কিন্তু মুশকিল হল, তিনি যাঁকে ভালবাসেন তিনি তো তেমন গৌরী নন, গৌরীরানি গাঙ্গুলি। ল্যান্সডাউন রোডের বিখ্যাত বড়লোক চণ্ডীচরণ গাঙ্গুলির মেয়ে। তাঁর পক্ষে প্রায় আকাশের চাঁদের মতো সেই মেয়ে। আর সেই মেয়ের কথা ভেবে উত্তম লিখছেন, ‘নাঃ, দিন আমার কাটবে না। মেয়েটাই আমাকে পাগল করবে। কেবলই তার চিন্তা। অফিসে যাই, কাজ করতে করতে কেবল মনে পড়ে সেই মুখখানা। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দরজার কাছে বসে থাকি, যদি সে অন্নপূর্ণার সঙ্গে দেখা করতে আসে তাহলে আর কিছু না হোক একবার দেখতে তো পাব!’
অন্নপূর্ণা উত্তমের জেঠতুতো বোন, গৌরীর গানের স্কুলের বন্ধু। কিন্তু ওইটুকুই সূত্র, বাকিটা ধু ধু মরুর মতো দূরত্ব। বিশাল বাড়ি, লোহার গেট, দরোয়ান... এবং আশায় আশায় বসে থাকতে থাকতে উত্তমের ‘হঠাৎ মনে হল, আমারই মত অন্য কোন বড়লোকের ছেলে, নতুন একটা অস্টিন বা মরিস বা ঐ ধরনের কোন গাড়িতে তাকে বসিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে না তো?’
পাগল তাঁকে অবশ্য করেছিল আর একটা আশাও। অভিনয়। সিনেমায় অভিনয়। কিন্তু সেখানেও, প্রথম জীবনে পদে পদে ঠোক্কর খেয়েছেন তিনি। আশা কেবলই হতে বসেছে দুরাশা। ‘নবকল্লোল’-এ প্রথম প্রকাশিত দুষ্প্রাপ্য সেই আত্মজীবনীতে লিখছেন, ‘গৌরীকে পাবার আকাঙ্ক্ষা আমার পক্ষে দুরাশা। কারণ, সে বড়লোকের মেয়ে। অপর দিকে রূপালী আলোর খেলা। সেখানেও আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ। স্টুডিওর দরজায় দরজায় ঘুরেছি। পরিচালক প্রযোজকদের সঙ্গে দেখা হওয়া তো দূরের কথা, স্টুডিওর গেটই পার হতে পারিনি। ছবিতে নামবার আশা আমার কেবল স্বপ্নই থেকে যায়, বাস্তবে রূপ নেয় না। অথচ অফিসও করতে ভাল লাগে না।’
স্বাধীনতা, দেশভাগ বদলে যেতে থাকা একটা শহরের নিদারুণ হতাশ, ব্যর্থ এক যুবক অরুণকুমার অফিসের পরে বসে থাকেন গড়ের মাঠে। বিকেলের কলকাতার আকাশে স্বপ্নের রঙিন পাগলা ঘোড়াগুলো তখন আর ছোটে না। কিন্তু ভরসা দিলেন, নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখালেন গঙ্গাসাগরফেরত এক সন্ন্যাসী। মাসিক দুশো পঁচাত্তর টাকা মাইনের কেরানি অরুণকুমারের সেই স্বপ্ন দেখার কথা লিখছেন সফল নায়ক,
‘হঠাৎ আমার কাছে কে যেন বলল বাবুজি, কুছ দিজিয়ে। চমকে উঠলাম। মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, এক গেরুয়া বসনধারী সন্ন্যাসী! অত ঠাণ্ডায়ও গায়ে কিছু নেই। গায়ে ছাই মাখা। মাথা কামানো।... চোখের চাহনি অদ্ভুত। আমার চোখের ওপর চোখ পড়ায় যেন মনে হলো, আমার সমস্ত মনটাকে সে দেখতে পাচ্ছে।... বললাম কিছু হবে না বাবা, সরে পড়। হবে না, হবে না মানে কি? আবার চমকে উঠলাম, সন্ন্যাসীর এ পরিষ্কার বাংলা শুনে। তবে কি লোকটা বাঙালী!... এক্ষেত্রে সন্ন্যাসী আমার কাছে প্রার্থী। আর আমি ইচ্ছে করলে দুটো বা চারটে পয়সা দিয়ে দাতার আসনে বসতে পারি। সুতরাং আমার অবস্থা ওর চেয়ে সবল। তাই একটু গলা ঝেড়ে বললাম বেশ চেহারাটা তো দেখছি তোমার, খেটে খেতে পার না? আমার কথা শুনে সন্ন্যাসী হেসে উঠলেন। তার পরে বললেন খেটে খাব না বলেই মা-বাপের কাছ থেকে পালিয়েছি। তবে খাটব কেন?...বললাম কিছু তো বুঝতে পারলাম না! সন্ন্যাসী বললেন আরে এটুকু সোজা কথা বুঝলে না? কয়েকদিন ঘুরেই তুমি হতাশ হয়ে পড়লে? মা বাবা বাড়ি ঘরদোর ছেড়ে এই ঠাণ্ডাতেই বা বসে আছ কেন? তুমি বলবে, ‘আমি ভাবছি কি করে আমার উদ্দেশ্য সফল হয় সেই কথা।’ আর আমরা কি করছি জান? সব কিছু ছেড়েছি, কেবল তাঁকে পাবার জন্যে।’ উত্তমকুমার লিখছেন, ‘পরীক্ষা করার জন্য তাঁকে বলি, আচ্ছা আমি কী ভাবছি বলুন তো?... সে তো এখুনি বলে দেওয়া যায়। তুমি ভাবছ সেই মেয়েটির কথা, আর ভাবছ কী করে ফিল্মে অভিনয় করা যায়।’
কিন্তু, ভরসা থাকুক সাধুসন্তে, নায়ক হওয়ার পথটা খুব সহজ হয়নি উত্তমের পক্ষে। পরিচিত দাদা গণেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগাযোগে হিন্দি ছবি ‘মায়াডোর’-এ অভিনয়ের ডাক এসেছিল বটে, কিন্তু সেখানে তাঁর কাজ বিয়ের আসরে স্রেফ বর সেজে বসে থাকা। তবু, সিনেমায় নামা তো বটে। উত্তম লিখছেন, ‘এতবড় খবরটা আমি চেপে রাখবো কি করে? সারা বাস বাদুড়-ঝোলা হয়ে গিয়েও খুঁজতে লাগলাম যদি কোন চেনা লোক চোখে পড়ে। অন্ততঃ তাকে বলেও খানিকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যেতে পারে।’
যথারীতি অফিসে পৌঁছে রাষ্ট্র করলেন খবরটি। ফল হল মিশ্র, প্রশংসা, ব্যঙ্গ, বিদ্রূপও সে কালে ফিল্মে নামা মানে তো গোল্লায় যাওয়া। বাড়িতে মাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে, অনেক বাধা পার হয়ে শেষে স্টুডিওর দরজায় পৌঁছলেন অরুণকুমার... ‘বর সেজে ক্যামেরার সামনে বসলাম। ফটাস্ করে ক্ল্যাপস্টিক টানা হলো। ক্যামেরার হাতল ঘুরতে লাগলো ঘরঘর করে। আমারও বুকের ভেতর করতে লাগলো গুরগুর। শ্যুটিংএর পর সে দিন মনে হয়েছিল, বায়োস্কোপে ছবি তোলা কি শক্ত রে বাবা! থিয়েটার করেছি, যাত্রা করেছি... কিন্তু আজকে এই একটা ছোট্ট সেটের মধ্যে গোটাকতক আলোর সামনে অভিনয় করতে একেবারে ঘেমেনেয়ে গেলুম।’
শুধু অভিনয়ের মঞ্চটাই কঠিন ছিল না, কঠিন ছিলেন মঞ্চের নেপথ্যের মানুষজনও। মনে পড়বে ‘নায়ক’-এর প্রবীণ অভিনেতা মুকুন্দদেব চট্টোপাধ্যায়কে, ঘরভর্তি লোকের সামনে নতুন ছেলে অরিন্দম মুখার্জিকে অপমান করতে যাঁর বাধেনি। নিজের জীবনে অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে উত্তমকুমারকেও। অনেক ব্যর্থতা। নীতিন বসুর ‘দৃষ্টিদান’-এ নায়ক অসিতবরণের ছোটবেলার সামান্য চরিত্র, নব্যেন্দুসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কামনা’-য় নায়ক চূড়ান্ত ফ্লপ, ‘মর্যাদা’ও মুখ থুবড়ে পড়েছে। ১৯৪৭-এ প্রথম ফিল্মে নেমেছিল যে যুবক, পর পর চারটে ছবিতে ‘পাবলিক’ তাকে নেয়নি।
তার পরে ১৯৫০। ইন্দ্রপুরী স্টুডিও। তোলা হচ্ছে রাজেন চৌধুরীর ‘ওরে যাত্রী’। উত্তমকুমার লিখছেন, ‘গেলাম ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে। কারণ ওখানেই আমাদের তখন ‘ওরে যাত্রী’ তোলা হচ্ছে। কিন্তু তখন স্টুডিওর পরিবেশ আজকের মতন ছিল না। একদল লোক সদাসর্বদা সেটের মধ্যেই বসে থাকতেন। তাঁরা না শিল্পী না টেকনিশিয়ান। অথচ তাঁদের সঙ্গে পরিচয় থাকতো সব পরিচালক আর প্রযোজকদের।... নতুন কোন ছেলে বা মেয়েকে স্টুডিওর মধ্যে আসতে দেখলেই তাঁরা তাঁদের সমস্ত শক্তি নিয়ে পরিচালক আর প্রযোজককে বোঝাবার চেষ্টা করতেন, নতুন ছেলে বা মেয়েটার কিছু হবে না।... আমার জীবনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।... করছি এক ডাক্তারের পার্ট। স্টেথিসকোপ গলায় জড়ানো। অপরদিকে আমার রোগিণী সেজেছেন মঞ্চ ও পর্দার বিখ্যাত অভিনেত্রী প্রভা দেবী। প্রথম সীনেই আমি তাঁর নাড়ী পরীক্ষা করব। মুখে আলো ফেলা হলো।... মুখে আলো পড়তেই, সেই অবাঞ্ছিত দলের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলেনরাজেনদা, এ কলির ভীমকে কোথা থেকে পেলেন? পায়ে পাথর বেঁধে না রাখলে ঝড় দিলে উড়ে যাবে যে! কথাটা শাণিত ছুরির মত গিয়ে বিঁধলো আমার মনের ওপর। আর একজন মন্তব্য করলেনএকেবারে নতুন আমদানী হয়েছে যে গাঁ থেকে! একেই নার্ভাসনেস্ আর উত্তেজনায় আমার আগেই হাত পা ঠাণ্ডা হতে আরম্ভ করেছিল, এ ধরনের মন্তব্য শুনে শুরু হল কাঁপুনি।...
‘নাড়ী দেখবার জন্যে প্রভা দেবীর হাত ধরলাম। আমার ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে প্রভা দেবী চোখ তুলে আমার মুখের দিকে চাইলেন। তারপর বললেনএ ছেলে অভিনয় করবে কি! এর তো এখনই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে জমে এসেছে।... ভিড়ের মধ্যে থেকে মন্তব্য হলোচেহারা দেখেই আমাদের মালুম হয়েছে। আগেই বলেছিলুম এর দ্বারা কিস্সু হবে না। আমার দ্বারা হবে না! কথাটা শুনে আমার সারা মন প্রাণ হতাশায় ভরে গেল। কিন্তু কেন হবে না তা তো কেউ কিছু বললেন না।’
তার পর? সেই ১৯৬০-এ ‘নায়ক’ তৈরি হওয়ার অনেক আগে উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, ‘সেই ‘কেন’র জবাব আমায় কেউ দিল না বটে, অথচ ফ্লোর ছেড়ে যাওয়াও আমার চললো না। যাব বলে তো আসিনি।’
‘কেন’র জবাবটা জানত নায়ক-এর অরিন্দম। বন্ধু জ্যোতিকে সে বলেছিল, ‘আমার কাজটা ভাল হয়নি।... গন্ডগোল, বিস্তর গন্ডগোল... আমি ছাড়া কেউ জানে না... অ্যান অ্যাক্টর নোজ, যখন অভিনয় করেছি তখন ফিল করেছি যে কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে।’ গোলমালটা জানতেন, খামতিগুলো জানতেন অরুণকুমার, আর জানতেন বলেই হয়ে উঠতে পেরেছিলেন উত্তমকুমার, বলতে পেরেছিলেন যাব বলে তো আসিনি।
নিজেকে বার বার ঘষেমেজে তৈরি করেছেন তিনি। সমন্বয়ী শিল্প যে অভিনয়, তার পথে অনেক দূর যাবেন বলেই গান শিখেছেন নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে, এমনকী বক্সিংও, ভবানী দাস ওরফে বব দাসের কাছে। তাঁর কলমে, ‘শুধু গলা সাধাই নয়, তখন নিয়ম করে শরীরচর্চাও শুরু করে দিয়েছি। কারণ আমি তখনই বুঝেছিলাম, সিনেমায় ঢুকতে গেলে এ ধরনের ‘ল্যাকপ্যাকে’ চেহারা চলবে না। রীতিমত ডন বৈঠক, এমন কি বক্সিংও শুরু করলাম। তখনকার সময় আমাকে বক্সিং শিখিয়েছিলেন শ্রীভবানী দাস। আজ অবশ্য তাঁর নাম, ববি ডায়াস, বক্সার হিসাবে নয়, ইংরেজী নাচ জানেন বলে তিনি আজ বিখ্যাত। আমার আগামী ছবির জন্য (সপ্তপদী) তাঁরই কাছ থেকে বল ড্যান্স শিক্ষা করছি।’ হয়ে ওঠা অভিনয়ের এই কাহিনি অকপটে নিজের কলমে লিখেছিলেন উত্তমকুমার, অসমাপ্ত, গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত ওই আত্মজীবনীতে।
কিন্তু তাঁর ৮৭তম জন্মদিনের ঠিক আগের দিন পর্যন্ত, তাঁর মৃত্যুর তিন দশক পরেও, কোনও গভীর গবেষণা ধরে দিতে পারেনি ক্ষুদ্র বাঙালি থেকে বৃহৎ বাঙালি, অরুণকুমার থেকে উত্তমকুমার হয়ে ওঠার পূর্ণাঙ্গ কাহিনি। তাঁর অতি উজ্জ্বল তারকাবৃত্তের বাইরে সেই ইতিহাসের অনেক পাতা আজও অন্ধকারে। সেই অন্ধকারকে কি জানতেন উত্তমকুমার, পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড়িয়েও কি মনে ছিল তাঁর, অতল খাদের কথা? ছিল হয়তো। হয়তো তাই, অনেক পরে তাঁর অনুলিখিত-আত্মজীবনী আমার আমি-র শুরুতেই বলবেন, আমার চারপাশে ঘন অন্ধকার। নিকষ কালো অন্ধকার।
আমি দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে আছি একটি আলোকিত বৃত্তের মাঝখানে।
|
উত্তমকুমারের নিজের লেখা আত্মজীবনী
হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর
(সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে প্রকাশিতব্য) অবলম্বনে। |