নিউ টাউনে জমি অধিগ্রহণের সময় যে সব চাষি ক্ষতিপূরণের চেক নেননি, তাঁদের অতিরিক্ত এককালীন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। গত মাসে হিডকোর বৈঠকে এই নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই মতো সংশ্লিষ্ট পাঁচ গ্রাম পঞ্চায়েতকে নির্দেশও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জমি অধিগ্রহণ সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁদের মতে, রাজ্য সরকারের এই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত অভূতপূর্ব। আইনে সুযোগ থাকলেও আগে কখনও এ ভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে কি না সন্দেহ। তবে এর ফলে কিছু অসন্তোষও দেখা দিয়েছে। যে দলে তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধানও রয়েছেন।
কলকাতার উপকণ্ঠে, দুই ২৪ পরগনার কিছু এলাকা নিয়ে রাজারহাটের নতুন উপনগরী তৈরি হচ্ছে। বাম আমলে, প্রায় দেড় দশক আগে থেকে সেখানে জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হয়। সরকারি তথ্য বলছে, গত প্রায় ১৫ বছরে উত্তর ২৪ পরগনায় ৬ হাজার ১০০ একর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৭০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে উত্তরে অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় সাত বছর আগে। দক্ষিণের অংশে অধিগ্রহণ তুলনায় নতুন, গত কয়েক বছরের ঘটনা। ক্ষমতায় আসার পরে মমতা অবশ্য জানিয়ে দেন, নিউ টাউন প্রকল্পের জন্য আর কোনও জমি অধিগ্রহণ করা হবে না। |
সিঙ্গুরের মতো নিউ টাউনেও জোর করে জমি অধিগ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। বিশেষত, উত্তরের জ্যাংড়া-হাতিয়ারা ২ নম্বর, পাথরঘাটা, রাজারহাট-বিষ্ণুপুর ১ এবং ২ নম্বর, মহিষবাথান ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় জোর করে জমি নেওয়ার অভিযোগ বেশি। এই সব অভিযোগের তদন্ত করতে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এর পাশাপাশি, অনিচ্ছুকদের অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছে হিডকো। গত ১০ অগস্ট হিডকোর বোর্ডের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, উত্তর ২৪ পরগনার ওই পাঁচ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় যে সব জমির মালিক চেক নেননি বা নিতে পারেননি, তাঁদের এককালীন অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
কী সেই ক্ষতিপূরণ? হিডকো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাঁরা চেক নেননি, তাঁরা অধিগৃহীত জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ যে দাম ধার্য হয়েছে, সেই টাকা তো পাবেনই, সঙ্গে সুদ বাবদ পাবেন তার সমপরিমাণ অর্থ। অর্থাৎ, কোনও জমির দাম যদি ১০০ টাকা থাকে, তা হলে তাঁরা সেই ১০০ টাকা তো বটেই, সঙ্গে পাবেন সুদ বাবদ আরও ১০০ টাকা। এর সঙ্গে তাঁদের কাঠাপ্রতি ২৯ হাজার টাকা দেওয়া হবে। তার মানে, যে জমির দাম ১০০ টাকা ঠিক হয়েছিল, তার জন্য এখন ২৯ হাজার ২০০ টাকা পাওয়া যাবে।
সরকারের এক মুখপাত্র জানান, উত্তর ২৪ পরগনায় অধিগ্রহণের কাজ প্রায় সাত বছর আগে শেষ হয়েছে। হিসেব করে দেখা গিয়েছে, সাত-আট বছর আগে অধিগৃহীত কোনও জমির টাকা ব্যাঙ্কে রাখলে সুদ বাবদ সমপরিমাণ অর্থই পাওয়া যেত। অর্থাৎ, এই সময়ে টাকা দ্বিগুণ হয়ে যেত। সেই ভিত্তিতেই ক্ষতিপূরণের অঙ্ক ঠিক করা হয়েছে। এর সঙ্গে কাঠাপ্রতি আরও ২৯ হাজার টাকা কেন দেওয়া হচ্ছে? কারণ নতুন সরকার মনে করে, অধিগ্রহণের সময় জমির দাম কম দেওয়া হয়েছে। তাই কাঠাপ্রতি এই বাড়তি ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উত্তর অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ পেলে দক্ষিণের ‘অনিচ্ছুক’-রা কেন পাবেন না? ওই মুখপাত্র বলেন, “দক্ষিণের জমি অধিগ্রহণ হয়েছে প্রায় হাল আমলে। সেখানে জমির দামে কোনও অসঙ্গতি নেই বলে মনে করে হিডকো।” তাই সেখানে কাঠাপ্রতি বাড়তি টাকা দেওয়ারও প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন তাঁরা।
এই ক্ষতিপূরণের সিদ্ধান্তে কিছু ক্ষেত্রে কিন্তু অসন্তোষও দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে শাসকদল তৃণমূলের একাংশেই। তার মধ্যে আছেন রাজারহাট-বিষ্ণুপুর ২ পঞ্চায়েতের প্রধান মান্নান গাজিও। যে পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েতে এই ক্ষতিপূরণের নির্দেশ পাঠানো হয়েছে, রাজারহাট-বিষ্ণুপুর ২ তার অন্যতম। মান্নান গাজি বলেন, “আমারও দুই বিঘা জমি তখন জোর করে নেওয়া হয়েছিল। আমি চেক নিয়েছি।” তাঁর বক্তব্য, “আইন তো সকলের জন্য সমান। যাঁরা চেক নেননি, তাঁদের অতিরিক্ত টাকা দেওয়া হলে যাঁরা চেক নিয়েছেন, তাঁদেরও দেওয়া উচিত। অন্তত কিছু তো দেবে সরকার। না দিলে অনেকে মামলা করবে।” মান্নানের মতো বাকি পঞ্চায়েত প্রধানরা অবশ্য এত চড়া সুরে প্রতিক্রিয়া জানাননি। পাথরঘাটার প্রধান অশোক নস্কর, রাজারহাট-বিষ্ণুপুর ১ নম্বরের প্রধান জলি দাস কিংবা মহিষবাথান ২-এর প্রধান সন্ধ্যা প্রামাণিকের কথায়, “সরকার ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” একই সঙ্গে তাঁদের আশঙ্কা, “চেক-প্রাপকদের কেউ কেউ বাড়তি টাকার কথা বলছেন। ভবিষ্যতে কী হবে জানি না। তবে এখনও সংগঠিত ক্ষোভ দেখিনি।” এমন আশঙ্কা প্রশাসনের একটি অংশও উড়িয়ে দিচ্ছে না।
নিউ টাউনে ‘অনিচ্ছুক’-দের একাংশ আবার বলছেন, সিঙ্গুরে যেখানে জমি ফেরত দিতে আইন করেছে সরকার (যে আইন নিয়ে মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে), সেখানে রাজারহাট-নিউ টাউনে কেন সেই ব্যবস্থা হবে না? তা হলে যাঁরা চেক নেননি, তাঁদের কাছে জমি ফেরত পাওয়ার বিকল্পটিও থাকত। বিশেষ করে ভোটের আগে যেখানে অনেক নেতাই রাজারহাটে এসে এই বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তৃণমূলের তরফে অবশ্য বলা হয়েছে, সিঙ্গুরে জমি ফেরত দেওয়ার বিষয়টি দলের নীতিগত সিদ্ধান্ত। রাজারহাট-নিউ টাউনের ক্ষেত্রে এমন কোনও সিদ্ধান্ত দলীয় নেতৃত্ব নেননি। তাই জমি ফেরত দেওয়ার প্রশ্নও নেই।
সিঙ্গুরের সঙ্গে একটি জায়গায় কিন্তু নিউ টাউনের মিল। দুই জায়গাতেই যাঁরা চেক নেননি, তাঁদের মধ্যে তিনটি ভাগ রয়েছে। শরিকি বিবাদ, মিউটেশন সমস্যায় এবং প্রকৃত অনিচ্ছুক। সব মিলিয়ে উত্তরে প্রায় ১৫% জমির মালিক চেক নেননি। অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ এঁদের জন্যই। এই ক্ষতিপূরণ দিতে হিডকোর খরচ হবে প্রায় ৩০০ কোটি। হিডকোর চেয়ারম্যান তথা ম্যানেজিং ডিরেক্টর দেবাশিস সেন অবশ্য বলেছেন, “বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক কথাবার্তা হয়েছে। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।” যদিও ক্ষতিপূরণের নতুন প্যাকেজ ওই পাঁচ পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ পঞ্চায়েত অফিসের নোটিস বোর্ডে তা টাঙিয়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। |