের নাম ধরে ডাকে! ত্রস্ত কাঁকন আঁচল দিয়ে ভাল করে বুক পিঠ ঢেকে সদরের দিকে দু’পা এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে— কে?
এক ভদ্রলোক দরজা পেরিয়ে উঠোনে পা রাখেন। পঞ্চান্ন-ষাটের মধ্যে বয়েস হবে। বলেন, সুবীর হালদারের বাড়ি তো এটা?
কাঁকন কথা না বলে ঘাড় হেলিয়ে জানায়, ওঁর অনুমান ঠিক। তার পর বড় বড় চোখে এক চোখ প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে ভদ্রলোকের মুখের দিকে।
ভদ্রলোকের সুন্দর মুখে ক্লান্তি আর বিষাদের গাঢ় সর। তিনি এলোমেলো চুলের মধ্যে আঙুল চালান। এ দিক ও দিক তাকান। টিউবওয়েলতলার পাশে কলঘর। তার পিছনে তিনটে সুপুরিগাছ। সুপুরিগাছের চুড়োর দিকে চোখ পড়তে কয়েক মুহূর্তের জন্যে লোকটার ভেতর থেকে অন্য একটা খুশিয়াল মানুষ বেরিয়ে আসে। বলে ওঠেন, বাঃ, কত দিন বাদে বাবুইপাখির বাসা দেখলাম।
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে কাঁকনও সেই দিকে তাকায়। হলদে চড়াইয়ের মতন পাখিগুলো সারাক্ষণই ঠোঁটে করে ঘাসপাতা এনে এটা বুনছে ওটা বুনছে। দেখে দেখে এমন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে যে, কাঁকনের আর আলাদা করে ও সব চোখেই পড়ে না। সে গাছের ডগা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে। লোকটার মুখে ততক্ষণে আবার গ্রহণ লেগেছে। সেই মুখের দিকে চেয়ে কাঁকন বলে, কোত্থেকে আসছেন?
উনি পকেট থেকে পরিষ্কার সাদা রুমাল বার করেন। চোখ থেকে দামি চশমাটা খুলে মন দিয়ে কাচ পরিষ্কার করতে করতে বলেন, এখন তো আসছি হাওড়া হাসপাতাল থেকে। বাড়ি আমার সোনারপুরে। সোনারপুর চেনো তো?
কাঁকন সোনারপুরে যায়নি কখনও। কিন্তু সোনারপুর নামটা কানে গেলেই তার বুকের মধ্যে রিনরিন করে সোনার নুপুর বেজে ওঠে। ওখানেই যে তার বর থেকেছে কত কাল। পড়াশোনা করা, বড় হয়ে ওঠা সব তো ওখানেই, ওই না দেখা সোনারপুরে। কাঁকন তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেতের চেয়ার এনে দাওয়ার রোদ্দুরে পেতে দেয়। বলে, ওর তো ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধে সাতটা বেজে যাবে। আপনি এখানে এসে বসুন না।
বসব? আচ্ছা, বসেই যাই একটু। আসলে সুবীরের সঙ্গে আমার সে রকম কিছু দরকার নেই। এ দিকে এসেছিলাম তো। তাই ভাবলাম, ও কী রকম ঘর সংসার করছে এক বার দেখে যাই।
কাঁকন জানে, কেন সোনারপুরের কথা সুবীর খুব একটা বলতে চায় না। আসলে দিনগুলো তো কষ্টেরই ছিল। টিউশন করে পড়া চালাবার দিন, ছ’মাইল সাইকেল চালিয়ে কলেজ যাওয়ার দিন, অনেক অনেকক্ষণ খালি পেটে থাকার দিন। কষ্টের কথা কে আর মনে রাখতে চায়? তবে তার মধ্যেও কেউ কেউ কি আর সে দিনের সুবীরকে আগলে রাখেনি? একটা ছেলে তো আর একদম একা বড় হয়ে উঠতে পারে না। কাঁকনের আর সন্দেহ থাকে না যে, ইনি সুবীরের সে রকমই এক জন দয়ালু প্রতিবেশী।
বালির কুণ্ডে জল জমার মতন কাঁকনের বুকের ভেতরটা কুলকুল করে কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে। এঁদের মতন লোকেরা ছিলেন বলেই তো সে তার এক ভাল বরটাকে পেয়েছে। এঁরাই নিশ্চয় সেই দুর্দিনে বইখাতা কিনে দিয়েছেন সুবীরকে। শার্ট-পাজামা কিনে দিয়েছেন। সাইকেল সারানোর টাকা দিয়েছেন। পরীক্ষার ফর্ম ফিল-আপ করার টাকা— সে টাকাও এঁরা না দিলে সুবীর কোথায় পেত?
আর তার পর, আজ অবসর পেয়ে ইনি দেখতে এসেছেন সে দিনের সেই চারাগাছটা বড় হয়ে কী রকম ছায়া ছড়াচ্ছে। ক’জন এ ভাবে আসে বলো তো।
ভদ্রলোককে বাইরে বসিয়ে রেখে কাঁকন দ্রুত পায়ে ঘরে ঢোকে। ঠাকুরের আসনের সামনে উবু হয়ে বসে প্রসাদের থালায় রাখা চারটে গুজিয়া থেকে টোকা মেরে ডেঁয়ো পিঁপড়ে ছাড়ায়। দোলের মেলায় কেনা প্লাস্টিকের ফুলছাপ প্লেট আঁচল দিয়ে ভাল করে মুছে তার ওপর গুজিয়াগুলো সাজিয়ে দেয়। কেনার পর এই প্রথম ব্যবহার হবে জিনিসটা। কেউ আসেই না তো খেতে দেবে কাকে? কাঁসার গেলাসে জল ঢালে। ভাবে এই বার ভাল কাচের গেলাসও কিনবে ক’টা।
কাঁকনের ছোটবেলা থেকেই খুব ঘরকন্নার শখ। বিয়ের পর থেকে চুটিয়ে সেই শখ মিটিয়ে নিচ্ছিল সে। কিন্তু কেউ না দেখলে কত দিন একটা শখ জিইয়ে রাখা যায়? সুবীরের তো তিনকুলে কেউ নেইই, আর তার নিজেরও থাকার মধ্যে অসুস্থ মা আর একটি মাত্র দাদা। তাও তারা থাকে সেই আসানসোলে। দাদা দোকান ফেলে বেশি আসতে পারে না। পুজোর আগে এক বার এসেছিল। দুপুরে এসে আবার বিকেলেই ফিরে গেল। দোকান বন্ধ রাখলে ওর চলে না।
আজ হঠাৎ এই ভদ্রলোক এসে ঘুরে ঘুরে তার উঠোন বাগান দেখতে শুরু করবেন কে জানত! কাঁকন মনে মনে ভাবে, কেন যে মরতে গা ঢিলে দিয়ে দিয়েছিলাম। দেখো তো, উঠোনে কত শুকনো পাতা জমেছে। বিকেলেই সব ঝেঁটিয়ে ফেলব।
ভাল লাগছিল, খুব ভাল লাগছিল কাঁকনের। কেমন পরমাত্মীয়ের মতন উনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কত কী জিজ্ঞেস করছেন। উঠোনের একপাশে সার দিয়ে গাঁদা গাছের চারা লাগিয়েছিল কাঁকন। এখন গাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে গিয়েছে। উনি পরম মমতায় সেগুলোর গায়ে হাত বোলালেন কিছুক্ষণ। টিয়ার খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে শিস দিলেন। তার পর টিউবওয়েলতলায় পা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, পুরোটাই শান বাঁধিয়ে নিলে না কেন বউমা?
পয়সা কম পড়ে গেল যে। কথাটা বলতে কাঁকনের একটুও লজ্জা করল না। কারণ, লোকটাকে তার কেবলই মনে হচ্ছিল তার মৃত বাবার মতন। অথচ পোশাকেআশাকে চেহারা-ছবিতে কাঁকনের বাবার সঙ্গে এঁর কোনওই মিল নেই। ইনি অনেক বড়লোক। কত সুন্দর জামাপ্যান্ট। কত সুন্দর জুতো। কাঁকনের বাবা কোনও দিন হাওয়াই চটি ছাড়া কিছু পায়েই দেয়নি। তবুও মিল একটা ছিলই। সেটা স্নেহ-মমতা মাখানো গলার স্বরে। কাঁকনের বাবাও যখন তার সঙ্গে কথা বলতেন, তখন মনে হত সেই কথার মধ্যে দিয়েই যেন পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
কাঁকন বলল, ঘরগুলো দেখবেন?
চলো দেখি।
দেখলেন তিনি। পুরনো শাড়ি কেটে জানলায় জানলায় পর্দা লাগিয়েছিল কাঁকন। সেগুলো দেখলেন। জলের বোতলে রাখা মানিপ্ল্যান্টের লতা বারান্দার গ্রিলের গা বেয়ে লতিয়ে উঠেছিল— দেখলেন। অনেকগুলো নির্জন দুপুর ব্যয় করে একটা টেবিলক্লথে জটিল ফুলপাতার নকশা তুলেছিল কাঁকন। উনি সেটার ওপর হাত বোলাতে বোলাতে হঠাৎই যেন কোন রাজ্যে চলে গেলেন।
মিনিট খানেক চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে, তার পর যেন স্বপ্নের মধ্যে থেকে জেগে উঠে বললেন, বাঃ, ঘরদোর একেবারে ছবির মতন সাজিয়ে রেখেছ। সুন্দর। খুব সুন্দর। আবার ওরা বাইরের দালানে এসে বসল। কাঁকন মোড়ায়, উনি বেতের চেয়ারে। কাঁকন বলল, একটু চা করি কাকাবাবু?
করবে? করো। চা-টা খেয়েই তা হলে বেরিয়ে পড়ি। তোমারও তো চান-খাওয়ার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
কাঁকন বলল, না, না দেরি কোথায়? আমার সব সারতে আড়াইটে বেজে যায়।
এত দেরি হয়! অবাক হয়ে বললেন ভদ্রলোক। কী করো? সুবীর তো বললে সাড়ে ন’টায় অফিস বেরিয়ে যায়।
ওই আর কী...।
কাঁকন ঠিক মতন উত্তর দিতে পারে না। লজ্জা পায়। কেমন করে বলে, এই পুতুলের ঘরের মতন দু’কামরার ছোট্ট বাড়িটাকে ঝাড়তে মুছতে, সাজাতে গোছাতেই তার বেলা চলে যায়। কাঁকন লজ্জা পায় কারণ, আর কেউ না জানুক, সে নিজে তো জানে— বাড়ি নয়, বাড়ির মধ্যে দিয়ে সে আসলে সারা দিন সুবীরকে ছুঁয়ে থাকে। সুবীরের শার্টের ছেঁড়া বোতাম সেলাই করতে গিয়ে সে শার্টটাকে মুখের ওপর চেপে বসে থাকে কত দিন। শার্টের বুক থেকে উঠে আসা ঘাম আর নিকোটিন মেশানো হাল্কা গন্ধটা যেন মাতৃগর্ভের মতন তাকে ঘিরে নেয়— এত নিশ্চিন্ততা, এত নিরাপত্তা ওই মানুষটার ছোঁয়ায়। ঘুম এসে যায় কাঁকনের।
তালঢ্যাঙা সুবীর দেওয়ালের অনেক উঁচুতে পেরেক পুঁতে কাঁকনের দিকে হাত বাড়ায়। কাঁকন সেই হাতে ওদের ফ্রেমে বাঁধানো বিয়ের ফটো ধরিয়ে দেয়। পেশল সুবীর কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে ফুলের বেড তৈরি করে দেয়। সেই বেডে মোরগঝুঁটির বীজ ছড়ায় কাঁকন। ছুটির দিনে লাল টুকটুকে লেপগুলোকে ছাদ থেকে রোদ্দুর খাইয়ে আনে সুবীর। বড় তোশকটাকেও অবলীলায় কাঁধে করে ওঠানো নামানো করে। তার পর সেই তোশকের ওপর টান টান করে সুজনি পাতে কাঁকন। লেপে ফুল ফুল ওয়াড় পরায়।
কেমন করে প্রায় অচেনা লোকটাকে বোঝায় কাঁকন যে, উনি যা কিছু দেখছেন সেই সব কিছুর গায়েই একটি পুরুষ আর একটি নারীর হাতের ছোঁয়া লেগে আছে। ওই যে উঠোনে দুটো সুপুরিগাছের গুঁড়িতে টান টান করে দড়ি টাঙিয়ে দিয়েছে সুবীর আর সেই দড়িতে শুকোচ্ছে কাঁকনের শাড়ি— ওই টান টান উঁচু দড়িটাই সুবীর, আর রঙিন কাপড়টা কাঁকন।
এই ভাবে এই বাড়ির ঈশান-অগ্নি-নৈঋত-বায়ু কোণ থেকে দু’হাত বাড়িয়ে সারাক্ষণ সুবীর তার নতুন বউকে জড়িয়ে রেখেছে। তার পরেও স্নানখাওয়ার সময় ঠিক রাখা যায়?
সেই জন্যেই কথা না বাড়িয়ে চুপ করে রইল কাঁকন। অবশ্য উনিও যে কাঁকনের উত্তর শোনার জন্যে খুব আগ্রহ দেখালেন তা নয়। বরং আধ খাওয়া চায়ের কাপ মেঝেতে নামিয়ে রেখে অস্থির পায়ে আর এক বার উঠোন থেকে ঘুরে এলেন। একটু বাদেই ফিরে এলেন স্বস্থানে। আবার হাতে তুলে নিলেন জুড়িয়ে যাওয়া চায়ের কাপ।
সত্যিই ভীষণ অস্থির লাগছিল লোকটাকে, নামটা না জানায় যাকে কাঁকন শুধু কাকাবাবু বলে ডাকছিল। উনি যখন উঠোনে ঘুরছিলেন তখন কাঁকন ভাবছিল, এক বার বলবে নাকি, এর পরের বার যেন কাকিমাকে নিয়ে আসেন? তা ছাড়া এই বার ওঁর নামটাও তো জিজ্ঞেস করা দরকার। না হলে সুবীর অফিস থেকে ফিরলে কেমন করে তাকে বলবে কে এসেছিল?
কিন্তু কাঁকন কিছু বলার আগে হঠাৎ সেই নাম না জানা লোকটাই বলে উঠল, আমাদের বাড়িতে একটা চেয়ার আছে, বুঝলে। কাঠের হাতলওলা চেয়ার। রুমি, সুমি, মানে আমার মেয়ে দুটো চেয়ারটার নাম দিয়েছিল ‘সুবীরদার সিংহাসন’।
কাঁকন কথাটা বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে ভদ্রলোকের মুখের দিকে চেয়ে রইল।
বুঝলে না? সুবীর তো খুব যেত আমাদের বাড়িতে। রোজই প্রায় যেত। শান্ত ছেলে তো চিরকালই। মুখে কিছু বলত না, নড়াচড়াও বিশেষ করত না। চুপ করে ওই চেয়ারটায় বসে থাকত। রুমি-সুমিরা নানান কাজের মধ্যে এক বার করে এসে হয়তো একটু কথা বলে যেত। তোমার কাকিমা ওকে খুব ভালবাসত। যখন ঘরে যা খাবার থাকত এনে দিত। চুপ করে খেয়ে নিত। তার পর কখন যে এক সময়ে উঠে নিজের কাজে চলে যেত আমি অত খেয়াল করতে পারতাম না। কিন্তু রুমি-সুমি দেখতাম ঘরের মধ্যে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বিশেষ করে সুমিটা, ওর তো তখন ছ্যাবলামিরই বয়েস। বলত, দিদি তোর প্রেমিক এসেছে। একটু দৃষ্টিপ্রসাদ দিয়ে ধন্য করে আয়। রুমি ওকে মারতে তাড়া করত।
সুমিই চেয়ারটার ওই নাম দিয়েছিল— সুবীরদার সিংহাসন। চার দিকে দামি দামি সোফাসেটের মধ্যে এখনও চেয়ারটা রয়েছে। কেউ বসে না ওটায়, তবু রয়েছে।
কাঁকনের হঠাৎ মনে হল রোদ্দুরটা বড্ড কড়া। তার কান-কপাল জ্বালা করছিল। আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে সে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সামনের ওই সুন্দর প্রৌঢ় মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল।
তিনি বলে চললেন, সেই ছেলেই যে কোনও দিন এতটা সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারবে, ভাবতে পারিনি। দু’বছর আগে যখন রুমির বিয়ের তোড়জোড় করছি, তখন এক দিন আমার কাছে এসে বলল, ও রুমিকে বিয়ে করতে চায়। মানছি ভাল ছেলে, ভদ্র, পরিশ্রমী। তখন চাকরিটাও পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একটা পালটি ঘরের ব্যাপার আছে না? না করে দিলাম। খারাপ ভাবে কিছু বলিনি। বুঝিয়েই বলেছিলাম সব কিছু।
রুমিকে কিছু জিজ্ঞেস করার কথা তখন মাথায়ই আসেনি। যে ছেলেটাকে নিয়ে দু’বোন সারাক্ষণ হাসিঠাট্টা করে তার সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে যে ওর কিছু অন্য মত থাকতে পারে, কেমন করে ভাবব? তোমার কাকিমা মিনমিন করে কী যেন বলতে এসেছিল। ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছিলাম।
তার ক’দিন পরেই সোনারপুর ছেড়ে এই কানাইপুরে চলে এল সুবীর। আর তারও ক’দিন পরে, মানে এই বছর দেড়েক আগে, রুমির বিয়ে হয়ে গেল। হাওড়ার এক বনেদি বংশের ছেলে। ছেলে নিজে উকিল। পসার-টসার ভালই ছিল।
বিয়ের পর বাপের বাড়ি ছেড়ে আসার সময় রুমি প্রচণ্ড কেঁদেছিল। ওই সময়ে সব মেয়েই কাঁদে। কিন্তু ওকে ও রকম আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে কাঁদতে দেখে আমি কী রকম যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। রুমির মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটা অত কাঁদছে কেন? তা সে নিজের চোখ মুছে বলল, ওই একটা কান্নার মধ্যে মেয়েদের কতগুলো কান্না লুকিয়ে থাকে জানো?
রুমির বিয়েটা সুখের হল না, বুঝলে। ওকে শ্বশুরবাড়িতে মারধর করত, আমরা ফোন করলে মেয়েকে ফোন ধরতে দিত না। ছেলেটার নাকি আর একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে।
তবু এত তাড়াতাড়ি যে রুমি হাল ছেড়ে দেবে, ভাবতে পারিনি। কিছু করারই সময় দিল না আমাকে। এ রকম কেউ করে, বলো তো?
ভদ্রলোক উদাস চোখে সুপুরি গাছের মাথার দিকে চেয়ে বসে রইলেন। সেখানে তখনও বাবুই পাখিদের আসা-যাওয়ায় ক্ষান্তি নেই।
কী... কী করেছে আপনার মেয়ে? কাঁপা কাঁপা গলায় কাঁকন জিজ্ঞেস করল।
ওর শ্বশুরবাড়ির লোক জন তো বলছে অ্যাকসিডেন্ট। পিছন দিক থেকে আঁচলে নাকি আগুন ধরে গিয়েছিল। কিন্তু আমি তো গিয়ে দেখলাম সামনের দিকটা পুড়েছে। চোখের পাতা, ঠোঁট, বুক কিচ্ছু নেই। সব গলে বেরিয়ে গিয়েছে। রুমি তো আর কিছু বলবে না। আমি জানি ওর আর জ্ঞান ফিরবে না। হয়তো আজ বিকেলের মধ্যেই...। কিন্তু আমি শিয়োর বুঝলে, ও সুইসাইড করতেই চেয়েছিল।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে মাথাটা কেমন যেন হয়ে গেল। ভাবলাম নিজের শ্বশুরবাড়িটা তো আমার মেয়ের সইল না। অন্য আর একটা সংসার যে ওর পাওনা ছিল। যেটাতে আমি ওকে যেতে দিইনি। মনে হল এক বার দেখে আসি তো, সেখানে গেলে আমার মেয়েটা কেমন থাকত। তাই হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে চলে এলাম।
আবার কিছুক্ষণ কাঁচাপাকা চুলগুলো খামচে ধরে থাকলেন। বললেন, জানি না এ সব কথা তোমাকে বলাটা ঠিক হচ্ছে কি না। আসলে আমার মাথার ঠিক নেই। রুমির যখন বছর পাঁচেক বয়েস, এক বার জ্বলন্ত ফুলঝুরির টুকরোয় পা দিয়ে ফেলেছিল। তার পর তিন দিন মেয়ে মাটিতে পা ঠেকায়নি, এত জ্বালা করছিল পায়ের পাতায়। আমি তিন দিন ওকে কোলে নিয়ে ঘুরেছিলাম। আর সেই মেয়ে আজ সেভেনটি পার্সেন্ট বার্ন ইনজুরি নিয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে। মাথার ঠিক থাকে, বলো?
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। ওঁর নামটা জানা হল না। কাঁকন বুঝতে পারে আর জানাও হবে না, কারণ, ওর নিজেরই এই মুহূর্তে আর কোনও প্রশ্ন করার মতন ক্ষমতা অবশিষ্ট নেই।
সদর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভদ্রলোক হঠাৎই এক বার দাঁড়িয়ে পড়লেন। তৃষ্ণার্তের মতন চারিদিকে তাকালেন। কাঁকনের মনে হল উনি গাঁদার কেয়ারি, টিয়ার খাঁচা, সুপুরির সারি, সোনার বরণ কাঁসার গ্লাস প্রত্যেকটা জিনিসকে মনের মধ্যে তুলে নিচ্ছেন। নিতে নিতে নিজের মনেই বললেন, ভুল হয়ে গিয়েছে। মাথাটা এক বার ঝাঁকালেন। আবারও বললেন, বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। তার পর এলোমেলো পায়ে দরজা পেরিয়ে চলে গেলেন।
কাঁকন থামের গায়ে শরীরের ওজন ছেড়ে দিয়ে দেখল তার সেই চলে যাওয়া।
সুবীর যখন সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরল তখনও কাঁকন সেই থামটাতেই হেলান দিয়ে বসে আছে। সারা বাড়িতে কোথাও আলো জ্বলেনি। অবাক সুবীর নিচু হয়ে কাঁকনের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল। জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে কাঁকন?
চোখের জল ততক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছিল। কাঁকন মুখ তুলে বলল, এ আমি কার ঘর করছি গো?

ছবি: সুমন চৌধুরী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.