এ যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা।
এ বছর যখন পুজো সংগঠকেরা নাওয়া-খাওয়া ভুলে থিম ভাবনায় মশগুল, তখন চিন্তা নেই একটি জায়গাতেই।
দু’বছর আগে সেই পুজোর ফুটপাথ ধরে হেঁটে যান ‘অন্তঃসত্ত্বা’ বিদ্যা বালন। কয়েক হাজার মানুষের ভিড়েই তাঁকে চোখে চোখে রেখে, প্রায় সকলের অলক্ষে ছিল সুজয় ঘোষের ক্যামেরা।
সেটা অষ্টমীর সকাল। শ্যুটিং সেরে দুপুরে বিদ্যা, সুজয় এবং ইউনিটের বাকিরা চলে আসেন মণ্ডপে। সংগঠকদের আমন্ত্রণে। সেখানে তখন চলছে পুজোর ভোগ খাওয়া। বিদ্যাকে প্লেট-চামচে খিচুড়ি দেওয়া হল। কিন্তু রাজি হলেন না ‘বিদ্যা বাগচী’। আব্দার করে অন্যদের মতো শালপাতায় ভোগ নিয়ে হাতে করেই খেলেন।
এ সব স্মৃতিই ভাবনা জুগিয়ে দিয়েছে। এমনই টুকরো ছবি নিয়ে তৈরি হচ্ছে ওই পুজোর এ বারের থিম। যা হয়ে উঠেছে বিপণনের প্রধান হাতিয়ারও। মণ্ডপে ঢুকতে গেলে তাই এ বার চোখে পড়বে এই টুকরো ছবির প্যানেল। টিভিতে চলবে দু’-আড়াই মিনিটের চলচ্চিত্র, যা তৈরি হচ্ছে সুজয় ঘোষের জনপ্রিয় সিনেমাটি থেকে পুজোর দৃশ্য ছেঁচে। তাই এখনই লেক ভিউ রোডে হাজির ওঁদের হোর্ডিং: ‘কহানির সিনেমাস্কোপ থেকে রাজস্থানের গ্রামীণ পটভূমি’। কলকাতার সর্বজনীন পুজোয় এমন বিপণন বা প্রচারের সুযোগ এই প্রথম। ‘কহানি’র আকাশছোঁয়া সাফল্য যে সুযোগ এনে দিয়েছে বালিগঞ্জ কালচারালের সামনে।
“ওদের ওখানে যেতাম ঢাক শুনতে। বাগবাজার, শোভাবাজার যেতে হচ্ছে না, ঘরের পাশে এত ভাল পুজো! উপভোগ করতাম সেটা,” বলছিলেন পরিচালক অনীক দত্ত। জানালেন, আজকাল খোলা বাজার অর্থনীতির জন্য যে ভাবে সব কিছুতে ব্র্যান্ড ব্যাপারটা এসে যাচ্ছে, সেটা তাঁর খুব পছন্দের নয়। কিন্তু এটাও মানলেন, “পুজো বিপণন ক্ষেত্রটিতে এখনও অনেক সম্ভাবনা আছে।” |
বিপণনের দিকটি নিয়ে অনেক দিন ধরে ভাবনাচিন্তা করছেন সুরুচি সঙ্ঘের অরূপ বিশ্বাস। রাজ্যের আবাসনমন্ত্রী অরূপবাবু বলেন, “নতুন সম্ভাবনা খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরাই পথ প্রদর্শক। গত বছর পুজোর থিম সং আনি। গানে সুর দিয়েছিলেন টলিউডের জনপ্রিয় সুরকার জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।”
চার বছর আগে বিপণনের আর একটি দিক খুলে দেয় শিবমন্দির। ২০০৮ সালে তাদের পুরো পুজোটাই স্পনসর করেছিল একটি শিল্পসংস্থা। পুজোর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় তাদের স্লোগান, ‘দুগ্গা দুগ্গা’। পুজোর অন্যতম কর্তা পার্থ ঘোষ বলেন, “সিনেমার শ্যুটিং ও তার মাধ্যমে প্রচারের সুযোগ পেয়েছিলাম ১৯৯৯-২০০০ সালে। কিন্তু এতই ঝক্কি পোহাতে হত যে, শেষটায় রাজি হইনি।”
গত এক যুগে অনেক কিছু বদলেছে, মানছেন পার্থবাবু। বলছেন, “একটা নতুন দরজা খুলে দিল ‘কহানি’।” অনীক আবার সেই প্রসঙ্গে তুলেছেন কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতার কথা। যেমন আগে গ্রামের পুজোর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জমিদারেরা। অনীকের মতে, সেখানে একটা ভালবাসা ছিল। এখানে যদি পুরো ব্যাপারটা শুধু ফায়দা তোলায় দাঁড়ায়, তবে সমস্যা। কারণ, যে কর্পোরেটই স্পনসর হিসেবে আসুক, তারা দেখবে তাদের ব্র্যান্ডের প্রচার কী ভাবে হবে।
এই লেনদেন আছে সিনেমাতেও। সিনেমায় কোনও ব্র্যান্ডকে দেখালে তার প্রচারের জায়গা তৈরি হয়। ‘কহানি’তে পুজো নিয়েছে ব্র্যান্ডের জায়গা। অনেকেই বলছেন, ‘কহানি’ সফল বলেই তা ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে লেক ভিউ রোডের এই পুজো।
মুদ্রার উল্টো পিঠে বাগবাজার সর্বজনীন। যেখানে বছর সাতাশ আগে শু্টিং করতে আসেন মৃণাল সেন। “ফরাসি অনুদানে কলকাতা নিয়ে তথ্যচিত্রে শহরকে চেনাতে তিনটি জিনিস বেছে নিয়েছিলেন তিনি হরতাল, বর্ষায় জল জমা এবং দুর্গাপুজো। এবং দুর্গাপুজো বলতে বেছে নেন বাগবাজারকে,” বলছিলেন পুজোটির অন্যতম কর্তা অভয় ভট্টাচার্য। বনেদিয়ানার এই পুজোর একটাই ‘থিম’, ঐতিহ্য। পুজোয় যে মেলা বসে দীর্ঘদিন ধরে, তাতে জিলিপি-তেলেভাজার গন্ধ ধরে রাখতে, পুরনো নাগরদোলা চালু রাখতে প্রয়োজনে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে চাওয়া স্পনসরের সঙ্গেও দর কষাকষি করতে ছাড়েন না তাঁরা। তাই সিনেমার হাত ধরে জনপ্রিয় হওয়ার কথা ভাবেনও না। অনায়াসে বলেন, “এমন প্রচারের প্রয়োজন নেই আমাদের।”
কিন্তু সকলেই তো আর শতায়ু হওয়া থেকে মাত্র ছ’কদম দূরে থাকা বাগবাজার নয়। সেই সব পুজোর জন্য ‘কহানি’ যে নতুন ধারা নিয়ে এল, সন্দেহ নেই। অনীক একে আর পাঁচটা ব্র্যান্ডের মতোই ধরে নিয়েছেন। তবে একই সঙ্গে সাবধান করছেন, “প্রযোজক বললে পরিচালক চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে কয়েকটি দৃশ্যে ব্র্যান্ড ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু জোর করে ঢোকাতে গেলে তা যেমন সিনেমার পক্ষে খারাপ, সেই ব্র্যান্ডের জন্যও ভাল নয়। সব ক্ষেত্রেই ভারসাম্য দরকার।”
সাবধানবাণী যা-ই হোক, ‘কহানি’ কিন্তু পুজো ব্র্যান্ডটিকে উজ্জ্বল করেছে। পথ খুলেছে নতুন বিপণনের। মনে পড়ে সিনেমার ক্লাইম্যাক্স? সিঁদুরখেলার মধ্যে হাঁটছেন বিদ্যা। সঙ্গে টুকরো টুকরো ছবিতে বিসর্জনের জন্য প্রতিমা নামানোর ঘটনা। নবমী আর দশমী মিলিয়ে তোলা সেই দৃশ্যে প্রতিমার ছবি দর্শক বহুদিন মনে রাখবেন। আর সেটাই এ বার বালিগঞ্জ কালচারালের ইউএসপি। দেশজোড়া প্রচারের এমন সুযোগ পেলে অন্য পুজোই বা নেবে না কেন?
|