নতুন ‘ম্যাডাম’ ঢুকতেই ছাত্রীরা সবাই উঠে দাঁড়াল। জলচৌকির ওপর বসানো টেবিলে রোলকলের খাতা, চক, ডাস্টার রেখে কাছেই রাখা চেয়ারে বসলেন ‘ম্যাডাম’। পরনে লালপাড় সাদা শাড়ি আর ফুলহাতা সাদা জামা। অন্য ছাত্রীরাও যে যার জায়গায় বসে পড়ল। রোলকল শেষ হতে শুরু হল পঠন-পাঠন। চক, ডাস্টার হাতে কোনক্রমে পা উঁচু করে ব্ল্যাকবোর্ডে ত্রিভুজ আঁকলেন ‘ম্যাডাম’ সরিতা খাতুন। পরে কখনো ওই চেয়ারে বসে আবার কখনও গোটা ক্লাসঘর ইতিউতি ঘুরে ছাত্রীদের কাছে তুলে ধরলেন ত্রিভুজের সংজ্ঞা থেকে শ্রেণিভেদের মত নানা বিষয়। এতেই শেষ নয় বেঞ্চে বসে থাকা পড়ুয়াদের কাছে জানতে চাইলেন প্রশ্নের উত্তর। ক্লাসঘরে অন্য পড়ুয়াদের সঙ্গে বেঞ্চে বসে থাকা শিক্ষিকা দেয়ালি রায়, পামোলি মজুমদার, শিক্ষক প্রশান্ত মণ্ডলেরাও অনেকটা বাধ্য পড়ুয়ার মত নতুন ‘ম্যাডাম’এর প্রশ্ন সামলানেন। তাঁদের কেউ গুড, আবার কেউ ভেরি গুড সূচক প্রশংসাও পেলেন। অনেককে আরও মনোযোগী হওয়ার পরামর্শও দিলেন নতুন ‘ম্যাডাম সরিতা’। ষষ্ঠ শ্রেণির ওই ক্লাসঘরে যখন যখন ‘ম্যাডাম’ জ্যামিতি বোঝাতে ব্যস্ত, তখন অস্টম শ্রেণিতে ইংরেজি পড়াচ্ছিলেন আর একজন নতুন ‘স্যার’। পাজামা, পাঞ্জাবি পোশাকের নতুন ‘স্যার’ আনোয়ার হোসেন তখন ‘ইংরেজি গ্রামার’ বোঝাচ্ছিলেন। |
কাজের ফাঁকে স্কুলের পরিবেশ কেমন চলছে তা ঘুরে দেখতে গিয়ে যা দেখে তৃপ্তির ছবি ধরা পড়ল ওই স্কুলের ‘একদিনের হেডস্যারের চোখেমুখেও। নতুন হেডস্যার রসিদুল মিঁয়া ছুটলেন পাশের ক্লাসঘরে। দরজার আড়ালে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যিনি এগোলেন অন্য ক্লাসঘরের সামনে। দিনহাটার জোরপাকুড়ী হাইস্কুল তখন নিঝুম। যেন পিন পড়লেও শোনা যাবে। ওই নতুন শিক্ষক-শিক্ষিকারা আসলে সকলেই জোরপাকুড়ী হাইস্কুলেরই ছাত্র-ছাত্রী। ষষ্ঠ শ্রেণির সরিতা নিজের সহপাঠীদের অঙ্ক ক্লাস নিয়েছে। নবম শ্রেণীর আনোয়ার পড়িয়েছেন অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি। একই ভাবে দশম শ্রেণীর ছাত্র ‘হেডস্যার’ রসিদুল মিঁয়ার রুটিন মেনে দিনভর স্কুলের পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির ইতিহাস, ভূগোল, জীবন বিজ্ঞান, ভৌতবিজ্ঞানের মত অন্যান্য বিষয়ের ক্লাস নেন ওই স্কুলের আরও ২৮ জন ছাত্র-ছাত্রী। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে বেঞ্চে বসে যাদের ক্লাস করলেন অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা। টিচার্স ডে উদযাপন উপলক্ষে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ওই উলোটপুরাণের সাক্ষী থাকল গোটা জোরপাকুড়ী হাইস্কুলের। ওই স্কুলের প্রধানশিক্ষক কৌশিক সরকার বলেন, “একটু অন্যরকম ভাবে শিক্ষক দিবস উদযাপন করার ভাবনা থেকেই এবার ওই পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তা ছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতিনিধি আজকের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষকতায় উদ্বুদ্ধ করার তাগিদ তো রয়েইছে। এতে সকলেই বাড়তি পড়াশোনা যেমন করেছে, তেমনি ওরা ভবিষ্যতে ভাল শিক্ষক হওয়ার সেই আত্মবিশ্বাসটাও পেয়েছে।” স্কুল সূত্রেই জানা গিয়েছে, শিক্ষক দিবস উদযাপন উপলক্ষে দুই দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন জোরপাকুড়ি স্কুল কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষক-শিক্ষিকার ভূমিকায় ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি বুধবার ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান সূচি চূড়ান্ত হয়েছে। যা শুনে কোচবিহারের ডিআই (সেকেন্ডারি) মহাদেব শৈব বলেন, “ছাত্র-ছাত্রীদের সুনাগরিক করে তোলা প্রতিটি স্কুলের দায়িত্ব। আর ওই ব্যাপারে এমন পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।” সর্বশিক্ষা মিশনের কোচবিহার জেলা আধিকারিক আমিনুল আহসান বলেন, “রাজতন্ত্রে রাজা-প্রজার ব্যবধান থাকে। গণতন্ত্রে সবাইকে এক আসনে নেমে আসতে হয়। সেদিক থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ছাত্রের আসনে নেমে আসাটা দারুণ ব্যাপার। আর সব থেকে বড় কথা একবার শেখাতে হলে দ্বিগুণ শেখা যায়। |