|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
আধুনিকতার বিবর্তনের একটি নির্ভরযোগ্য রূপরেখা |
সম্প্রতি হ্যারিংটন স্ট্রিট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল ‘দ্য আর্ট অব বেঙ্গল’ শীর্ষক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
বাংলা আজ যা ভাবে, সমগ্র ভারত ভাববে তা আগামী কাল। এই আপ্তবাক্য আজ আর সত্যি নেই তেমন। এ রকমই হয়তো মনে করেন অনেকে। তবু এ কথা অস্বীকার করা যায় না ভারতের আধুনিক চিত্রকলার ক্ষেত্রে বাংলার পথিকৃতের ভূমিকা ছিল এক দিন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতকের চল্লিশের দশকের আগে পর্যন্ত অন্তত। তার পরে পরিস্থিতি পাল্টেছে। সেখানে বাংলার অবস্থান কোথায়, তা বিতর্কের বিষয়।
ভারতের চিত্রকলার প্রাক-আধুনিক ও আধুনিকতার নির্মাণে বাংলার অবদানের উপর এক আলোচিত অবলোকনের দৃষ্টান্ত নিয়ে উপস্থাপিত হল একটি প্রদর্শনী। এটি সম্ভব হল দিল্লি আর্ট গ্যালারির ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও নিমগ্ন গবেষণায়। প্রদর্শনীটি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল কলকাতার হ্যারিংটন স্ট্রিট আর্ট সেন্টারে। প্রায় ১০৪ জন শিল্পীর ৪০০রও বেশি ছবি ও ভাস্কর্য নিয়ে আয়োজিত এই বিপুল প্রদর্শনীটি। প্রদর্শনীটির শিরোনাম- ‘দ্য আর্ট অব বেঙ্গল’। এই উপলক্ষে একই শিরোনামের অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। যাতে প্রদর্শিত ছবি ছাড়াও রয়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ আরও কিছু ছবি ও ভাস্কর্যের প্রতিলিপি। দিল্লি আর্ট গ্যালারির কর্ণধার আশিস আনন্দের পৃষ্ঠপোষকতায় এই বই ও প্রদর্শনী সম্পাদনা করেছেন কিশোর সিংহ।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার অভিঘাতেই এই বাংলায় সঞ্চারিত হয়েছিল প্রাক-আধুনিক ও আধুনিকতার প্রথম পর্যায়ের অঙ্কুর। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বিভিন্ন ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় শিল্পী ভাগ্যান্বেষণে একে একে আসছিলেন এই বাংলায়। টি.লি.কেটল কলকাতায় পদার্পণ করেছিলেন ১৭৬৯ সালে।
|
|
প্রদর্শনীর একটি ছবি। |
ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতার শিল্প আঙ্গিক ক্রমে ক্রমে বিস্তৃতি পাচ্ছিল এখানে। মোগল ও অন্যান্য দরবারি চিত্রশালাগুলি নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছিল ক্রমশ। সেখানে কর্মরত বিপন্ন শিল্পীরা চলে আসছিলেন শহরে। বিদেশি শিল্পীদের সংস্পর্শে আয়ত্ত করতে চেষ্টা করছিলেন স্বাভাবিকতার আঙ্গিক। দুই সংস্কৃতির সম্মিলন থেকে বিকশিত হল দু’টি শিল্পরীতি। কোম্পানি স্কুল ও অনামা শিল্পীদের তেলরঙের ছবি, যাকে অনেক সময় প্রত্ন-বঙ্গীয় ঘরানাও বলা হয়। এই শেষোক্ত চিত্ররীতির বিস্তার ঘটেছে অনেকটা সময় জুড়ে। ঊনবিংশ শতকের সূচনা থেকে বিংশ শতকেরও প্রথম দু’একটি দশক পর্যন্ত। কোম্পানি স্কুলের নিদর্শন এই প্রদর্শনীতে কম থাকলেও অনামা শিল্পীদের তেলরঙের ছবির অনেকগুলি সমৃদ্ধ দৃষ্টান্ত ছিল। তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় ছিল কালীঘাটের পটচিত্রের সম্ভার। গ্রামবাংলার লৌকিক শিল্পীরা শহরে এসে উদ্ভাবন করেছিলেন এই অসামান্য চিত্রশৈলী। এরও বিস্তার ঘটেছিল ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে বিংশ শতকের প্রথম চতুর্থাংশ পর্যন্ত। কালীঘাটের পটচিত্র বাংলার শিল্পপ্রজ্ঞার এক অসামান্য অবদান, যা পরবর্তী আধুনিকতাকে নানা ভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে।
১৮৫৪ সালে কলকাতার গড়ানহাটায় প্রতিষ্ঠিত হল ‘স্কুল অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট’। পরে এটিই রূপান্তরিত হয়েছে ‘গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্ট’-এ। অ্যাকাডেমিক স্বাভাবিকতার অনুশীলন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেল। এখানে প্রশিক্ষিত শিল্পীদের চর্চার মধ্য দিয়ে যে স্বাভাবিকতার চিত্ররীতির উদ্ভব ঘটল, তার অভিঘাত আমাদের আধুনিকতায় নানা ভাবে কাজ করছে আজ পর্যন্তও। অন্নদাপ্রসাদ বাগচি, বামাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, শশী হেশ প্রমুখ এই পর্যায়ের পথিকৃৎ অনেক শিল্পীর ছবি এই প্রদর্শনীকে সমৃদ্ধ করেছে।
ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী স্বদেশী চেতনার জাগরণ এই বিদেশি চিত্র-আঙ্গিকের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী অবস্থান নিল। অবনীন্দ্রনাথ ১৮৯৭ সালে দেশীয় আঙ্গিকে আঁকলেন ‘রাধাকৃষ্ণ’ চিত্রমালা। ১৮৯৬তে ই.বি.হ্যাভেল এলেন কলকাতায় আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ পদে। ১৮৯৭তে ‘রাধাকৃষ্ণ’ চিত্রমালা শেষ হওয়ার পরে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল অবনীন্দ্রনাথের। এই দুই শিল্পী মনীষীর যুগ্ম প্রয়াসে উদ্ভাবিত হল স্বদেশ চেতনার নতুন আঙ্গিক, নব্য ভারতীয় ঘরানা নামে যা সুপরিচিত। অবনীন্দ্রনাথের শিষ্য-পরম্পরার কাজের মধ্য দিয়ে যা প্রায় বিশ্বব্যাপ্ত হল। নন্দলাল বসু এই নবচেতনার প্রধান এক রূপকার।
এই পর্যায়গুলির উপর বিস্তৃত আলোকপাত করতে করতে এই প্রদর্শনী এসে শেষ হয়েছে ১৯৬০ এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের শিল্পকৃতিতে পৌঁছে। খুবই প্রজ্ঞাদীপ্ত ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে এই বিবর্তন। শুধু একটিই অভাব অনুভূত হল। এই সময়ের, বিশেষত ষাটের দশকের মহিলা শিল্পীদের উপর সে ভাবে আলোকপাত করা হয়নি। |
|
|
|
|
|